• facebook
  • twitter
Wednesday, 23 April, 2025

বেড়াল ভূত

তিনি ডাকাবুকো মানুষ, ভয়ডরের ধার ধারেন না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরলেন তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবার জন্যে।

কাল্পনিক চিত্র

শিখা সেনগুপ্ত

সেদিন সন্ধেয় ঝড়বৃষ্টির পরে ঝপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। পড়াশুনা শিকেয় উঠল, বুন্টি, রাজ আর রূপা জোর হৈ-হাঙ্গামা শুরু করে দিল। মা বলেন, ‘এগুলোকে নিয়ে তো আর পারি নে, ওই দেখ তোদের ঠাকুরমা ল্যাম্প জ্বেলেছেন, ওখানে গিয়ে গল্প শোন।’ মা তাঁর অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। তিনি জানেন দুরন্তগুলো গল্প শুনতে পেলে চুপ হয়ে যায়। সবক’টা দুদ্দাড়িয়ে ঠাকুরমার ঘরে গেল।

— ঠাকুরমা গল্প বল।’

ঠাকুরমা একটু সময় চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে বললেন, ‘আজ তোদের একটা সত্যি ঘটনার গল্প বলব। আমরা তখন পুব বাংলার এক অজ পাড়াগাঁ, আটঘড়া গ্রামে থাকি। খুলনা শহর থেকে পনেরো ষোল মাইল দূরে হবে। তোদের ঠাকুর্দার তখন অল্প বয়স। কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসে গ্রামে ও আশেপাশে প্র্যাকটিস করছে। তখনও দেশ ভাগ হয়নি। কলকাতায় সহজেই যাতায়াত করা যেত। নতুন বিয়ে হয়ে এসে আমিও ওই গ্রামে থাকি।’

গল্প শোনার নেশায় দস্যি ছেলেমেয়েগুলো শান্ত হয়ে ঠাকুরমার কোল ঘেঁষে বসে। ঠাকুরমা যে গল্প শোনালেন তা এইরকম—। তাদের ঠাকুর্দা সুরেন্দ্রনাথ বোস তাঁর তরুণ বয়সে সাইকেলে করে রোগী দেখতে যেতেন। একবার বর্ষাকালে খুলনা শহরে এক ধনী বাড়িতে এক মরণাপন্ন রোগীকে সারাদিনের চেষ্টায় বাঁচিয়ে তুললেন। খুব খুশি হয়ে গৃহকর্তা তাঁর ফিস তো দিলেনই, সঙ্গে দিলেন পাশে ভৈরব নদের টাটকা জোড়া ইলিশ। গন্ধে একেবারে ম-ম করছিল। দু’টো ইলিশ সাইকেলের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। সন্ধে হয়ে আসছিল। সুরেনবাবু নদীর পাশের চওড়া রাস্তা ধরে পাঁইপাঁই সাইকেল চালালেন। অন্ধকার হয়ে এল, বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। সেই অজোগোড়া, মহিষাদল পেরিয়ে তাঁদের আটঘড়া গ্রাম।

তিনি ডাকাবুকো মানুষ, ভয়ডরের ধার ধারেন না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরলেন তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবার জন্যে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে তাঁর সাইকেলের নিচে একটা বিড়াল ম্যাও ম্যাও করে ডেকে চলেছে। এই জঙ্গলের মধ্যে বিড়াল কোথা থেকে এল! ব্যাটা নির্ঘাত ইলিশের গন্ধ পেয়েছে। চাপাটাপা পড়েনি তো? সুরেনবাবু সাইকেল থামিয়ে, সঙ্গের টর্চ জ্বেলে বেড়াল খুঁজতে লাগলেন। জোরালো টর্চের আলোতেও কোথাও বিড়াল দেখতে পেলেন না। এবার তাঁর কেমন সন্দেহ হল। তিনি জোরে সাইকেল চালিয়ে দিলেন। তাঁর সাইকেলের সঙ্গে সেই ম্যাও ডাক চলতে থাকল। এবার যেন আরো জোরে আর ক্রুদ্ধ স্বর। তিনি সাইকেল না থামিয়ে সমানে ইষ্টনাম জপ করতে লাগলেন। একসময় বাড়ির উঠোনে পৌঁছে জোরে স্ত্রী মণিকে ডেকে হ্যারিকেন নিয়ে আসতে বললেন। দাওয়ার কাছে এক জায়গায় যেন বেশি জমাট অন্ধকার। সেখান থেকে চাপা ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় তিনি স্পষ্ট শুনলেন, ‘ইষ্ট নাম করে এবার বেঁচে গেলি।’ সে অন্ধকার আর রইল না। তার স্ত্রী মণি হ্যারিকেন নিয়ে এসে বললেন, ‘একি, তোমার হাতে জোড়া ইলিশ! সুরেন্দ্রনাথ দেখলেন সাইকেলে বাঁধা ইলিশ তাঁর হাতে চলে এসেছে। তিনি টান মেরে সে ইলিশ দূরের ঝোপে ছুঁড়ে ফেললেন।

—‘ও কি করলে, অত ভাল ইলিশ ছুঁড়ে ফেলে দিলে!’
— ‘ভিতরে চল, সব বলছি’— সুরেনবাবু বলেন।

এই পর্যন্ত বলে ঠাকুরমা থামেন। একটা বিড়াল ম্যাও বলে ডেকে ওঠে। ও মা গো, বলে বাচ্চাগুলো ঠাকুরমাকে হাঁচোরপাচোর করে জড়িয়ে ধরে। এমন সময় কারেন্ট এলে আলোয় ঝলমল করে। আরে এ তো তাদের মিঠু বিড়াল। সবাই হেসে ওঠে।