• facebook
  • twitter
Saturday, 20 December, 2025

খেলাঘর

মাসছয়েক আগেই বৈশালী অভির প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে জয়েন করে। জাহ্নবীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ওদের গত ওয়েডিং অ্যানিভারসারিতে।

কাল্পনিক চিত্র

তাপস চট্টোপাধ্যায়

মাঝরাতে জাহ্নবীর বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা হঠাৎই বেজে ওঠে, —ন্যাশনাল হাইওয়েতে অভিজ্ঞান রায়ের কার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। ওঁর সঙ্গী একজন মহিলাও গুরুতর আহত। ওঁদের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

Advertisement

জাহ্নবীর জীবনের সিংহভাগ জুড়ে আছে আস্ত একটা খেলাঘর। যাদেরই আপন ভেবেছে, তারা সকলেই একদিন খেলা শেষে কে কোথায় হারিয়ে গেছে জাহ্নবী জানে না।

Advertisement

ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর বাবা প্রথমে নতুন মাকে, তারপর ছোটবোনকে উপহার দিয়েছিল। ভেবেছিল সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। বাবা বলতো অতীতটা ভুলে যাও, নতুন মা বোঝাতো অ্যাডজাস্ট করতে শেখো। ছোটবোনটা বলতো, মেমরিতে যা আছে সব ডিলিট করে দে। জাহ্নবী পারেনি, মায়ের ফটোটার সামনে দাঁড়ালেই একটু একটু করে ওটা ঝাপসা হয়ে উঠতো।

সেদিন পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাতে থাকা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে জাহ্নবী অঝোরে ভিজছিল। অভিজ্ঞান ওর গাড়িটাকে পাশে এনে ওকে গাড়িতে উঠতে বলে। হুট করে একজন অজানা অচেনা লোকের গাড়িতে উঠতে জাহ্নবী ভয় পেয়েছিল। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে অভিজ্ঞান ছাতাটা বাড়িয়ে বলেছিল, কাল এটা এই গাছেই ঝুলিয়ে রাখবেন, আমি নিয়ে যাবো। পরদিন জাহ্নবী সেটা পারেনি, অভির জন্য অপেক্ষা করেছিল।
মোহিনী বলেছিল, ভাড়াবাড়ি থেকে বাড়াবাড়ি ভালো।
কথাটা অদিতিকে উদ্দেশ করে বললেও ও তেমন গায়ে মাখেনি।

অফিস থেকে ফেরার পথে লেক মার্কটে নেমে অদিতি একটা বেডশিট কেনে। বারুইপুরে মোহিনীর নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ, অফিসের সকলের নেমন্তন্ন, পিঙ্কি আর কর্ণকেও আনতে বলেছে। অদিতি জানে কর্ণ যেতে রাজি হবে না। ও বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের, ইদানিং আরো বেশি ডিপ্রেসড মনে হয়। ওই ঘটনার পর নিজেকে একদম গৃহবন্দি করে ফেলে শুধু মেয়েকে না বলতে পারে না, স্কুল থেকে ফিরলে ওর হাত ধরে সামান্য সময়ের জন্য পার্কে গিয়ে বসে।

ঘটনা না বলে অঘটনই বলা যায়। ব্রজেন আগরওয়াল শহরের নামকরা বিল্ডার ছিল। অদিতি কলেজের গণ্ডি পার করে ওই অফিসেই চাকরি পায়। কর্ণ তখন সবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ওই কোম্পানিরই পার্টটাইম প্রোজেক্ট অ্যাডভাইসার। ব্রজেনবাবুর নির্দেশমতো কর্ণকে যাবতীয় সাহায্য করার দায়িত্ব ছিল অদিতির ওপর। গোল বাধল সেখানেই। প্রেজেন্টেশনের আগের দিন প্রোজেক্টের দরকারি ডাটা সমেত পেনড্রাইভটা অদিতির টেবিলের ড্রয়ার থেকে হঠাৎই উধাও হয়ে গেল। সারাটা রাত টেনশনে ঘুম এল না, ভোরের আগেই অদিতি পৌঁছে গেল কর্ণদের বাড়ি। এত অল্প পরিচয়ে এইভাবে বাড়িতে আসা, সংশয়ের দোলাচলেই অদিতি বেল বাজালো। কর্ণ একটু মুচকি হেসে নিজের ল্যাপটপ থেকে সেভ করা ডাটাগুলো পেনড্রাইভে কপি করে নেয় কিন্তু অদিতিকে দেওয়ার আগে একটাই শর্ত রাখে, কর্ণর মায়ের হাতের গরম গরম লুচি তরকারি ব্রেকফাস্ট খেয়ে একসঙ্গে অফিস যেতে হবে।

ঝিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে জাহ্নবীর গাড়ির ওয়াইপারটা উইন্ডস্ক্রিনের ওপরে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছিল। মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাতে পুরীর বিচ রিসর্টে মাঝরাতে অভি জাহ্নবীকে ঘুম থেকে তুলে সমুদ্রে নামিয়েছিল। চাঁদের আলো গায়ে মেখে উুঁচু উুঁচু ঢেউগুলো ক্রমাগত জাহ্নবীকে ভয় দেখাচ্ছিল। প্রথমে পায়ের পাতা, গোড়ালি তারপর হাঁটু ছাপিয়ে সেদিন ঢেউগুলো ওকে এতটুকুও বেসামাল করতে পারেনি।
আজও জাহ্নবী নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করে। ভোরের আলো ফোটার আগেই সুপারস্পেশালিটি হসপিটালে ওটির সামনে হাজির হয়ে যায়।

অদিতি আর কর্ণর জীবনে সবকিছুই এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো যেন দমকা হাওয়ায় অনেকগুলো পৃষ্ঠা একসঙ্গে উল্টে গেলো। প্রেমপর্বটা ভালো করে না জমতেই বিয়ে, তারপর পিঙ্কি এলো। কর্ণর মা চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের একান্নবর্তী সংসারে অদিতির চাকরি করা নিয়ে একরাশ অভিযোগ, অবশেষে শকুন্তলা পার্কের দু’কামরার ভাড়া বাড়িতে সংসার পাতা।
—দিদি, খাবার জলের বোতলটা একটু দাও না। নিজের কেবিনে বসে অদিতি অতীতটায় চোখ বোলাতে বিভোর ছিল, পঞ্চমীর কথায় হুঁস ফেরে।
—কীরে হাঁপাচ্ছিস কেন? চোখ মুখ বসে গিয়েছে একেবারে।
—আর বোলো না গো, সারাটা রাত অনুর আব্বু পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, দু’চোখের পাতা এক করতে দেয়নি।
চার বোনের পর হয়েছিল বলে মা নাম রেখেছিল পঞ্চমী এরপর কালিমকে বিয়ে করে ‘হাসিনা’ হলেও ওর আইবুড়ো নামটাই বেশি পছন্দের। ওর পাঁচ বছরের মেয়ে ‘আনোয়ারা’, ডাক নাম অনু।
—তোর বর তো তোকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে শুনেছিলাম।
—সে তো নাগরকে সোহাগ করতে আসেনি, এসেছিল টাকা হাতাতে, আর ফূর্তি করতে, মিটে যেতে পালিয়েছে। পঞ্চমী একনিঃশ্বাসে ক্ষোভ উগরে দেয়। গত দু-মাস লোকটা পেটের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছিল, না ডাক্তার, না বদ্দি। শেষে আমি গিয়ে বাড়ি নিয়ে আসি। কী করি বলো, ও তো আমার মেয়ের বাপও বটে।
—ডাক্তাররা অভির ব্রেনডেথ ডিক্লেয়ার করেছে। বৈশালী ঠিক আছে। অভির অফিস কলিগ শান্তনু খবরটা জাহ্নবীকে জানায়।
—মন্দারমণি থেকে ফিরছিল। পুলিশ জানিয়েছে দু’জনেই ড্রাঙ্ক ছিল, মুখোমুখি ট্রেলারে হিট করে।
উইকএন্ডে লংড্রাইভে যাওয়া অভির নেশা ছিল। প্রথমবার জাহ্নবী মন্দারমণির হোটেলে কাপলদের থাকার জন্য স্পেশাল ওই সুইটটায় অভির সঙ্গে পা রেখেছিল। কথায় কথায় হোটেলের ম্যানেজার জাহ্নবীকে বলেছিল, প্রতিবার স্যারের ওই সুইটটাই বিশেষ পছন্দ।

হাসনাবাদের রেললাইনের গা ঘেঁসে বস্তির ঘুপচি ঘর থেকে পঞ্চমী বড় আকাশ দেখতে ভুলেই গিয়েছিল। সাত সাতটা ভাই-বোনের সংসারে অভাব ছাড়া সবই ছিল বাড়ন্ত। স্বপ্নের ফেরি করতে কালিমের জুড়ি ছিল না। নিজে আট ক্লাস পাশ, শান্তিবাগে পৈত্রিক পাকা বাড়ি, ভাতের হোটেল, ডাহা মিথ্যেগুলো থরেথরে সাজিয়ে অনায়াসে বলেছিল।

অষ্টাদশী পঞ্চমী আইহোল দিয়ে যাচাই না করেই ওর ভালোবাসার দরজাটা হাট করে খুলে দেয়, আর সেই ফাঁকে কালিম সহজেই ওর নিষ্পাপ শরীরটার দখল নিতে পারে। তবে জাত-ধর্ম নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। কিন্তু পঞ্চমী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় দুই ধর্মের মাতব্বররা বিয়েটা মেনে নিয়েছিল।

সেদিন হাসপাতাল থেকে ফোনটা এসেছিল অদিতির কাছে। তিলতিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নের ইমারতটা ওর চোখের সামনে চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে।

ওটি থেকে বেরিয়ে ডাক্তারবাবু বলেছিল, —ওঁকে বাঁচানো গেলেও দুটো চোখই ব্যাডলি ড্যামেজড্। স্যরি, হি ইজ পারমানেন্টলি ব্লাইন্ড।
একটা নির্মীয়মাণ বহুতলের ইনস্পেকশনে গিয়েছিল কর্ণ। হঠাৎ অসাবধানতায় চারতলা থেকে নিচে ইট আর পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে।
—তুই রাজেনের সঙ্গে অফিস ট্যুরে যাস, অর্পণ কিছু বলে না? মনের মধ্যে থাকা প্রশ্নটা অদিতি মোহিনীর দিকে ছুঁড়ে দেয়।
—কী বলবে, ওর আদ্যিকালের সাইবারক্যাফে থেকে রোজগারপাতি যা হয়, তাতে কলকাতা শহরে ব্রেকফাস্টও জুটবে না।
মোহিনীর ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচটা অদিতিকে অবাক না করে পারে না।
ব্রজেনবাবু মারা যাওয়ার পর রাজেনই কোম্পানির দায়িত্ব নেয়। অফিসে জয়েন করার পরেই ওর শ্যেনদৃষ্টি পড়ে অদিতির ওপর।
—আপনার এত কম স্যালারিতে এত বড় লোন অ্যামাউন্ট শোধ করবেন কী করে?

অদিতির লোন অ্যাপ্লিকেশনটা রাজেনের টেবিলের ওপর রাখা ছিল। কর্ণর অ্যাকসিডেন্টের পর অদিতি জীবনের পাসওয়ার্ডটাই হারিয়ে বসেছিল। দামি দামি টেস্ট, ওষুধপত্র, ফিজিওথেরাপি, ডাক্তারের ফিস, দু’জনের জমানো টাকা, গয়না, এমনকি পিঙ্কির মুখেভাতের আঙটিগুলো বিক্রি করেও তল পাচ্ছিল না। রাজেন জানতো শিকারকে কী করে বাগে আনতে হয়।
—আমি জানি, আপনার ওপর এখন অনেক লায়াবিলিটি, রাজেন সহৃদয় হওয়ার চেষ্টা করে। বরং আপনি আমার অফিসিয়াল ট্যুরগুলোয় আমায় অ্যাসিস্ট করলে টিএ-ডিএ ছাড়াও এক-আধটা ইনক্রিমেন্ট পেতে পারেন। আপনার লোনও তাড়াতাড়ি শোধ হয়ে যাবে।
রাজেনের থেকে এমন একটা অফার অদিতির প্রত্যাশিতই ছিল।
—স্যরি স্যার, আমার স্বামী অসুস্থ, তাছাড়া আমার একটা সাত বছরের মেয়েও আছে। এরা কেউই আমার লায়াবিলিটি নয়, বরং কমিটমেন্ট।
লোন অ্যাপ্লিকেশনটা টেবিল থেকে তুলে অদিতি চেম্বারের বাইরে চলে আসে।

কালিমের ছেড়ে চলে যাওয়াটা পঞ্চমী ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল। ছোট্ট অনুকে একটা সুন্দর জীবন দিতে ও বদ্ধপরিকর ছিল। ভোররাতে উঠে নিজের আর মেয়ের রান্নাটা সেরে ফেলতো। গবুদার দোকান থেকে ঢাউস ব্যাগটা নিয়ে ফার্স্ট লোকালে চড়ে বসতো। তারপর সারাদিন কলকাতার অফিসে অফিসে ঘুরে ফেরি করে বেড়াতো। অদিতির মায়া পড়ে গিয়েছিল পঞ্চমীর ওপর। অফিসের সবাই ওর আনা ডালের বড়ি, চাল-ছোলা ভাজা, কাঠের খোলায় বাদাম ভাজার প্যাকেট কিনতো।

মাসছয়েক আগেই বৈশালী অভির প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে জয়েন করে। জাহ্নবীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ওদের গত ওয়েডিং অ্যানিভারসারিতে। যেমন সুন্দরী, তেমনই স্মার্ট, অভির সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গ মনে হচ্ছিল। এরপরেও অভির পোষাকে লেডিজ পারফিউমের গন্ধ, মোবাইল চ্যাটিং, ব্রিফকেসে ভাঙা কন্ডোমের প্যাকেট— ওদের সম্পর্কের গভীরতা জাহ্নবীর কাছে সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো মিলে গিয়েছিল।
—মোহিনী, তুই কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস। রাজেনের সঙ্গে ওর মাখামাখিটা অদিতি ভালো চোখে দেখছিল না। অফিসে বয়স আর অভিজ্ঞতা দুটোতেই মোহিনী অদিতির জুনিয়র ছিল, কিন্তু রাজেনের দুর্বলতাটা ওর হাতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তুলে দিল। রাতারাতি মোহিনী একলাফে পৌঁছে গেলো সব পেয়েছির দেশে।
হসপিটাল সুপার কনসেন্ট লেটার সমেত একগাদা কাগজভর্তি ফাইলটা জাহ্নবীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, —অভিজ্ঞানবাবুর ব্রেনডেথের পর আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি ওঁর বেশ কয়েকটি অঙ্গ এখনও বেশ অ্যাকটিভ। আমাদের হসপিটালে দু’জন লিস্টেড পেসেন্ট আছেন যাঁদের শরীরে এই অঙ্গগুলো প্রতিস্থাপিত হলে তাঁরা নতুন করে জীবন ফিরে পেতে পারেন। অভিজ্ঞানবাবুর স্ত্রী হিসেবে আপনার লিগ্যাল কনসেন্ট ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

হঠাৎই জাহ্নবীর নজর পড়ে, একফালি জ্যোৎস্না ওর ভাঙাচোরা খেলাঘরটাকে কেমন যেন মোহময় রূপ দিয়েছে। কালিমের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। অভির লিভারটা হয়তো পঞ্চমী আর ওর ছোট্ট মেয়ে অনুকে অনেকটাই স্বস্তি দিতে পারবে। অভির চোখদুটো কর্ণ ফিরে পেলে কথা দিয়েছে, অদিতি আর পিঙ্কিকে আইনক্সে মুভি দেখাতে নিয়ে যাবে।

অভিজ্ঞানের শরীরটা এখন থেকে আর জাহ্নবীর একার নয়। ওর ভাঙাচোরা খেলাঘরটাকে অনেক আপন বলে মনে হল। খোলা ফাইলের প্রতিটা পাতায় জাহ্নবী সই করা শুরু করে।

Advertisement