• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

শব্দ রহস্য

একবারও ভাবিনি যে হাতিগুলো গন্ধে গন্ধে তা খেতে হাজির হবে। তবে চিন্তা করবেন না। পটকা ফাটাবো এবার। ফরেস্ট অফিসেও ফোন লাগিয়েছি। ওঁরা এই এল বলে।

অঙ্কিত চিত্র

আনন্দদীপ চৌধুরী

চারিদিকে বেশ ভালোই অন্ধকার। যদিও বা একফালি সরু কাটা কুমড়োর মত চাঁদ উঠেছে আকাশে, কিন্তু জঙ্গলের হামলে পড়া আঁধারের কাছে অনায়াসেই ম্রিয়মাণ হয়েছে অশীতিপর সে চন্দ্রালোক।

Advertisement

এরকম এক অন্ধকার পরিবেশেই বনবাংলোর দোতলার বারান্দায় আড্ডা বসেছে আমাদের। আড্ডার কলকাকলি শুনে কে বলবে সংখ্যায় আমরা তিনজন? সত্যি সুশোভন আর সাত্যকি যদি শেষ মুহূর্তে ছুটি না পেত অনিন্দ্যসুন্দর এ ট্যুরটা বাতিল হত নির্ঘাত।
একটু আগেই রাতের খাবারটা খেয়েছি আমরা। কী স্বাদ সে খাবারের! আহা! সবই ওই কেয়ারটেকার ছেলেটির বদান্যতায়।

Advertisement

আসলে কেয়ারটেকার এই ছেলেটি বেশ যত্নপরায়ণ। আমাদের সযত্নে খাইয়ে দাইয়ে একতলার ঘরে শুয়ে পড়েছে এখন। তবে তার আগে ইয়া বড় দুটো সার্চলাইট ধরিয়েছে হাতে। বলেছে— ‘রাতের অন্ধকারে সামনের মাঠে রাখা নুনের ঢিবিতে নানারকম জন্তু আসে দাদা। সার্চলাইটটা ফেললে পরিষ্কার দেখতে পাবেন ওদের।’

কিন্তু সার্চলাইট মারার ফুরসত পেলে তো! পুরানো তিন স্কুল-বন্ধুর এতদিন পর দেখা। কত না বলা গল্প, আড্ডা জমে আছে যে। সেসব উদগীরণ না করলে যে ট্যুরটাই বিফল হবে পুরোপুরি। আড্ডার মাঝে মাঝে সাত্যকি অবিশ্যি গেয়ে চলেছে পুরানো কিছু বাংলা গান। গ্রীষ্মকাল হওয়ায় বাইরের খোলা হাওয়ায় সেসব শুনতেও লাগছে বেশ। আর ভয়? না, তা লাগছে না খুব একটা। তবে মাঝে মধ্যে বুনো শুয়োর আর গণ্ডারের ডাকে একটা শিহরণ হচ্ছে শরীরে।

ঘন্টাদুয়েক পরে গান-আড্ডার পাট চুকিয়ে ঘুমাতে গেলাম আমরা। একটা ঘরে তিনটে সিঙ্গল বেড থাকায় তিনজনেই থিতু হলাম একসঙ্গে। ঘুমানোর সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকা শুরু হল সুশোভনের। সেই সুরে সুর মেলালাম আমিও।

ঘুমটা ভাঙল হঠাতই, পিঠে পড়া হালকা চাপড়ে। স্বপ্ন-টপ্ন বোধ হয়! পাশ ফিরে শুতে গেলাম ফের। না সাত্যকির মিহি গলা কানে এল আমার— ‘কিরে ওঠ! দেখ কে জানি বাংলোর দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।’ ঘুমটা চটকে গেল একনিমেষে। উঠে পড়তেই বুঝলাম কেবল দরজা নয়, বাংলোর একতলার দেওয়ালগুলোতেও অনাহুত কোনো অতিথি তার সবান্ধব উপস্তিতি জানান দিচ্ছে। ভয় পেয়ে গেলাম বেশ। সাত্যকি ততক্ষণে ডেকে তুলেছে ঘুমখেকো সুশোভনকেও। এমন শব্দ শুনে থতমত খেয়েছে বেচারাও। সাত্যকি বলল— ‘বারান্দায় যাব না। জানলা দিয়ে দেখি চ।’

সাহস আছে সাত্যকির! বলে কি না জানলার কাঁচ দিয়ে দেখবে। সাহস হল না আমার। মাথায় কেবল ঘুরছে চাঁদের পাহাড় সিনেমায় শঙ্করের ঘরের চারপাশে সিংহের বিচরণের দৃশ্যটা। আচ্ছা! যদি সিংহ না হয়ে বাঘ হয়! শব্দ শুনে মনে হচ্ছে একটা নয়, অনেকগুলো। শেষে কিনা বাঘের পেটে…! ইস! কেন যে অ্যাডভেঞ্চার করতে থাকতে গেলাম বনবাংলোয়।

সপাটে ফের দড়াম করে শব্দ হল একতলার সদর দরজায়। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম আমি আর সুশোভন। শব্দ রহস্যের দিশা খুঁজতে সাত্যকি রিং করল কেয়ারটেকার ছেলেটিকে।

—‘বলুন দাদা।’ ছেলেটির গলা এল ফোনের ওপারে।
—‘ভাই, সদর দরজায় এক রাতে কীসের শব্দ?’
—‘হাতির।’
—‘অ্যাঁ! হাতি!’
—‘ভুল হয়ে গেছে দাদা। আসলে বাংলোর গাছে হওয়া গোটা দশেক কাঁঠাল রেখেছিলাম একতলার স্টোর-রুমটায়। একবারও ভাবিনি যে হাতিগুলো গন্ধে গন্ধে তা খেতে হাজির হবে। তবে চিন্তা করবেন না। পটকা ফাটাবো এবার। ফরেস্ট অফিসেও ফোন লাগিয়েছি। ওঁরা এই এল বলে। ভয় না পেলে বারান্দা থেকে সার্চলাইটটা ওদের উপর ফেলুন একটু।’

সাত্যকি ফোনটা ছাড়ার পর পরই শুনতে পেলাম পটকা ফাটার শব্দ। বাইরের শব্দগুলোও এলোমেলো হল ইষৎ। অতঃপর সাত্যকির সঙ্গে সার্চলাইটটা নিয়ে বারান্দায় গেলাম আমি আর সুশোভন। নীচে সে আলো ফেলতেই দেখি গোটা চারেক হাতির উপস্থিতি। উরিব্বাস! কী সুবিশাল তাদের শরীর।

ইতিমধ্যে পটকা ফাটাতে ফাটাতে হাজির ফরেস্ট অফিসের লোকেরাও। তাদের গাড়ি থেকে ফেলা জোরালো সার্চলাইটের আলোয় আচমকাই দিশাহারা লাগতে থাকে হাতির দলকে। খানিক পরে আমাদের উদ্বেগকে বিদায় জানিয়ে গভীর জঙ্গলের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে গজরাজের দল।

Advertisement