• facebook
  • twitter
Friday, 13 December, 2024

বাহক

অপালা বলল, “সত্যি কত কী অজানা থেকে যায় আমাদের, তাই না! টেস্ট না করালে জানতেই পারতাম না এসব। জানো শৈবাল, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। ভাবো তো, কী হত যদি আমরা দুজনেই…”

কল্পিত চিত্র

তথাগত চট্টোপাধ্যায়

সেমিনার হলের সাদা পর্দায় প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে কয়েকটি সারণী এবং লেখচিত্র।
প্রসারিত করে ডা. গৌরী মুখার্জি বললেন, “বড় হয়ে উঠতে উঠতেই ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেবে এই রোগের ভয়াবহতা। হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পোষাতে নিয়মিত রক্ত দিতে হবে। সে এক গভীর যন্ত্রণা। তবে আমি আবার রিপিট করছি যে, রোগটি কিন্তু উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত এবং বাবা, মা দুজনেই যদি এ রোগের বাহক হন তবেই নবজাতকের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সেটা শতকরা পঁচিশ ভাগ। যে কোনও একজন বাহক হলে এবং অপরজন বাহক না হলে শিশুর শরীরে কোনও প্রভাব পড়বে না।’’

সেমিনারে অপালা, শৈবাল দু’জনেই উপস্থিত। ডা. মুখার্জিই ওদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁর সাবলীল, নিরবিচ্ছিন্ন বাচনভঙ্গি এবং উপস্থাপনার গুনে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে খুঁটিনাটি বক্তব্য শুনছিল ওরা। সেমিনার হলে পিনড্রপ সাইলেন্স।

ডা. মুখার্জি তাঁর বক্তব্যের প্রায় শেষের দিকে পৌঁছে গেছেন। মাঝের দেড় ঘন্টা যে কীভাবে পার হয়ে গেল টেরই পায়নি অপালা। শৈবালও মোহিত ওঁর বিস্তারিত প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যায়। আরও দুই একটি প্রয়োজনীয় কথা বলে ডা. মুখার্জি তাঁর সহকারীকে বন্ধ করতে বললেন ল্যাপটপ এবং প্রোজেক্টর।

একদম শেষের ঘরে চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা রয়েছে। অপালা, শৈবাল সেমিনার হল থেকে বেরিয়ে করিডোর বরাবর হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল সেখানে।

শহরের একটি নামি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে স্থানীয় এক বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই থ্যালাসেমিয়া সংক্রান্ত এই সেমিনারের আয়োজন। বিদ্যালয় ভবনের পাশেই উঁচু পাঁচিলে ঘেরা মাঠে আয়োজক সংস্থার কর্তাব্যাক্তিদের ভিড়। সংস্থাটি যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং দেশব্যাপী নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছে। সেমিনারের পাশাপাশি ছোটোদের জন্য বসে আঁকো প্রতিযোগিতাও হচ্ছে।

মাঠের একধারে অস্থায়ী মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে, “একটু পরেই ছোটোদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যাবে। আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. গৌরী মুখার্জি। কিছুক্ষণ পরেই তিনি মঞ্চে আসবেন”।

কাগজের কাপ হাতে নিয়ে অপালা চেয়ারে বসল। বাঁদিকে বড় জানালা। চায়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে তাকাল জানালার বাইরে। বিকেল বিকেল ভাব হয়ে আসছে। দূর আকাশে দেখা যাচ্ছে কেটে যাওয়া একটা ঘুড়ি। হাওয়ায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে দৃষ্টির বাইরে।

একটু পরেই হইহই করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। আঁকা প্রতিযোগিতা শেষ। অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের মধ্যে তুমুল হুড়োহুড়ি।

অপালা চোখ সরায়। নিষ্পলকে দেখতে থাকে ছুটোছুটি করতে থাকা বাচ্চাদের। তাদের সকলের চোখেমুখে অকৃত্রিম আনন্দের ছবি, হাসিতে নিষ্পাপ পবিত্রতার ছোঁয়া। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অভিভাবকদের ভিড়ে নিজেকে খুঁজে পায় সে। যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। একটু পরেই কেউ ‘মা’ বলে ছুটে এসে ছোট্ট হাতটা বাড়িয়ে দেবে তার দিকে। বলবে, “ব্যাগটা ভীষণ ভারী মা। তুমি ধর না”। অপালা তক্ষুনি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলবে, “কি আঁকলে? ওয়াটার কালার তো তুমি এখনও পারই না ঠিকমত। ভালো করে এঁকেছ সোনা”?

কল্পনার আরও গভীরে ঢুকতে থাকে অপালা। আশেপাশের আওয়াজ, পাশের মাঠ থেকে ভেসে আসা উদ্যোক্তাদের ঘোষণা, কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। ভিড়ের মধ্যে তার ছোট্ট সোনাকে উদ্দেশ্য করে সে বলছে, “অত জোরে দৌড়িও না। পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবে”…
ঠিক তখনই বাস্তবে ফেরে অপালা। অনুভব করে একটা ব্যাথা। চোখের কোল, মাথার দুপাশ দিয়ে শুরু হওয়া খুব পরিচিত যন্ত্রণা। অনুরূপ ব্যাথা কোমরেও। প্রতিবারই পিরিয়ড হওয়ার আগে এমনটা হয়। স্বাভাবিক শোণিতপ্রবাহ শুরু হলে ধীরে ধীরে চলেও যায় নিজের নিয়মে। কিছুদিন হল সেই অনুভূতি আবার শুরু হয়ে গেছে তার। অপালা জানে এর নিশ্চিত পরিণাম।

ডাক্তার গৌরী মুখার্জি, এম.ডি. গাইনিকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স। দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম সেরা গাইনোকোলজিস্ট— অনেকেরই ভরসার জায়গা। পাঁচ বছর শৈবালের সঙ্গে কোর্টশিপ শেষে বিয়ের সময় অপালা আঠাশ ছুঁই ছুঁই, শৈবাল তিরিশ। এর বছর দেড়েক পর থেকেই অপালা বুঝতে পেরেছিল সে কনসিভ করতে পারছে না। শৈবাল বা অপালা কারোর পক্ষ থেকেই চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অধরাই থেকে যাচ্ছে।

ডাক্তার মুখার্জি বলেছিলেন, শৈবালের সিমেন টেস্ট একদম স্বাভাবিক। যন্ত্রণাদায়ক হিস্টেরোস্যালপিনোগ্রাম পরীক্ষায় অপালার ফ্যালোপিয়ান টিউবেও কোনও ব্লকেজ ধরা পড়েনি। তবে কেন যে নতুন প্রাণ সঞ্চারে বার বার বাধা আসছে সে এক গভীর রহস্য!
ডাঃ মুখার্জি বলেছিলেন, ‘‘আপনাদের বোধহয় থ্যালাসেমিয়া টেস্টটা করা নেই, তাই না”?
“না”। শৈবাল বলেছিল, “ওটা কি করাতেই হবে”?

“নিশ্চয়ই। বিয়ের আগেই নির্ণায়ক পরীক্ষাটা করানো উচিত ছিল আপনাদের। আমরা সকলেই এই ভুলটাই করি। কোষ্ঠী বিচার করি অথচ হাতের কাছে একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে এই পরীক্ষাটা করাই না। ভাগ্য খারাপ থাকলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে নেক্সট জেনারেশনের ওপর। আপনারা বেবি চাইছেন অথচ সাকসেসফুল হতে পারছেন না। কিন্তু সফল হওয়ার পর যদি দেখা যায় নবজাতক থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত তাহলে কষ্টের শেষ থাকবে না শৈবালবাবু। তাই আগে আপনারা দুজনেই টেস্টটা করিয়ে নিন। রিপোর্ট হাতে পেলে আমাকে জানাবেন। আর একটা অনুরোধ করব— সতেরো তারিখে টালিগঞ্জে একটা সেমিনারে থাকছি, বিষয় থ্যালাসেমিয়া। রবিবার, আশা করি তেমন কোনও গুরুত্বপুর্ণ কাজ থাকবে না আপনাদের। আসুন না, সেমিনারে উপস্থিত থাকলে অনেক কিছু জানতে পারবেন যা আমরা অনেকেই জানিনা”।

চেয়ারে হেলান দিয়ে এইসব পুরনো কথাই ভাবছিল অপালা। শৈবালের হাতের স্পর্শে সংবিৎ ফেরে তার।
“হল তোমার চা খাওয়া? এবার ফিরতে হবে তো”।


পরদিনই দুপুরে স্কুলের ওয়াশরুমে গিয়ে অপালা নিশ্চিত হয়ে গেল। তার আশঙ্কাই সত্যি। শুরু হয়ে গেছে শোণিতপ্রবাহ। বেসিনের কল খুলে চোখে, মুখে ভালো করে জলের ঝাপটা দিয়ে হিসেব করে বুঝল মাঝখানে পঁয়ত্রিশ দিনের ব্যবধান। স্থান এবং কাল এই মুহূর্তে তাঁর ঘোর অস্বস্তির কারণ। সঙ্গে একটাও স্যানিটারি প্যাড নেই। সকালে বেরনোর সময় তাড়াহুড়োয় ভুল করে গোটা প্যাকেটটাই ওয়ার্ডরোবে রেখে এসেছে সে। শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে চোখ মুখ মুছে নিল অপালা। তারপর টিচার্স রুমে ফিরে না গিয়ে বড়দির ঘরের দিকে গেল।
অলোকা সেনগুপ্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন, অপালাকে দেখে ইঙ্গিতে সামনে রাখা চেয়ারে বসতে বললেন।

“কিছু বলবি? অলোকা জিজ্ঞেস করলেন”, ক্লাস অফ্‌ নাকি এখন?”
বড়দি অলোকার ফোনে কথা শেষ। জানালার দিক থেকে চোখ ফেরায় অপালা। অজান্তেই বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।
“এই পিরিয়ড অফ্‌। পরেরটা ইলেভেনের কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিকাল”।
“নিবি না ক্লাস, বাড়ি চলে যাবি”?

“না না নেব। আসলে আমি একটা অন্য দরকারে এলাম আপনার কাছে”।
“কী ব্যাপার রে”?
আপৎকালীন অবস্থা সামাল দিতে অলোকা সেনগুপ্ত আলমারিতে স্যানিটারি প্যাডের প্যাকেট রাখেন। একটা প্যাড অপালার হাতে দিয়ে বললেন, “এবার একজন ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নে। দমদমে বসেন ডক্টর অসীম বেরা। ইনফার্টিলিটির বিষয়ে একজন এক্সপার্ট। অনেকদিন আগেই তোকে বলেছিলাম। আমার কথাটা শোন এবার অপালা। মনে রাখিস বয়সটা কিন্তু বাড়ছে তোর”।
“কিন্তু…”
“আবার কিন্তু কি”?

“কোন ডাক্তারের কাছে কার ক্লিক্‌ করবে তা কি কেউ জানে? ডক্টর গৌরি মুখার্জিরও তো অনেক নাম ডাক। সাকসেসফুললি হ্যান্ডেল করেছেন এরকম কত কেস্। চিকিৎসা তিনি সবে শুরু করেছেন, এখনই সরে আসি কী করে? ওঁকেও তো সময়টা দিতে হবে”।
“হুঁ, তা ঠিকই, তবে একটা সেকেন্ড ওপিনিয়নও পাশাপাশি নেওয়া উচিত। ডোন্ট অ্যালাও এনি ফ্রাস্ট্রেশন টু প্লে। দেখিস ভগবান মুখ তুলে চাইবেন একদিন। হয়তো কিছুদিনের অপেক্ষায় রেখেছেন তোদের।”

অপালা কেমিস্ট্রি ল্যাবে গেল। কিন্তু বিভিন্ন বিকারকের রাসায়নিক ক্রিয়ায় উদ্ভুত গন্ধে মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ল।
ঝাঁঝালো গন্ধে অস্বস্তি হতে থাকে অপালার। চোখের কোল, মাথা হয়ে ব্যাথাটা ছড়াচ্ছে ঘাড়ের দিকে। তবে সে জানে দিন দুয়েকের মধ্যেই কমে আসবে সব ব্যাথা। থেকে যাবে শুধু মনের যন্ত্রণাটা।


স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে রোজই বেশ দেরি হয় অপালার। বেশিরভাগ দিনই হয় ট্র্যাফিক জ্যাম নতুবা বাসের জন্য অপেক্ষা। বাড়ি ফিরতেই শরীর জুড়ে নেমে আসে ক্লান্তি। আজ বাড়ি ফিরে সে বুঝল মনের ক্লান্তি যেন ছাপিয়ে যেতে চাইছে অন্য সবকিছু।

সেক্টর ফাইভ থেকে বেরোতে বেরোতে শৈবালেরও দেরি হয়। পুরোদস্তুর কর্পোরেট কালচার আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তাকে। কিন্তু আজ শৈবাল একটু তাড়াতাড়িই ফিরল অফিস থেকে। ওয়াশরুমে গায়ে একটু জল ঢেলে ঠাণ্ডা হয়ে টিভিটা চালিয়ে বসতে বসতে না বসতেই অপালা শৈবালের নিজস্ব ঢঙে বাজানো কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল।

বারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে অপালা। দেওয়ালে দামি অ্যাক্রিলিক পেন্টের সঙ্গে মানানসই ফলস্‌ সিলিং, এলইডি ল্যাম্প আর ফ্লোর টাইলস্‌। ব্যাল্কনিতে টবে সাজানো বাহারি ফুলগাছ, মানিপ্ল্যান্ট। শৈবাল অফিস থেকে বছরে একবার ফার্নিচার কেনার টাকাও পায়। দু’জনের রোজগারে অর্থের অভাব টের পায় না তারা। শুধু অনুভব করে অন্য একটি অভাব। কিন্তু সেই শূন্যস্থান কবে ভরাট হবে কেউই বুঝতে পারছে না।

ব্যালকনিতে এসে চায়ের কাপে চুমুক দেয় শৈবাল। অপালা কখন যেন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি শৈবাল। কাঁধে অপালার আলতো স্পর্শে ঘুরে তাকায় সে।
“চা –টা ফাইন হয়েছে”।
অপালা চুপ। শৈবালের মনে হচ্ছে ও কিছু বলতে চায় অথচ পারছে না।
“কী হল? কিছু বল। হয়েছেটা কী”?
“খুব চিন্তা হচ্ছে শৈবাল। ভালো লাগছে না কিচ্ছু”।
“আর ভেবো না অত। যা হবার তা তো হবেই। যেটা আমাদের হাতের বাইরে তার ওপর কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করব”?
“তবুও, খালি মনে হচ্ছে…যদি আমরা দুজনেই থ্যালাসেমিয়ার ক্যারিয়ার…মানে, তাহলেতো…”
অপালা ভাঙছে। গভীর উৎকণ্ঠায় কণ্ঠ কেঁপে যাচ্ছে তার। বার বার পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে অপালার আকাঙ্ক্ষা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে থ্যালাসেমিয়া টেস্টের টেনশন। ফলে চাপা একটা উদ্বেগ ঘিরে রেখেছে দুজনকেই।

শৈবাল বলল, “রিপোর্টটা তো আগে পাই, দেখি কী রেজাল্ট আসে, ডাক্তার মুখার্জি কী বলেন…”
“আমরা দুজনেই যদি রোগটার ক্যারিয়ার হয়ে যাই, তাহলে এই এতদিনের চেষ্টা দুম করে বন্ধ করে দেওয়ার একটা উপযুক্ত অজুহাত খাড়া করা যাবে। কি, শৈবাল, অ্যাঁ, তাইতো? যে আশা নিরাশার দোলায় দুলছি আমরা, তা থেকে পাকাপাকিভাবে একটা লজিকাল এক্সিট হাতে আসবে”।
“আঃ, ব্যাপারটা এভাবে দেখো না তো”।
“আর কীভাবে দেখব বল”?
“আমাদের দুজনেই ক্যারিয়ার হব এমন তো নাও হতে পারে। তখন কি আমরা সন্তানের আশা ছেড়ে দেব? কিন্তু যদি সত্যিই আমরা দুজনেই রোগটার বাহক হই, তাহলে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে অপালা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সুস্থ, স্বাভাবিক সন্তানের বদলে যদি বিপজ্জনক রোগের সম্ভাবনা নিয়ে একটি শিশুর জন্ম হয় তাহলে কী হবে ভাবো। ডাক্তার মুখার্জি তো সেই কথাই বলতে চাইছেন”।


কয়েক দিন পর।
ডা. মুখার্জির দৃষ্টি নিবদ্ধ উল্টো দিকের চেয়ারে বসা দম্পতির দিকে। তিনি বললেন, “তিন মাসের ওষুধের একটা কোর্স দিচ্ছি অপালার জন্য। তারপর আমি আবার দেখব। হতে পারে আপনাদের কেসটা ‘আনএক্সপ্লেইন্ড ইনফার্টিলিটি’। কিন্তু এখনই ভাবছি না সেসব। চেষ্টা করে দেখি না শেষ পর্যন্ত কী হয়।’’

ডা. মুখার্জির ব্যবহারে, আচরণে, সুললিত কণ্ঠস্বরে যেন অগাধ প্রেরণা। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে সুন্দর একটি হাসি ছড়িয়ে দিলেন তিনি। বললেন, “নাও, থিংক পজিটিভ। এবার থেকে নিজেদের আবিষ্কার করুন নতুনভাবে। ঘুরতে চলে যান পাহাড়, জঙ্গল বা সমুদ্রতীরবর্তি কোনও জায়গায় অথবা যেখানে আপনাদের মন চায়। নতুনভাবে এক্সপ্লোর করুন নিজেদের। দত্তক নেওয়া বা কৃত্রিম পদ্ধতির রাস্তা তো সবসময় খোলা। কিন্তু আমি চাই স্বাভাবিক নিয়মের পথ ধরেই একটি সুস্থ সন্তান আসুক”।

নিদারুণ উৎকণ্ঠা আর রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর গতকাল বিকেলে ই-মেলে টেস্ট রিপোর্টের পিডিএফ ফাইলটা এসেছে।
রক্ত পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়ে গেছে যে শৈবাল, অপালা দুজনের কেউই থ্যালাসেমিয়ার বাহক নয়।
ডা. মুখার্জি বললেন, “আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, এরকম ক্ষেত্রে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজেই টেনশনমুক্ত হয়ে নতুনভাবে ভাবুন”।


ক্লিনিক থেকে বেরোতে বেরোতে বেলা গড়িয়ে গেল অনেকটাই। আকাশে নরম নরম আলোয় ভরপুর রঙের খেলা। শৈবাল, অপালা— দুজনেরই মনে হচ্ছে একটা রুদ্ধশ্বাস যাত্রার বেশ কিছুটা পথ যেন এইমাত্র অতিক্রম করে এল তারা।
অপালা বলল, “সত্যি কত কী অজানা থেকে যায় আমাদের, তাই না! টেস্ট না করালে জানতেই পারতাম না এসব। জানো শৈবাল, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। ভাবো তো, কী হত যদি আমরা দুজনেই…”
“তুমিও তো একজন বাহক”।

শৈবালের কথায় চকিতে ফিরে তাকায় অপালা।
“মানে? কী বলছ তুমি?”
“কথাটা ভিন্ন অর্থে অপালা। আসলে আমি বলতে চাইছি তুমিও তো মাতৃত্বের বাহক। নিজের অন্তরে একজন মাকে বহন করে চলেছ তুমি। সব নারীর মধ্যেই একজন মা লুকিয়ে আছে। তুমি কি তার বাইরে? অবচেতনে কি বহন করে চলছ না একজন মাকে?”
হাসল অপালা। ফিসফিসিয়ে বলল, “সো ফিলোসফিক্যাল!’’

মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। অপালার মনে হয়, শৈবালের কথাগুলো বাতাসে ভর করে কোন এক সুদূর থেকে নিয়ে আসছে বহু আকাঙ্ক্ষিত সুখের নির্যাস। তবুও কোথাও যেন আত্মগোপন করে আছে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস যা তাকে প্রায়ই অস্তিত্বহীনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
যেতে যেতে রাস্তার একটা ক্রসিঙের সামনে এগিয়ে এসেছে ওরা। সিগন্যাল লাল। অপেক্ষমাণ শৈবাল-অপালা। দাঁড়িয়ে আছে সিগন্যালের সবুজ আলোর প্রত্যাশায়। পাশাপাশি। কাছাকাছি। একজনের বাঁ হাত স্পর্শ করে আছে আরেকজনের ডান হাত।