• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

আয়না

নাভিটা গঙ্গায় ভাসিয়ে কিট্টু মনে মনে বললো— সেদিন আমি তোমাকে দাদুর কাছে যেতে দিইনি। আজ আমি তোমাকে দাদুর কাছে পাঠিয়ে দিলাম।

কাল্পনিক চিত্র

সিক্তা গোস্বামী

কিট্টু ছাদের একেবারে কর্নারে বসে উঠোনের দিকে দেখছিল। আজকের বাড়ির ছবিটা একদম আলাদা। পাড়ার লোক, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবে গমগম করছে বাড়িটা। উঠোনের মাঝখানে দাদুকে শোয়ানো আছে। গোছা গোছা ধূপ গঙ্গামাটিতে গেঁথে দাদুর চারপাশে রাখা। মা দাদুর পাশে বসে কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজাচ্ছে আর আঁচলে চোখের জল মুছছে। মা বাড়িতে যখন থাকে নাইটি আর হাউসকোট পরে, আজ এত লোক এসেছে বলে শাড়ি পরেছে।

Advertisement

কিট্টুর পিছনে কেউ খাবার নিয়ে ছুটছে না। খোঁজও করছে না। তাই কিট্টু নিজের মত আছে। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। হয়তো দাদুর ঘরে বসে চোখের জল ফেলছে। কিন্তু মা এত কাঁদছে কেন! মায়ের সঙ্গে তো রোজ দাদুর ঝগড়া হতো। দাদুর কোনও কথাই মা মেনে নিতে পারত না। এই নিয়ে বাবার সঙ্গেও রোজ কথা কাটাকাটি হত। কিট্টু দাদুর ঘরে থাকলে মা ছুতোয় নাতায় ডেকে নিতো। এমনকি কিট্টুর ডাকনাম দাদু রেখেছিলেন রবি। রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বরের মতো ভক্তি করতেন কিনা। কিন্তু মা এই ‘কিট্টু’ নামটাই চালু করে দিল। তবে দাদু বরাবর রবি বলেই ডাকতেন।

Advertisement

আগের দিন থেকেই দাদুর শরীরটা বেশ খারাপ। ডাক্তারবাবু ওষুধ, ইঞ্জেকশন সবই করলেন। ক্রমশ দাদুর কথা জড়িয়ে এলো, চোখ বুজে এলো। তখন কিট্টুর খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখে জল এসে যাচ্ছিল। মনে পড়ছিল দাদু কত গল্প বলতো। বাবা-পিসিদের ছোটবেলার গল্প, দাদুর অফিসের গল্প, ঠাকুমার রান্নার গল্প।

সেদিন মা কিছুতেই কিট্টুকে দাদুর ঘরে যেতে দিচ্ছিল না। ও লুকিয়ে লুকিয়ে দাদুকে দেখছিল। দাদু চোখ বন্ধ করে হাতটা কেবল বাড়িয়ে দিচ্ছিল। কিট্টু জানে দাদু ওকেই খুঁজছিল। চোখ ফেটে জল আসছিল কিট্টুর।
নতুন করে কান্নার ঢেউ উঠলো যখন নৈহাটি থেকে পিসিদিদা এলো। দাদুর বোন। খুব ভাব ছিল ওদের। পিসিদিদা দাদুকে প্রায়ই ফোন করতো। ওরা নিজেদের সুখ দুঃখের কথা বলতো।

বাবারা দুই বোন এক ভাই। দুই পিসির মধ্যে ছোট পিসি লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। খুব ভালো গানও গাইতো। দাদু ভেবেছিল লেখাপড়া করে ছোটপিসি খুব বড় চাকরি করবে। কিন্তু সে সব না করে ছোট বয়সে বিয়ে করে চলে গিয়েছিল। তাই দাদুর খুব রাগ হয়েছিল ছোটপিসির ওপর। ছোটপিসি দাদু ঠাকুমার চোখের মণি ছিল। কিট্টু তখন সবে জন্মেছে। এসব গল্প পরে শোনা। পিসির শোকেই ঠাকুমা চলে গিয়েছিল। কিছুতেই পিসির বিয়ে মেনে নিতে পারেনি ঠাকুমা।


‘কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছ না? কী বিড়বিড় করে বলছো ছবি হাতে নিয়ে?’ সমাপ্তির গলা। কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল নেই। ‘ও! ডাকছো? সত্যিই শুনতে পাইনি। দাদুর ছবিটায় বড় ধুলো পড়েছিল। মুছতে মুছতে নানা কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।’
‘তোমাদের দাদু-নাতির বড় অদ্ভুত সম্পর্ক! যত শুনি অবাক হই। দাদু যখন মারা যান তখন তোমার বয়স কত ছিল?’ ‘আমি তখন সবে ১০ কী ১২। আসলে দাদুর সঙ্গে আমার একটা অসম বন্ধুত্ব ছিল। মা-বাবা দু’জনেই অফিস যেত। আমি দাদুর কাছেই বেশি থাকতাম। যদিও মা পছন্দ করত না।’ ‘সে কী! কেন? দাদুর কাছে থাকলে মায়ের তো নিশ্চিন্ত হবার কথা।’
‘আসলে আমার মা তো খুবই আধুনিকা ছিল। তাই ভাবতো, যদি রূপকথার গল্প, ভূত-পেত্নীর গল্প বলে দাদু আমাকে সেকেলে করে তোলে। যা হয় আর কী!’
‘চলো, খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে গেল’ সমাপ্তি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।

শোবার ঘরে একটা হালকা নীল আলো জ্বলছে। এ ঘর যেন লৌকিক জগতের বাইরে। অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছগুলো ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। ওরা ওইটুকু বদ্ধ জায়গাকেই বোধহয় পৃথিবী মনে করে। দেওয়ালে ক্যালেন্ডারে মরুভূমির ছবি। নাইট ল্যাম্পের মায়াময় আলোয় সে ছবি যেন দূরায়ত স্বপ্ন। সমাপ্তি খুব সৌখিন। বাড়ির ইন্টিরিয়ারে এথনিক লুক দিয়েছে। শোবার ঘর সাবেক আমলের পালঙ্ক ও দেরাজ এই ধরনের আসবাব দিয়ে সাজানো। মাথার উপর ছোট্ট ঝাড়বাতি। সোনালী কাজ করা ভারী পর্দায় ঘরটায় একটা জমিদারি ভাব এসেছে।

সমাপ্তি রাতে কিট্টুর বুকে মাথা রেখে শোয়। আজ তার ব্যতিক্রম। ওর অফিসে আজ খুব চাপ ছিল। তাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিট্টুরও ঘুম আসছে না। আজ যে ঘটনা ঘটেছে, যেন জীবনের ভীত নড়ে গেছে।
আজ অফিসে ছোটপিসি এসেছিল। যার রূপে একদিন ঘর আলো হয়ে থাকতো, তাকে আজ চিনতেই পারেনি কিট্টু। অনেক পরিচয় দেবার পর চিনেছে। কিট্টু বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বলল ‘এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার? পরনে

আধ-ময়লা ছেঁড়া কাপড়, চশমার কাচ ভেঙে গিয়েছে। তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ মলিন হেসে পিসি বলে ‘সবই কর্মফল রে! আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে যে অন্যায় করেছি, তার ফল ফলবে না? তুইও কি আমায় ক্ষমা করতে পেরেছিস?’

মুখ নিচু করে কিট্টু বলে, ‘ছোটবেলায় যা করেছি, তা না বুঝে করেছি। তার দায় আজও বয়ে বেড়াবো! তুমি বাড়ি চলো। ওখানে কথা হবে।’ হাত নেড়ে পিসি বলে ‘না, না, ও বাড়িতে আমি আর পা রাখবো না রে। তাছাড়া বৌমাকে মুখ দেখাবো কেমন করে?’ কিট্টু কপাল কুঁচকে বলে ‘তা, তোমার এই অবস্থা হলো কী করে? বাপ্পাদা, মৌদিদি ওরা কোথায়?’ শুকনো মুখে চোখের ভেজা পাতা আর এক চিলতে দুঃখের হাসি নিয়ে পিসি বলল, ‘আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে যা করেছি। ওরাও তাই করল। দোষ দিই না কাউকে। একটা কথা আছে জানিস তো, ‘জীবনটা আয়নায় মুখ দেখা’।’
‘তোর কাছে কিছু টাকার দরকারে এসেছিলাম। কুড়ি হাজার মতো। দিতে পারবি?’ ‘কেন কী করবে তুমি?’ ‘একটা বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ পেয়েছি। এককালীন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে ওরা ওখানে থাকতে দেবে। তোর পিসেমশাই তো কিছুই রেখে যেতে পারেনি। আমার ছোটখাটো গয়না বিক্রি করে ৩৫ হাজার মত হচ্ছে। তাই বাকিটা…’

‘তুমি বাড়িতে আমাদের সঙ্গেই থাকবে। চলো।’ ‘না রে, তোর সামনে যে আমি কত লজ্জায় আর কুণ্ঠায় এসে দাঁড়িয়েছি, সে আমিই জানি। অনেক কষ্টে তোর অফিসের ঠিকানা জোগাড় করলাম। তুই ছাড়া আর কারো কথা মনে পড়লো না এই অসময়ে। তাই…’
‘আচ্ছা তুমি পরশুদিন একবার এসো।’


দু’চোখ দিয়ে কখন যে এত জল পড়ে বালিশ ভিজে গিয়েছে, বুঝতে পারেনি কিট্টু। এসব কথা আর সমাপ্তিকে বলতে চায় না। ও ভাসা ভাসা শুনেছে কিছু। পিসি খুব দূরে তো থাকতো না। তাই তার খবরাখবর লোকমুখে পাওয়া যেত। পিসেমশাই ছোটখাটো চাকরি করতো। কোনোরকমে সংসার চলত। দাদু কেবল জিজ্ঞেস করত ‘হ্যাঁ রে, পুতুলকে দেখতে পাস? ওকে একদিন ডেকে আনবি? ও কেমন আছে?’

কিট্টু তখন এত কিছু বুঝতো না। শুধু বুঝতো দাদু তার ছোট মেয়েকে একটিবার দেখতে চায়। বাবা এসব কথার কোনও জবাব দিত না। কিন্তু কিট্টুর ইচ্ছে করতো ছুটে গিয়ে পিসিকে ডেকে নিয়ে আসে।

বড়পিসি এলে বাড়িতে কত আনন্দ হতো। বড় বড় মাছ আসতো, মাংস আসতো। মা কতরকম রান্না করত। দাদু ওই সব দিনে খুব একটা কিছু খেত না। শুধু বড়পিসিকে ডেকে বলতো, ‘একবার পুতুলের বাড়ি যা না। দেখে আয় ও কেমন আছে।’ বড় পিসি মুখ ঘুরিয়ে বলতো, ‘ও যখন চায় না, তখন আমাদেরও যাবার দরকার নেই।’ দাদু মনমরা হয়ে থাকতো। কিট্টু দাদুর চোখের জলও দেখেছে।

ছোটপিসি বাড়ি ছাড়ার পর ঠাকুমা নাকি অন্নজল ত্যাগ করেছিল। ধীরে ধীরে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধলো। বছরখানেকের পর ঠাকুমা চলে গেল। কিট্টুর তখনও জ্ঞান হয়নি, তখন থেকেই দাদু একা।

ছোটপিসির ওপর খুব রাগ হত। দাদুকে এত কষ্ট কেন যে দিল! একবার আসতে পারতো। দাদু একটু শান্তি পেত। পিসির ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। শোনা যায় ওরা চাকরি-বাকরি করে। মৌদিদি শ্বশুর বাড়ি। আর বাপ্পাদা ওই বাড়িটাকেই ঠিকঠাক করে নিয়েছে।

ছোটবেলায় ছোটপিসির উপর এমন রাগ হত, মনে হতো কোথাও দেখতে পেলে ঢিল ছুঁড়ে মারবে। তবে দেখা হতো না। সেই দিন পিসি এসেছিল, যেদিন দাদুকে উঠোনে শোয়ানো ছিল। ছোটপিসিকে দেখতে পেয়ে ছোট্ট কিট্টু ছাদ থেকে দুদ্দাড় করে নেমে এসে ছোটপিসিকে এক ঠেলা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। তারপর ছুটে দাদুর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাউ-হাউ করে কাঁদছিল। এত আচমকা ঘটে গিয়েছিল ঘটনাটা যে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।

বড় হয়ে বুঝতে পেরেছে ওটা ঠিক কাজ হয়নি। সে তার বাবাকে শেষ দেখা দেখবে বলে এসেছিল। আসলে দাদুর কষ্ট দেখে দেখে কিট্টুর এত রাগ হয়েছিল নিজেকে সামলাতে পারেনি।


অফিস যাওয়ার পথে এটিএম থেকে কুড়ি হাজার টাকা তুলে নিল কিট্টু। আজ ছোটপিসি আসবে। ছোটবেলার একটা ভুলের মাশুল দিতে মানুষটা সারাজীবন কষ্ট পেল। এবার যদি একটু শান্তি পায়। কিট্টু নিজে গিয়ে পিসিকে রেখে আসবে বৃদ্ধাশ্রমে। পিসির প্রয়োজনে সবসময় পাশে থাকবে।

অফিসে ঢুকে ওয়েটিং লাউঞ্জে একটা জটলা দেখে সেই দিকেই এগিয়ে গেল কিট্টু। ওকে দেখেই সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ‘ব্যানার্জীদা, দেখুন তো এই ভদ্রমহিলা আপনাকে খুঁজছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’ কিট্টুর বুঝতে বাকি রইল না। ডাক্তারকে কল করলো। ডাক্তার এসে জানিয়ে দিলেন— সব শেষ।

গোধূলির কমলা আলোয় পৃথিবী ক্রমশ শান্ত হয়ে আসছে। আবার যেন কিট্টু ছোটবেলায় ফিরে যায়। শোয়ানো পিসির চারপাশে ধূপ জ্বলছে। অফিসের অনেকেই এসেছে সঙ্গ দিতে। মুখাগ্নি করে কিট্টু অপেক্ষা করতে লাগলো। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো একটা কথা— পিসি মরে গেল না বেঁচে গেল।

অন্ধকারের পাতলা চাদরে ঢেকে যাচ্ছে চরাচর। সময়ের কাছেই বোধহয় সব প্রশ্নের উত্তর থাকে। যে পিসিকে সে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল, আজ তারই মুখাগ্নি কেউ যেন কিট্টুকে দিয়ে করিয়ে নিল।

নাভিটা গঙ্গায় ভাসিয়ে কিট্টু মনে মনে বললো— সেদিন আমি তোমাকে দাদুর কাছে যেতে দিইনি। আজ আমি তোমাকে দাদুর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। যেখানে থাকো শান্তিতে থেকো তোমরা।

নিচু হয়ে গঙ্গার জল তুলে মাথায় দিতে গিয়ে গঙ্গার জলে নিজের আবছায়া প্রতিচ্ছবিটা দেখে মনে পড়লো পিসি বলেছিল ‘জানিস কিট্টু, জীবনটা আয়নায় মুখ দেখা।’

Advertisement