• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

এখনো আছে সময়

কিছু একটা হয়েছিল। বাবা কখনো কিছু বলেননি। কিন্তু জাগরী এখন কী করবে? ছুটে যাবে কাঁচরাপাড়া? শেষ দেখা যদি দেখা যায়। কিন্তু বডি আছে কি?

কাল্পনিক চিত্র

মিতা নাগ ভট্টাচার্য

জাগরীর খুব ভোরে একবার ঘুম ভাঙে। সেসময় ফোনটা একবার নাড়াচাড়া করে, আর সেই মুহূর্তেই মেসেজটা টরেটক্কা শব্দে ভেসে ওঠে।

Advertisement

নিরূপদা আর নেই। কী এক বিষম ধাক্কায় জেগে ওঠে যেন জাগরী, সে কী? কী হল? কেন হল? বুকের ভিতর কেমন হু-হু করে উঠল। আরো এক নিজের জন চলে গেল। পৃথিবীটা এক এক করে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। দু’হাজার পঁচিশ সালটা একের পর এক হারিয়ে যাবার খবর আনছে।

Advertisement

মৃত্যুর সংবাদ কী নির্মমতায় আছড়ে পড়ে। মানুষ অনেক কিছু পেরেছে, কিন্তু না। এ জায়গায় সে এখনও চূড়ান্ত অসহায়।

মনের গহিনে প্রশ্ন আসে, খবরটা ভুল নয় তো। কোনো রোগের খবর তো আসেনি। নিরূপদা জাগরীর জ্যাঠার ছেলে। ছোটবেলায় তো তারা এক বাড়িতেই বড় হয়েছে। ঘড়িতে পৌনে চার। কে আছে এখন জেগে?
কাকে ফোন করে জানতে চাইবে?

হঠাৎ মনে আসে, যার কাছ থেকে মেসেজ এল তাকেই ফোন করা যেতে পারে। মেসেজ এসেছে মৃদুলদার কাছ থেকে। ক্ষীণ যোগাযোগ আছে। কখনো সখনো গুডমর্নিং ভেসে উঠলে জাগরী পাল্টা মেসেজ দিয়েছে। শুভ সকাল। ওই পর্যন্ত। তবে ঠিক মৃদুলদাই যোগাযোগ রেখেছেন। মৃদুলদা নিরূপদার ক্লাসমেট। কাঁচরাপাড়ায় পাশের পাড়াতে থাকত। জাগরী নিজের থেকে যোগাযোগ রাখতে পারেনি। অনেকবার ভেবেছে, একবার ফোন করে খোঁজ নেবে। মৃদুলদাকেই ফোন করে। কিন্তু সুইচ অফ।

সব ছেড়ে বাবা চলে এসেছিলেন, কিন্তু অধিকার তো লিখিতভাবে ছাড়েননি। ছাড়তে চাননি। আছে প্রাণের স্মৃতি। কোনোদিন গিয়ে থাকতে হলে থাকবেন। কিন্তু মা এতটাই শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়লেন কলকাতা থেকে কাঁচরাপাড়া গিয়ে গিয়ে ওঠা আর হল না। এদিকে মায়ের চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি, নতুন করে কাঁচরাপাড়া গিয়ে গুছিয়ে বসা বাবার অন্তরে থাকলেও বাস্তবে আর হয়নি়। বাবা চলে গেছেন বছর দুই।

নিরূপদাকে বাড়ি লিখে দিতেও আর পারলেন না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নিরূপদাও চলে যাবেন, এত ভাবতে পারছে না জাগরী। কত বয়স হয়েছিল? মনে মনে হিসাব কষে জাগরী।

বাড়িতে ছেলে, তার বাবা, সবাই ওঘরে এখনও ঘুমিয়ে। নিরূপদা বাবার সঙ্গে তেমনভাবে আর যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু জাগরী এখন কী করবে? ছুটে যাবে কাঁচরাপাড়া? শেষ দেখা যদি দেখা যায়। কিন্তু বডি আছে কি? ওদের তরফ থেকে কেউ কিছু জানাল না।

নিরূপদা আর নেই। মনের গহিনে প্রশ্ন আসে, খবরটা ভুল নয় তো। কোনো রোগের খবর তো আসেনি। নিরূপদা জাগরীর জ্যাঠার ছেলে।

নিরূপদার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ফিকে হয়ে গেল জ্যাঠা মারা যাবার পর। জ্যাঠামশাই মারা গেলে তখন তো বাবাকে নিয়ে পুরনো বাড়িতে গিয়েছিল জাগরী। এর কিছুদিন পর নিরূপদার স্ত্রী ঝুমা বৌদি ফোন করে বাবাকে সরাসরি বলে বসল বাড়িটা লিখে দিতে।

সব ছেড়ে বাবা চলে এসেছিলেন, কিন্তু অধিকার তো লিখিতভাবে ছাড়েননি। ছাড়তে চাননি। আছে প্রাণের স্মৃতি। কোনোদিন গিয়ে থাকতে হলে থাকবেন। নিরূপদাকে বাড়ি লিখে দিতেও আর পারলেন না। আসলে বাবা কোনো এক অভিমানে কাঁচরাপাড়ার সঙ্গে যোগাযোগও রাখছিলেন না।

ফোন বাজছে, জানালা দিকে রোদ এসে পড়ছে। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
—‘গুড়িয়া, টিনাদি বলছি রে। তুই কী খবর পেয়েছিস? তোর নিরূপদা মারা গেছেন রে। শুনে এত খারাপ লাগছে। তোকে ফোন না করে পারলাম না’। টিনাদি জাগরীর মাসির মেয়ে। বিয়ে হয়েছে জাগরীদের পুরনো বাড়ির কাছাকাছি।

উত্তরের অপেক্ষা না করে গড়গড় করে সব বলে দিল। তার মানে খবরটা সত্য।
এবার বুকের ভিতর থেকে কান্না উথাল দেয়। নিজের আর ভাইবোন নেই। ছিল এক রক্তের সম্পর্কের দাদা। চলে গেলেন। নিরূপদা বাবার সঙ্গে তেমনভাবে আর যোগাযোগ রাখেনি।

কিছু একটা হয়েছিল। বাবা কখনো কিছু বলেননি। কিন্তু জাগরী এখন কী করবে? ছুটে যাবে কাঁচরাপাড়া? শেষ দেখা যদি দেখা যায়। কিন্তু বডি আছে কি? ওদের তরফ থেকে কেউ কিছু জানাল না।

হত বুদ্ধি লাগে়। সময় নষ্ট করা যাবে না। নিজেকে কেমন অপরাধী লাগে, মেয়ে হিসাবে জাগরী তো বাবাকে জোর করতে পারত। নিরূপদাকে বাড়িটা লিখে দিতে। আজ সম্পর্কটা নিকট থাকত।

—কী হল, মা? কতবার ডাকছি। চা দাও, আমি আজ এখুনি কলেজে বের হব। বলতে বলতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকায়, ছেলে আবীর। মায়ের চোখে জল। কী হল?

মধ্যরাত থেকে জমাটবাঁধা কান্নাটা আছড়ে পড়ে ছেলে কাছে আসামাত্র। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠে জাগরী।
আবীর গেছে কাঁচরাপাড়া, সে নিরূপ মামাকে দেখেছে, কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেও মায়ের কষ্ট সে অনুভব করে।
—‘তুমি যখন জানলে আমাদের ডাকবে তো। একা একা কষ্ট পাচ্ছ।’
এই অস্বাভাবিক মুহূর্তে ছেলের ঠোঁট ভেঙে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো স্নাত করল জাগরীকে। অনুভূতিহীন নয় আবীর।
—‘তুমি কি ওখানে যেতে চাও মা, তাহলে আমি যাই তোমার সঙ্গে। একটা ফোন করো না ওদের।’ ঠিক বলেছে আবীর। দেরি করছে কেন জাগরী। ফোন করে বৌদিকে। ফোনে কান্নায় ভেঙে পড়ে ঝুমাবৌদি।
—‘গুড়িয়া, সব শেষ হয়ে গেল গো। তোমার কথা বলত, আফশোস করত, গুড়িয়াও আমার কথা ভুলে গেছে, একটু ফোন করে না।’ ঝুমা বৌদির দুঃখ-কথা ফোনযন্ত্র ভেদ করে ঠিকরে পড়ে জাগরীর হৃদপ্রদেশে।
বৌদি বলতে থাকে,
—‘সারা জীবনের মত এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল তোমার দাদা। এখন আমি কী করব।’ বিহ্বলতায় নিশ্চুপ জাগরী। তার মানে দাদাকে দেখতে পাবার আর জায়গা নেই।
পরদিন চলে এসেছে কাঁচরাপাড়া। একাই জাগরী।

অনেকদিন পর এল এ বাড়ি। ঝুমাবৌদির সঙ্গে সখ্য ছিল একসময়। গত দিনের শোকপ্রবাহ তার চোখে মুখে প্রবলভাবে বিদ্যমান। দেখামাত্র জড়িয়ে ধরেছেন। চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। এ নৈকট্য স্তব্ধ হয়ে ছিল কীভাবে? বাবা চুপ হয়ে গিয়েছিলেন দেখে জাগরীও এ বাড়ির থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলেছিল। আজ মনে হচ্ছে কাজটা ভুল হয়েছে। যোগাযোগ রেখে চলতে হয়। কয়দিনের আর জীবন। একসময় সব শেষ হবেই। যে ক’দিন বাঁচা যায়। সকলে মিলে চলাটাই তো শুভ বুদ্ধি। কিন্তু এ কথা মানুষের মনে থাকে না। সময়, চাহিদা, পরিস্থিতি সব ওলোট-পালট করে দেয়।

মাঝখানে উঠোনটা একইরকম আছে জ্যাঠামশায় মারা গেলে শেষবার এসেছিল জাগরী। ছোটবেলায় টানা বৃষ্টি হলে মাঠে জল দাঁড়িয়ে গেলে উঠোন জুড়ে লুকান্তি চোর খেলা হত। উঠোনটা সেই একরকম আছে। খেলুড়েরা হারিয়ে যাচ্ছে। নিরূপদার সঙ্গে কেমন করে যেন দূরত্ব রচনা হয়েছিল। জাগরীর বিয়ের পর নতুন পরিবেশে চলে গিয়ে সেখানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শাশুড়ি ছিলেন, শ্বশুরমশায়কে জাগরী দ্যাখেনি। ছেলে যখন ছয় বছর শাশুড়ি মারা গেলেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের চাকরিতে ছোটা। মায়ের উৎসাহেই কলকাতার ফ্ল্যাটে বাবা মাকে নিয়ে এসেছিল জাগরী। নিজের ছোটবেলার প্রিয় জায়গার কথা চকিতে মনে এলেও তা নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায় ছিল! এমনভাবে কত সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়, শুধু পারস্পরিক কথা বিনিময়ের অভাবে। ব্যস্ত নাগরিক জীবন মানুষকে ক্লান্ত করে দেয়। সে অনেক কিছু ভাবে কিন্তু হয়ে ওঠে না।
পুরোনো অনেক কথা উঠছে।

—‘গুড়িয়া তোমার দাদা কাকাকে কিছু বলতে চেয়েছিল, কাকা তা বিশ্বাস করলেন না, মানতে চাইলেন না। তোমার দাদা ঠিক করেছিলেন, তোমাকে সব জানাবেন। এখানে তোমরা আসছিলে না, ফাঁকা ঘর, এত বড় বাড়ি, সবার নজর পড়ছিল। নানাভাবে আমাদের উত্যক্ত করা হচ্ছিল, তাই তো নিরুপায় হয়ে বাড়িটা লিখে দেবার কথা কাকাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।’

জাগরী বুঝে উঠতে পারে না, কী এমন কথা, যা বলছে বৌদি! বাবা তো কোনোদিন কিছু বলেননি জাগরীকে। নিরূপদা কী এমন বলেছে যাতে বাবা বিরক্ত হয়েছিলেন। ঠিক তখুনি ‌কয়েকজন ঘরের দরজার সামনে।
—‘বৌদি, আমরা সব শুনে এলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করতে।’ হোমরা চোমরা ভাবসাব। পাঁচজন। বৌদির মুখের রেখা সঙ্গে সঙ্গে বদল।
কারা এরা? নিজেরাই চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে। চোখে মুখে উগ্রতার ছাপ।

—‘দাদা অসুস্থ, আমাদের খবর দিতে পারতেন। হাসপাতালে নিতে নাকি দেরি হয়েছিল। দাদা ফালতু চাপ নিয়েছিলেন, আমাদের কথায় রাজি হয়ে গেলে সব ভালো হতো। আমরা কাজ শুরু করতাম। আর আপনাদের ঘরেও টাকা আসত।’

—‘আপনারা প্লিজ থামুন। মানুষটা এই টেনশনে শেষ হয়ে গেল।’ একরকম চিৎকার করে উঠেছে বৌদি। জাগরীর চোখের সামনে কী এক সত্য উঠে আসছে। এদের উপদ্রপেই হয়ত নিরূপদা খুব সমস্যায় পড়েছিলেন। জাগরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন তোলে ওদের একজন,
—‘ইনি কি জাগরীদিদি?’

বৌদির চোখে মুখে বিরক্তি। কিন্তু এ তো সরাসরি প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারলেন না।
লোকগুলোর চোখে যেন আহ্লাদ।
—‘নমস্কার দিদি। আপনার সঙ্গে দেখা করার বড় ইচ্ছে ছিল।’ এবার বৌদি আরো দৃঢ়, —‘আমাদের পরিবারের শ্রাদ্ধের নিয়ম নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা আছে। আপনারা আসুন এখন।’

জাগরী বোঝে কিছু একটা ব্যাপার আছে। লোকগুলো সুবিধে করতে না পেরে চলে যায়।

জাগরী মনে মনে প্রস্তুত হয়়, রোজ আসা হবে না। বাড়িতে আর কেউ নেই, যার সঙ্গে কথা বলবে। নিরূপদার এক মেয়ে বিদেশে থাকে, বারবার ফোন করছে। স্বামীর কর্মসূত্রে সে বাইরে থাকে। বৌদিকে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করে নেওয়াই শ্রেয়। একটু দ্বিধা হয়। প্রয়োজন দ্বিধাকে মান্যতা দিতে পারে না। ভিতরে বড় অস্থিরতা। জাগরীর ঠোঁটে শব্দরা আকৃতি পায়,

—‘বৌদি, যা হবার হয়ে গেছে। আমাকে বলো সব। এখন যা করার করব। আমি আছি তোমার পাশে।’ এ কথায় বৌদির চোখে যেন আলোর দিশা। উঠে দাঁড়িয়ে জাগরীর হাতটা ধরেন, বুকের ভিতর থেকে কান্না আসে যেন।

—‘দেখবে এসো’। বারান্দার এদিকে জাগরীদের ঘরটা ভেজানো। খুললেন। দেয়ালে জাগরীর জন্মদিনের ছবি। বাবা, জেঠু, জেঠিমা, মা, ভাইবোনরা। মনটা তরল হয়ে গেল। বাবার ছবিতে মালা দেওয়া। পুরোনো হলেও।

—‘গুড়িয়া, তোমার দাদা বাড়ি অন্যের হাতে দিতে চায় না। টাকার লোভ তার ছিল না। বাবা কাকা যে বাড়িতে ছিল সেটা নিজের রাখতে চেয়েছে কেবল, তুমি দেখো বাড়িটা যেন হাতছাড়া না হয়। তাঁর আত্মা স্বর্গে গিয়েও যে শান্তি পাবে না। তোমার দাদা কাকাকে খুব ভরসা করতেন। সবাই এক সঙ্গে থাকবে আশা করতেন। মাঝে মাঝে ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কিন্তু এই লোকগুলো হঠাৎ একদিন এসে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট করতে চাপ দিলে। তোমার দাদা ভয় পেয়ে গেলেন। তোমার দাদা কাকাকে সব জানাল, কিন্তু কাকা বিশ্বাস করলেন না।

ওরা হয়ত কাকাকে ফোন করে মিথ্যে কথা বলেছিল তোমার দাদার বিরুদ্ধে। তোমার দাদা ফোন করলে ধরতেন না। আর এরা রোজ এসে হুমকি দিত। পুরোনো মানুষরা তেমন কেউ নেই। এখন যে যার মতো চলে। এদের প্রতাপ এখন।’ জাগরীর চোখের আঙিনায় কষ্ট মাখা জল প্রবলগতিতে এসে জড়ো হয়। আত্মা আছে কিনা জানে না। বিশ্বাস করে যে আত্মা আছে। পূর্বপুরুষদের ভালোবাসার টানকে সে রক্ষা করবে। জাগরী এসব কিছুই জানত না। আসলে বাড়িটা বাবার কাছে অমোঘ টান। জাগরী অস্বীকার করতে পারবে না, ছোটবেলায় থাকার জায়গার প্রতি তারও তো কম টান না। বাবা পুরোনো বাড়ি ছাড়তে চাননি। তাই হয়ত ধরেননি ফোন। আজ কে উত্তর দেবে? নাকি এ লোকগুলো কোনোভাবে বাবাকেও চাপ দিয়েছিল? জাগরীর অশান্তি হবে ভেবে বাবা কিছু বলেননি? পুরোনো বারান্দা, গেটের সামনে নারকেল গাছ, টগর ফুলের গাছটা, সব যেন একইরকম আছে। সব কেমন যেন জড়িয়ে ধরতে থাকে জাগরীকে। সবাই চলে যাচ্ছে এ পৃথিবী ছেড়ে। এক ঝুমাবৌদি আছে। তার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবে না জাগরী। জাগরীর অন্যতম প্রদেশে শব্দরা জাগ্রত হয়, এখনো সময় আছে।

ফেরার পথে কাঁচরাপাড়া স্টেশনে পা রেখেই মনে হয় সেই মুখরোচক ঘুগনি এখনো বিক্রি হয় কি? ঠিক তখুনি কে যেন ডেকে ওঠে—

—‘গুড়িয়া-আ-আ’। চোখ তুলে তাকাতেই মৃদুলদা।

—‘আমি জানতাম তুই আসবি। তোদের ও বাড়ি গিয়ে দেখা করার মুখ আমার নেই রে। শয়তানগুলো আমার কাছ থেকে জোর করে তোর বাবার ফোন নম্বর নিয়েছিল। নিরূপ জানতে পেরে খুব রাগ করেছিল। ইদানীং আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না। আমিই বা কী করতাম বল, পুরনো মানুষরা নেই। সব বদলে যাচ্ছে। কতদিন পর তোকে দেখলাম। বাড়িটা রক্ষা করিস রে।’ ডাউন ট্রেনের খবর সশব্দে ঘোষণা করা হচ্ছে। ব্যস্ত নাগরিক জীবন তাড়া দেয়।

মৃদুলদাও পাশে পাশে হাঁটেন,
—‘চল তোকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে যাব, সাবধানে যাস।’
কী এক নাড়ীর টান। ছোটবেলাকে এক সেকেন্ডে হৃদপ্রদেশে নিয়ে এল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে মৃদুলদা কম্পার্টমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছেন।

—আবার আসিস রে বোন। কী অমলিন আন্তরিকতা। কাঁচরাপাড়া টানছে জাগরীকে। শৈশব চলে যায় কিন্তু শৈশবের স্মৃতিতে জড়ানো মানুষগুলোর সঙ্গে তার অণুু-পরমাণু জড়িয়ে থাকে।
বাড়ি ফিরে এসেছে। মন পড়ে রয়েছে বৌদির কাছে। রাতে ফোন। অচেনা নম্বর।

—‘দিদি, আজ সকালে কাঁচরাপাড়ায় আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলছিলাম। আপনাদের অধিকার আছে। ছাড়বেন না। আমরা আপনাদের ঠিক খুশি করব। বৌদিকে বলুন, বাড়ির মায়া না করে আমাদের ছেড়ে দিতে। আপনার বাবা আমাদের পক্ষে ছিলেন। আপনারা তো চলে এসেছেন, ওবাড়ি থেকে আর কিছু পাবেন না। আমরা আপনাদের পাওনা বুঝিয়ে দেব।’ জলের মত স্পষ্ট হয় সব। বাবাকেও নির্ঘাৎ এরা ফোন করেছিল। ভুল বুঝিয়েছে। নিরূপদা সম্পর্কে ভুল কথা, মিথ্যে কথা বলেছে। অভিমানে বাবা সরে গেছেন। যোগাযোগ রাখেননি। একবার তো নিরূপদাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারতেন বাবা। বাইরের লোক এভাবেই দূরত্ব তৈরি করে দেয়। বুঝতে দেরি হয় না, কী উদ্দেশ্যে ফোন। বাবা প্রকাশ করতে পারেননি, নিরূপদাও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। না। এদের আর বাড়তে দেবে না জাগরী, এখনও সময় আছে। বৌদি আছে, জাগরী নিজে আছে।

চিৎকার করে প্রবল শব্দদের তরবারির মত ছোটায় জাগরী,
—‘থামুন, অনেক বলেছেন। আমাদের বাড়ি আমরা কারুর হাতে ছাড়ব না।’
জাগরীর চোখে ভাসে বাবার মুখে স্বস্তির হাসি। নিরূপদার মুখেও। বাবা যেন বলছেন ঠিক করেছিস। আমি যা পারিনি তুই পেরেছিস।

Advertisement