• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

ধারাবাহিক উপন্যাস

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

৫.
অলমিতি

Advertisement

ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে

Advertisement

সকালের ব্রাহ্ম মুহূর্ত থেকে ছবি আঁকা শুরু করেন চিত্রজিৎ স্যার৷ তখনও বাইরের পৃথিবীতে আলো ফোটে না৷ শুরু হয় না খবরের কাগজের ভেন্ডারদের সাইকেলে বেল বাজিয়ে ছোটাছুটি৷ দুধের গাড়িগুলোও আসেনি তখনও৷
বেলা ন’টা সাড়ে-ন’টা পর্যন্ত টানা কাজ করে তবে তাঁর বিশ্রাম৷

তার মধ্যে একবার চায়ের কাপ রেখে যায় রান্নার মাসি৷ দ্বিতীয়বার চা আসে সাড়ে ন’টায়৷ অলমিতি ঠিক তার পরে বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়৷ তিনবার টোকা দেয় তার আগমন-সংবাদ জানান দিতে৷ আসার আগের দিন রাত ন’টা নাগাদ স্যারকে ফোন করে জেনে নেয় সে আসবে কি না৷ তার আসার কথা থাকলে এ সময় দু’কাপ চা আসে৷

আজ টোকা দিতে দরজা খুলে দিলেন চিত্রজিৎ স্যার, বললেন, এসো, আমার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে৷
ঘরের টেবিলটার একদিকে একটা রিভলভিং চেয়ার, সেখানে বসেন স্যার, তার সমকোণে দু’দিকে দু্যটি চেয়ার, সেই চেয়ারদুটো ভিজিটরদের জন্য৷ অলমিতি তার একটিতে বসে বলল, ফ্যান্টাস্টিক৷
চিত্রজিতের হাতে তখনও উদ্যত তুলি, বললেন, কোনটা ফ্যান্টাস্টিক?

অলমিতির চোখ ক্যানভাসের দিকে৷ কোনও গ্রামের একটা শুনশান রাস্তা৷ বৃষ্টির পর সেই পথ জলে বানভাসি৷ রাস্তার জলে বেশ স্রোত আছে৷ জল ভাঙছে হু হু করে৷ জলে-জলে ঘর্ষণে সাদা ফেনার রাশি ঝাঁপিয়ে এগোচ্ছে সামনের দিকে৷
—স্যার, ছবিটা৷
—আমি একটা নতুন সিরিজ শুরু করেছি, ‘ইনটলারেন্স’৷ সব ক’টা ছবি হবে এমন যাতে ছবিতে চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝাঁকুনি লাগবে মনে৷

অলমিতি বোঝার চেষ্টা করল৷ চোখ রাখল পাশের ইজেলে রাখা অন্য ছবিটার দিকে৷ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠা ঘরের আসবাবপত্রের ছবি৷ অলমিতিরও ঝাঁকুনি লাগল শরীরে৷ টেবিলের উপর বাকি জিনিস পড়ে না যায়।
আজ স্যারের কণ্ঠস্বর কেমন-কেমন লাগল অলমিতির কানে৷ একটু স্তিমিত, বিষাদগ্রস্ত৷ স্যারের চাউনি ধূসর, অভিব্যক্তিতে উদাসীনতা৷

স্যার এমনিতে একটু গম্ভীর, রিজার্ভ–টাইপের, কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট ওজস্বিতা, কিন্তু স্বভাবে নরম৷ আজ হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন তা বোঝার চেষ্টা করছিল অলমিতি৷ গতকাল সৌম্য তাকে বলছিল রবীন্দ্রসদনের সামনে বিশাল হোর্ডিং-এ সুরঞ্জনা বসুর পাশে তমোনাশ গুপ্ত নামে এক অনামা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর ছবি৷ ছবিটা সৌম্যর চোখেও কেমন অস্বস্তিকর লেগেছে৷ সৌম্য অলমিতির কাছের-বন্ধু৷ বয়ফ্রেন্ড শব্দটা তার কাছে অতিব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়ায় সৌম্য সম্পর্কে কাছের-বন্ধু শব্দটা ব্যবহার করে বরাবর৷

অলমিতি সৌম্যকে বলেছিল, কেন অস্বস্তিকর বলছ, দু’জনে গানের জুড়ি৷ হয়তো দ্বৈতশিল্পী হিসেবে উপস্থাপনা করতে চাইছেন উদ্যোক্তারা৷ তাতে কৌতূহল তৈরি হয় শ্রোতাদের কাছে, টিকিটের চাহিদা বাড়ে৷
সৌম্য বলেছিল, তবু—
অলমিতি হেসে বলেছিল, তার মানে তুমিও মনে মনে জেলাস।
সৌম্য আর কথা বাড়ায়নি৷ অলমিতির এখন মনে হচ্ছে তা হলে কি সেই কারণেই স্যারের মুখাবয়বে বিরাজ করছে সামান্য বিষণ্ণতা।

স্যার হঠাৎ বললেন, সম্ভবত কোনও শিল্পী এ-ধরনের সিরিজ আঁকেননি আগে৷ গোটা দশেক আঁকব৷ আমার ছবির সামনে দর্শক দাঁড়ালেই একটা অস্বস্তির সৃষ্টি হবে তার শরীরে৷ এক আর্ট-ডিলার গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় প্রদর্শনী করবেন আমার ছবির৷ তাঁকে বলেছি আমার সিরিজের বিষয়৷ শুনে একটু চুপ করে গেলেন৷ বলেছেন ভেবে বলবেন আমাকে৷
অলমিতি চুপ করে থাকে৷
—একজন অগ্রজ শিল্পী আমাকে বলেছিলেন, শিল্পী একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর মতো৷ সেই নারীকে যেমন ভালো গান, ভালো চিন্তা, সুসাহিত্য, উপযুক্ত আহারের সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়, যেন তার সন্তান ভালো হয়, তেমনই একজন শিল্পীকেও ভালো গান, ভালো সাহিত্য, ভালো চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়৷ তবেই তিনি আঁকতে পারবেন একটি ভালো ছবি৷
অলমিতির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ঠিক তাই, স্যার৷

স্যার আবার বললেন, শিল্পী যখন আঁকেন, তাঁর মনে একটা প্রবাহ বইতে থাকে আনন্দের, তাঁর হৃদয়ে ভরপুর থাকবে এক আশ্চর্য ছন্দ৷ তবেই তো একটা ভালো ছবির জন্ম হবে৷ আমার মনে হয় শিল্পীকে স্বাধীনতা দিলেই যথার্থ ভালো ছবি পাবে ক্রেতা বা দর্শক৷ কিন্তু সমস্যা হল ক্রেতা বা দর্শকের রুচি তৈরি করতে চায় আর্ট-ডিলাররা৷ যেমন এই ছবিটা লক্ষ্য করো৷ রবীন্দ্রনাথ এত গান লিখেছেন, তাতে এত বৈচিত্র্য, প্রতিটি কলিতে এত ছবি থাকে যে, একজন শিল্পী গানগুলি চিত্রায়িত করতে পারে ক্যানভাসের উপর৷ সেই ভাবনা থেকেই
এক–একটা সিরিজ আঁকছি গত কয়েক বছর ধরে৷ এই সিরিজেও ধরে রাখতে চাইছি রবীন্দ্রগানের নানা মুহূর্ত৷ এই গানটা গোড়া থেকে শোনো:
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা—
আনমনা যেন দিকবালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা৷

ইজেলের উপর চার বাই তিন ক্যানভাসে একটা ছবি প্রায় শেষ হওয়ার মুখে৷ অলমিতি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল ছবিটা৷ রাস্তার ধার ঘেঁসে একটি টিনের বাড়ি, বাড়িটাও জলমগ্ন, সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি বালিকা, সে জলের মধ্যে ভাসিয়ে দিচ্ছে মেঘ দিয়ে বানানো একটি ভেলা৷ বালিকার মুখ বিষাদগ্রস্ত৷ ছবির প্রধান অংশ বালিকার ভেলা–ভাসানো৷ একটু দূরের অংশে আরও দুই ত্রাসের মুহূর্ত৷ সেই অংশে হাঁটু অবধি জল ঠেলে এগোতে গিয়ে খন্দে পা পড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল এক পথচারী৷ তার মাথায় ছাতা, অভিব্যক্তিতে ত্রাস৷ তার পিছনে এক সাইকেল-আরোহী আসছিল জল ঠেলে, তার কেরিয়ারে বসা ঘোমটা মাথায় এক পৃথুলা নারী, জল ঠেলে চালাতে গিয়ে কাত হয়ে জলের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দু’জন৷ তখনও পড়েনি, কিন্তু পড়বে সেই আশঙ্কায় দু’জনের মুখেই আতঙ্ক৷

অলমিতি লক্ষ্য করে দেখল, চিত্রজিৎ স্যার মুখে যা বললেন, প্রকৃত চিত্র অন্যরকম৷ তাঁর মুখে যে বিষণ্ণতা আলতো করে লেগে আছে, সেই বিষণ্ণতাই লেগে আছে বালিকার মুখে৷ কেন তার বিষাদ ভাবছিল অলমিতি৷ মেঘ দিয়ে তৈরি ভেলা একটু পরেই মিলিয়ে যাবে জলের মধ্যে— হয়তো তাই৷ পথচারী আর দুই সাইকেল-আরোহী ত্রস্ত, তাও কি স্যারের মনের কোনও প্রতিফলন!
মোবাইলে বাজছে তখন গানের পরবর্তী কলি:
যেমন হেলায় অলস ছন্দে কোন খেয়ালির কোন আনন্দে
সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা৷

মেঘের ভেলা ভাসিয়ে উচ্ছ্বল হয়ে উঠতে চাইছে বালিকাটি, অলস ছন্দে হেলাভরে খেয়ালির আনন্দে চাইছে তার মেঘের ভেলা যেন পৌঁছে যায় লক্ষ্য অভিমুখে, কিন্তু সকালে যে গাছ মুকুল ধারণ করে, সেই মুকুল ঝরে যায় বিকেলে৷ কী করে ভাসবে মেঘের ভেলা—
যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে,
তার হাতে দিই আমার ছন্দ— কোথা যায় কে জানে সে৷

গানের কলিগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিল অলমিতি৷ যে বাতাস ফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে গন্ধ আহরণ করে, সেই বাতাসই দিনের শেষে ভুলে যায় গন্ধটা৷ বালিকাও ভাবছে সে এত পরিশ্রম করে তৈরি করেছে মেঘের ভেলা, তার মনের ছন্দ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে ভেলাটি, সেই মেঘের ভেলা বৃষ্টির রূপ ধরে একটু একটু করে গলে যাবে রাস্তার জলের মধ্যে৷
লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় জেনো জেনো মোর সকলই হারায়,
চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা৷

বালিকাটি নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ভেলাটির দিকে৷ বৃষ্টির জলের স্রোত ভাঙছে দ্রুত লয়ে, সেই স্রোতে একটু পরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তার সৃষ্টিকর্ম৷ ভেলাটা যখন তৈরি করেছিল, তখন বিভোর ছিল সৃষ্টিতে, একবারও ভাবেনি তার সৃষ্টি হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো৷ পথের নেশায় অবহেলা করেছে তার পাথেয়৷

ছবিটায় এমন একটা গতি আছে যে, হঠাৎ মনে হতে পারে ছবিটা যেন ছবি নয়, জীবন্ত চরিত্র সব৷ অলমিতি বলল, স্যার, খুব ভালো লাগছে ছবিটা৷
চিত্রজিৎ স্যার কিছু বলতে চাইছিলেন, তার আগেই বেজে উঠল মোবাইল৷ ফোন অন করতে করতে বললেন, আর্ট-ডিলার ফোন করেছেন৷
—হ্যালো মি. মিত্র—

অনেকক্ষণ কিছু শুনে নিয়ে বললেন, ‘ইনটলারেন্স’ সিরিজ আপনার পছন্দ হল না। প্রথম ছবিটা আপনি দেখেছিলেন, এখন দ্বিতীয় ছবিটা এসে দেখুন৷ কী বলছেন! আরও অ্যাট্রাকটিভ সিরিজ!

আরও কিছু শুনে নিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন, একটু থেমে বললেন, ঠিক আছে, আমাকে ভাবতে দিন৷
ফোন রেখে তাকালেন অলমিতির দিকে, বললেন, রাবিশ।
অলমিতি বুঝতে চাইল আর্ট-ডিলারের সঙ্গে স্যারের কথোপকথনের সারমর্ম৷
স্যার বললেন, রাবিশ, বলছে একট ন্যুড সিরিজ এঁকে দিন৷
অলমিতি থমকে গেল হঠাৎ৷ ছবির জগতে এসে দেখেছে নারীশরীরের প্রদর্শন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে দর্শক৷ যে কোনও প্রদর্শনীতে ন্যুড ছবির প্রতি সবার আগ্রহ বেশি৷
স্যার বললেন, এত ভালো ছবির বিষয় নিয়ে আঁকা শুরু করলাম, অথচ––
পরক্ষণে বললেন, ন্যুড ছবি আঁকতে মডেল চাই৷ ভালো মডেল না হলে ভালো ছবি কি আঁকা যায়, কী বলো?
অলমিতির দু’চোখে বিস্ময়৷ কী উত্তর দেবে সে।
স্যার হঠাৎ বললেন, তুমি আমার ছবির মডেল হবে?
—আমি! অলমিতির ভিতরে প্রলয় বয়ে গেল এক মুহূর্তে৷
—তিনটে সিটিং দিলেই আমি দশটা ছবির রূপরেখা এঁকে ফেলব৷
অলমিতির বুকের ভিতর ধকধক ধকধক৷ আর্টিস্টদের মডেল থাকে সে দেখেছে৷ তারা সবাই পেশাদার মডেল৷ কিন্তু তাদের না ডেকে স্যার তাকেই মডেল হতে বলছেন, তার পক্ষে কি সম্ভব? স্যারের সামনে সব খুলে বসতে পারবে সে?

আজ পর্যন্ত সৌম্যও তার শরীর দেখেনি৷ তার আগে স্যারের সামনে—
স্যার বললেন, তুমি তখন একজন নারী নও, একটি অবজেক্ট৷ সেভাবেই ভাববে৷ টেবিলে একটা আপেল রেখে যেভাবে শিল্পী ছবি আঁকেন, একজন মডেলকেও সেই দৃষ্টিতে দেখেন শিল্পী৷

অলমিতি গভীর সংকটে৷ স্যার বলেছেন সামনে অনেক প্রদর্শনী আছে, কোনওটা সরকারি, কোনওটা বেসরকারি৷ সেখানে তার ছবি রাখার সুযোগ করে দেবেন৷ প্রদর্শনীতে ছবি রাখতে-রাখতে একজন শিল্পীর প্রচার হয়৷ শিল্প–সমালোচকরা তার ছবিসহ ছবির গুণাগুণ আলোচনা করবেন বিভিন্ন কাগজে৷ একজন তরুণ শিল্পী বড়ো হয় এভাবেই৷

এখন যদি স্যারের মুখের উপর না বলে, স্যারের কাছে আর কখনও আসতে পারব না৷
আবার হ্যাঁ বললে সৌম্যর অভিব্যক্তি জুড়ে পড়বে মেঘের ছায়া৷
কী বলবে সে হ্যাঁ, নাকি না।

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়

Advertisement