• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 July, 2025

মাঠ পাহারা

সূর্য আজ গুলতি থেকে গুলি ছুঁড়ে ঠিক নিশানায় লাগাতে পারেনি, সে তো খানিকটা যেন ইচ্ছে করেই, সে তো আর ওঝাখুড়ো জানে না।

কাল্পনিক চিত্র

সুব্রত সরকার

সূর্য আজ স্কুলে যায়নি। ফাইভ থেকে সিক্সে উঠেছে সূর্য মাড্ডি। সাঁওতাল পাড়ার সবাই এখন রোজ স্কুলে যায়। কবিতা টুডু আগে যেত না। খুব কামাই করত। মিছা কথা বলত, ‘আজ পেট ব্যথা, তাই যাইনি।’ কোনোদিন বলত, ‘স্কুলের জামা খুঁজে পাইনি, তাই যাইনি।’ কিন্তু কবিতাও এখন স্কুল কামাই করে না। স্কুলে একজন নতুন মাস্টার এসেছে, স্কুলে না গেলেই বাড়ি চলে আসে। সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে ঘুরবে সাঁওতাল পাড়ায়। ‘চল, স্কুলে চল।’ না গেলে এমন করে ধরে নিয়ে যায়। ওই মাস্টারের নাম কানাই সোরেন। মাস্টার বলে, ‘আমাদের পড়া লিখা শিখতেই হবে। আর কতদিন তোরা বোকা বনে থাকবি রে! দিকুদের মত এগিয়ে যেতে হবে তো নাকি?’

সূর্য আজ মাঠ পাহারা দিচ্ছে। বাপ গেছে রসুলপুরের হাটে ছাগল বেচতে। ওদের বাড়ির উঠোনে হাঁস, মুরগি, ছাগল আছে। আগে চাষের জন্য দুটো তাগড়াই বলদও ছিল। একদিন রাতের অন্ধকারে বলদদুটো চুরি হয়ে গেল। সাঁওতাল পাড়ায় চুরি করার সাহস কেউ পায় না। চোর সেদিন বাইরে থিকে এসেছিল, একথা গাঁয়ের সবাই আজও বলে। সূর্যর মা লজে কাজ করে। আজ লজে বাবুদের খুব ভিড়। মা তাই সকাল-সকাল চলে গেছে বনপলাশী লজে।

সূর্যদের মাঠে এখন শসা হয়েছে। পুকুরপাড়ের আম বাগানে অনেক পাকা আম। কলা গাছে কলা। আম, শসা, কলা বিক্রি করে পয়সা হয়। সূর্যর বাবা তো চাষী। চাষ করেই পয়সা যোগাড় করে। পাইকাররা ঘরে এসে কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু এখন এই গ্রামে হনুমানের দল আসা শুরু করেছে। ওরা কতদূর দূর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আসছে। জমির শসা, আম, কলা খেয়ে চলে যায়। তাড়াতে না পারলে সব খেয়ে নেয়। নষ্টও করে অনেক। সূর্যকে তাই ওর বাপ আজ মাঠ পাহারা দিতে বলে হাটে গিয়েছে।

সূর্য গুলতি নিয়ে কাঁঠাল গাছের ছাওয়ায় বসে আছে। পেয়ারা গাছের কাঠ দিয়ে বানানো খুব ভালো গুলতি। সূর্যর বাবা গুলতিটা বানিয়েছে হনু খেদাবার জন্যই। সূর্য সেই গুলতিটা নিয়ে মাঠ পাহারা দিচ্ছে। হনুর দল এলে গুলতি ছুঁড়ে ওদের ফেরত পাঠাবে জঙ্গলে। ‘এখানে কেন আসবি তোরা? জঙ্গলে থাকবি। জঙ্গলে খাবি।’ সূর্য মনে মনে এসব ভাবে। আর মাঠ পাহারা দেয়, বাবার কথামতো।

ঘড়িতে এখন কটা বাজে কে জানে। তবে এটা স্কুলের টিফিনের সময় সূর্য বুঝতে পারে। এই সময় স্কুলে মিড ডে মিল দেয়। সবাই থালা নিয়ে লাইন দিয়ে খাবার নেয়। খুব মজা করে খায়, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে। আজ তো সূর্য স্কুলে যায়নি, তাই মিড ডে মিল পেল না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখাও হলো না। আজ হনুদের সঙ্গে দেখা হতে পারে।

লাল মাটির রাস্তা দিয়ে কে যেন সাইকেল চালিয়ে আসছে। কে বটে!… চিনা চিনা লাগে! সূর্য ভাবতে ভাবতেই বুঝে যায়, আরে এ তো কানাই স্যার। সূর্য লুকোতে চায়। জায়গা খুঁজে পায় না। স্যার চলে এসেছে কাছে। সূর্য তো ভয়ে কাঁপছে। মুখ নামিয়ে গুলতিটা লুকিয়ে ফেলে পকেটে।

‘হ্যাঁরে, আজ যাসনি কেন স্কুলে?’ কানাই স্যার সাইকেল থেকে নেমে বললেন, ‘আজ ম্যাপ দেখিয়ে দেখিয়ে কত সুন্দর ক্লাস করালো সুরসী ম্যাম। জীবন স্যার পরিবেশ পড়ালো। ভালো ক্লাস দুটো মিস করলি তো!’

সূর্য চুপ করে থাকে। কেন যায়নি, কী বলবে ভাবতে ভাবতেই স্যার বললেন, ‘মাঠ পাহারা দেওয়া তোর কাজ? আরে হনুদেরও তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে। জঙ্গলে কিছু পায় না বলেই লোকালয়ে আসে, একটু ফলমূল খেয়ে পেট ভরিয়ে চলে যায়। দুটো খাক না। তুই পড়া বন্ধ রেখে হনু তাড়িয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিস কেন? চৌকিদার হয়ে কী করবি!’

স্যার এবার সাইকেলে উঠে বললেন, ‘আমি যাই। টিফিনের টাইম শেষ হয়ে এল। কাল থেকে স্কুলে আসবি কিন্তু।’
কানাই স্যার সাইকেল নিয়ে চলে গেলেন মাঠ পেরিয়ে স্কুলের দিকে। স্যার এখন স্কুলে গিয়ে ক্লাস নেবেন। সূর্য পকেট থেকে গুলতিটা বের করে ভাবে, ‘হনুদের খাবার নেই কেন জঙ্গলে? সত্যি তো ওদেরও খিদে পায়। কিন্তু ওদের তো আর কেউ মিড ডে মিল দেয় না!’

এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল হনুর দল আসছে ওদের খেতের দিকে। ছোট বড় মিলিয়ে পাঁচ-ছটা হনুমান। বড় বড় লাফ মেরে ছুটে আসছে। দেখলেই কেমন ভয় করে। সূর্য তবু ভয় পেল না। গুলতিতে গুলি লাগিয়ে টিপ ঠিক করল, তারপর ছুঁড়ে দিল গুলি। গুলিটা কেমন উড়ে চলে গেল অন্যদিকে। হনুদের গায়ে লাগল না। হনুরা মনের আনন্দে শসা খাচ্ছে। পাকা আম খাচ্ছে। সূর্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের খাওয়া। গুলতি থেকে গুলি ছুঁড়তে কেমন ভুলে গেল। গুলতিটা হাতেই ধরা আছে। পকেটে অনেক গুলি। তবু সূর্য গুলতি থেকে গুলি ছুঁড়তে পারে না। এমন সময় মাঠের পাশ দিয়ে সাঁওতাল পাড়ার ওঝাবুড়ো যাচ্ছিল। সূর্যকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘কীরে সূর্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস যে, মার, গুলি মার কেনে!’

সূর্য গুলতিতে গুলি লাগিয়ে আবার টিপ করে গুলি ছুঁড়ল, এবারও গুলি কেমন অন্যদিকে চলে গেল। ওঝাবুড়ো রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘তুই সাঁওতাল পাড়ার বেটা হয়ে গুলি ছুঁড়তে শিখিসনি রে। কেমন বেটা বটে তুই!’

সূর্য আজ গুলতি থেকে গুলি ছুঁড়ে ঠিক নিশানায় লাগাতে পারেনি, সে তো খানিকটা যেন ইচ্ছে করেই, সে তো আর ওঝাখুড়ো জানে না।