• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

হিরো শিম্বা

বছরখানেক আগের ঘটনা। একদিন শিয়াঙ স্কুল থেকে ফিরছিল। বৃষ্টি-বাদলার দিন। রাস্তায় লোকজন নেই। দ্যাখে রাস্তার ধারে একটা কুকুরছানা কুঁই-কুঁই করছে।

কাল্পনিক চিত্র

মঞ্জিলা চক্রবর্তী

উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরন-চরকির মতো রাস্তা। রাস্তার একদিকে পাহাড়ের ঢাল আর অন্যদিকে গভীর খাদ। এমনই এক পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম, সিয়াথি। পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে বিপাশা নদী। নদীর অদূরেই শিয়াঙদের কাঠের দোতলা বাড়ি। ওই তো শিয়াঙ আর তার প্রিয় বন্ধু শিম্বা হেলতে দুলতে স্কুল থেকে ফিরছে।

Advertisement

বছরখানেক আগের ঘটনা। একদিন শিয়াঙ স্কুল থেকে ফিরছিল। বৃষ্টি-বাদলার দিন। রাস্তায় লোকজন নেই। দ্যাখে রাস্তার ধারে একটা কুকুরছানা কুঁই-কুঁই করছে। প্রথমে সে ছানাটার মাকে খোঁজার চেষ্টা করে। মাকে দেখতে না পেয়ে শেষমেশ সে তাকে কোলে তুলে নেয়। রুমাল দিয়ে তার গা মুছিয়ে দেয়। তারপর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘চিন্তা করিস না, আমারও মা নেই, আর তোরও মা নেই। তবে আমার বাবা আছে। আজ থেকে আমরা দু’জনেই বাবার কাছে থাকব।’

Advertisement

একরত্তি কুকুরছানাটা তার গুলির মতো চোখ দিয়ে পিটপিট করে শিয়াঙকে দেখছিল। শিয়াঙের কথা শুনে সে তার লেজটা ঘনঘন নাড়ছিল। শিয়াঙ খেয়াল করল কুকুরছানাটার কান্নাকাটি কখন বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে সে সটান হাজির হয় তার বাবার সামনে। মিষ্টি একরত্তি কুকুরছানাকে দেখে ছেলেকে কিছু বলবেন কী, হেসে ফেললেন শিয়াঙের বাবা। ব্যাস, কেল্লাফতে। সেই থেকেই তাদের তিনজনের সংসার। শিয়াঙ আদর করে কুকুরছানাটার নাম রাখে, শিম্বা। শিয়াঙের সঙ্গে সঙ্গে সেও বড় হতে থাকে।

শিয়াঙের স্কুল যাওয়ার সময় শিম্বা তাকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। তারপর যখন শিয়াঙ তাকে বলে, ‘যা শিম্বা, এবার বাড়ি যা।’ সে শোনামাত্রই দাঁড়িয়ে পড়ে। বুঝে যায়, আর এগোনো যাবে না। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় বন্ধুকে দেখতে থাকে। ঠিক একই কাণ্ড করে সে শিয়াঙের বাড়ি ফেরার সময়।
স্কুল থেকে ফিরে বাবা না থাকলেও শিয়াঙের আর একা লাগে না। দিব্যি দুটোতে মিলে সময় কেটে যায়।
বছর ঘুরে গিয়ে আরও একটা বর্ষা আসে। বর্ষার সময় পাহাড়ের শান্ত রূপটা কেমন যেন বদলে যায়। বৃষ্টির দাপটে মাঝে মাঝে শিয়াঙের স্কুল কামাই হয়ে যায়। তখন সে বাড়িতে বসেই লেখাপড়া করে। পাশে বসে থাকে শিম্বা। তাদের কাঠের দোতলা বাড়ির একতলাতে সে শিম্বাকে নিয়ে থাকে। আর তাদের বাবা দোতলাতে থাকেন।

সেদিন সারাদিন ধরে বৃষ্টি চলেছে। রাতেও এক নাগাড়ে বৃষ্টি চলছিল। শিয়াঙ শিম্বাকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিল। মাঝরাতে শিম্বা হঠাৎ ডাকতে শুরু করে। সে ভীষণ ছটফট করতে থাকে। সামনের দু’পা দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। একসময় শিম্বার ডাকাডাকিতে শিয়াঙের ঘুম ভেঙে যায়। সে শিম্বাকে দেখে অবাক হয়। কারণ শিম্বাকে এমন অস্থির হতে, এমন অদ্ভুতভাবে চিৎকার করতে সে কখনোই দেখেনি। সে দেরি না করে বাবাকে জাগিয়ে তোলে। তার বাবা নিচে এসে শিম্বা যেখানে ডাকাডাকি করছিল সেই জায়গাটা ভালো করে দেখতে থাকেন। দেখেন দেওয়ালের গায়ে বিশাল একটা ফাটল ধরেছে। আর সেই ফাটল দিয়ে ঘরের ভেতরে জল ঢুকছে। তিনি তৎক্ষণাৎ দরজাটা খুলে ফেলেন। বাইরে বেরিয়ে তো অবাক! বিপাশার জল হু-হু করে গ্রামে ঢুকছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তো এই মাঝরাতে সবাই ঘুমন্ত। শিয়াঙের বাবা বুঝতে পারেন ভয়ঙ্কর বিপদ হতে চলেছে। তিনি ছেলেকে বললেন, ‘তুই শিম্বাকে নিয়ে ও-ই উপরের ঢালে চলে যা। মন্দিরে গিয়ে থাক। আমি এদিকটা দেখছি।’ সে বাবাকে বলল, ‘বাবা তুমি ওদিকটা দেখো। আমি এদিকটায় মানুষজনকে জাগাতে জাগাতে যাচ্ছি।’

শিম্বার ডাকা কিন্তু বন্ধ হয়নি। শিম্বাকে নিয়ে এগোতে থাকে শিয়াঙ। আর একটি করে বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চেঁচাতে থাকে, ‘জাগো জাগো… ভাগো… ভাগো… ভাগো…, বিপদ…!’

সঙ্গে সঙ্গে শিম্বাও গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে, ‘ভৌ ভৌ… জাগো জাগো… পালাও। সামনে বিপদ… ভয়ঙ্কর বিপদ!’

সিয়াথি গ্রামের সর্বমোট কুড়িটি পরিবার। একের পর এক বাড়িতে জাগাতে জাগাতে শিয়াঙের বাবা হঠাৎ যখন ওপরের দিকে তাকান, দেখেন পাহাড়টা যেন তাদের মাথার উপর নেমে আসছে। এতক্ষণ জল ঢুকছিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টির তোড়ে ধস নেমেছে। গ্রামে প্রায় সত্তর জন বাসিন্দা, মুহূর্তে তাদের সবকিছু ফেলে প্রাণটা নিয়ে কোনোরকমে প্রাণপণে উপরের ঢালে পৌঁছয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের সামনে তাদের ভালোবাসার সিয়াথি গ্রামটা তলিয়ে যায় জলের তলায়। সবকিছু হারিয়ে শুধু তাদের প্রাণটুকু ফিরে পাওয়ার জন্য তারা করুণভাবে তাকিয়ে থাকে শিম্বার দিকে। তারা এতক্ষণে জেনে ফেলেছে এ বিপদের আঁচ সর্বপ্রথম পেয়েছিল শিম্বা। সেই তো প্রিয় বন্ধুকে, তার বাবাকে প্রথম ঘুম ভাঙিয়েছিল। না হলে আজ গোটা গ্রাম আর গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে এতগুলো প্রাণও রাতের অন্ধকারে জলের তলায় তলিয়ে যেত।

দুর্যোগের রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফোটে। গ্রামের মানুষজন শিম্বাকে কোলে তুলে নিয়ে নাচতে থাকে। গ্রামের মোড়ল এতক্ষণ দূরে নীরবে বসেছিলেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন। শিম্বাকে কোলে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, ‘তুই হিরো, তুই আমাদের হিরো। তোর জন্যই তো গোটা গ্রামের মানুষ আজ বেঁচে আছে!’

শিম্বা ঘনঘন লেজ নেড়ে আর মুখে কুঁইকুঁই শব্দ করে বলে, ‘আমিও তো এই গ্রামেরই একজন, তাই না!’
আজ শিয়াঙ ও তার বাবার বড় গর্বের দিন। সত্যিই তো তাদের শিম্বা আজ প্রকৃত হিরোর মত কাজ করেছে।

Advertisement