• facebook
  • twitter
Saturday, 17 May, 2025

আয়েশার পড়াশোনা

পড়াশোনাটা তো অন্তত বজায় থাকবে। সকালে উঠে ও সব কাজ সামলে স্কুলে যেত। রাতে পড়াশোনা করত। কিন্তু তাতেও দেখল আব্বু-আম্মি রাগারাগি করে। গজগজ করে।

কাল্পনিক চিত্র

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

আয়েশার বয়স এখন তেরো। গ্রাম সোলাদানা। ছোট্ট গ্রাম। আয়েশার আব্বু ইটভাঁটায় কাজ করে। আম্মি পানিফল তুলতে যায় ফলনের সময়, বিক্রি করে বাজারে। অন্যসময়েও বড়ো গ্রামে যাদের বাগান, জমি আছে সেখানকার টাটকা ফল সবজি নিয়ে সকালে বিক্রি করে। আয়েশা তখন ঘর সামলায়। বাড়িতে ছোট বোন আর ভাইয়ের দেখাশোনা করে, উনুনে রান্না করে, কয়লা ভাঙে, ঘরের কাজ সব সারে। বাড়িতে আব্বু আম্মি বলেছে সব কাজ সময়মতো করতে পারলে তবেই রাতে পড়ার জন্য সময় দেওয়া হবে। আয়েশার পড়াশোনার খুব ইচ্ছে। কিন্তু নিজের গ্রামে কোনো স্কুল নেই। পড়ার জন্য কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয় পাশের একটা স্কুলে। এখন আয়েশা ক্লাস এইটে পড়ে। আয়েশা যখন বেশ ছোট তখন একবার গ্রামগুলোতে সরকার থেকে খোঁজখবর করতে পাঠানো হল যে, কোন ঘরে কতজন বাচ্চা এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তাহলে স্কুলে নাম লেখাতে হবে। টিফিন নিয়ে যেতে হবে না আর। স্কুলেই ভাত, ডাল, মাছ, সবজি কখনও কখনও মাংসও খাওয়ানো হবে। আব্বু আর আম্মি সেই ভর্তি করল মেয়েকে। পড়াশোনা ওরা দু’জনে তেমন কেউই জানে না। ভেবেছিল মেয়েটা তো অন্তত একবেলা ভালো করে খেতে পাবে। তাই পাঠানো। তখন আম্মি বাইরের কাজও করত না। আব্বুর ইটভাঁটাও বন্ধ ছিল মালিক মারা যাওয়ায়। সেই প্রথম আয়েশার স্কুলে আসা ক্লাস ফাইভে। স্কুলে আসতে আয়েশার খুব ভালো লাগে। স্কুল বাড়িটা বেশ বড়ো। স্কুল বাড়ি লাগোয়া একটা মাঠ। সেখানে কতরকমের খেলা হয়।

টিচারাও বেশ ভালো। আয়েশা মন দিয়ে পড়াশোনা করে। প্রথমে ভালো করে লিখতেও পারত না। পরীক্ষার সময় প্রশ্ন পড়তে পারত না। স্কুলের টিচাররা খুব সাহায্য করতেন। যেসব বাচ্চারা বাড়িতে তেমন সাহায্য পায় না, অথচ মন দিয়ে পড়াশোনা করে, তাদের স্কুলের পর তাঁরা এক্সট্রা কোচিং করান। আয়েশাকেও তাঁরা পড়াতেন। ফলে ক’দিনের মধ্যে আয়েশা বাংলা আর ইংরাজি লিখতে শিখল। বেশ চলছিল। কিন্তু সেভেনে উঠতে না উঠতেই বাড়িতে ওর বিয়ের কথা শুরু হল। পাড়ার লোকেরা আম্মিকে প্রায়ই বলত, ‘শাদি করিয়ে দাও এবার মেয়ের। বড়ো হয়ে গেল তো।’

ততদিনে মোটামুটি বাড়ির কাজেও পাকা হয়ে গিয়েছে আয়েশা। একদিন আয়েশা স্কুল থেকে বাড়িতে এসে শুনল, আব্বুর এক কীরকম ভাই রিস্তা নিয়ে এসেছেন তাঁর ছেলের জন্য। ছেলের আগের বউ মারা গিয়েছে একটা ছোট বাচ্চা মেয়েকে রেখে। তিনি আব্বুকে বলছেন, ‘আয়েশার ওখানে কোনো অসুবিধা হবে না। আল্লার কৃপায় সব আছে। চেহারা ফিরে যাবে। চিনতি পারবা না, বলো।’

আব্বু আর আম্মির চোখ জ্বলজ্বল করতে দেখে আয়েশার ভয় লেগেছিল বেশ। চাচা চলে যাওয়ার পর আয়েশা প্রথমে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল। তারপর একরকম আব্বু আর আম্মির পায়ে ধরে বলল, ‘আমাকে পড়তে দাও দয়া করে। আমি পড়তে চাই। এখন কিছুতেই বিয়ে করব না। আগে বোর্ডের পরীক্ষা দেব। চাকরি করব।’

আব্বু ভীষণ রেগে গেলেন। আম্মিকে বললেন, ‘এ মেয়েকে সব কাজ করতে বলবে বাড়ির। তুমি কাল থেকে কাজে বের হবে। এতগুলো পেট চালাব কেমন করে বলো! ও যেন সব কাজ করে, তারপর যা করার করে।’ আম্মিও খুব রাগ করেছিল। আম্মি কড়াভাবে আয়েশাকে বুঝিয়ে দিল কাজ না করলে পড়া হবে না আর। আয়েশা তাতেও রাজি।

পড়াশোনাটা তো অন্তত বজায় থাকবে। সকালে উঠে ও সব কাজ সামলে স্কুলে যেত। রাতে পড়াশোনা করত। কিন্তু তাতেও দেখল আব্বু-আম্মি রাগারাগি করে। গজগজ করে। বারবার শুনতে হয়, ‘এত ভালো রিস্তা হাতছাড়া হয়ে গেল।’ আয়েশার মনখারাপ হয়ে যায়। ইদানিং ক্লাসেও অমনোযোগী থাকে আয়েশা। একদিন বিজ্ঞান ক্লাসে আমিনুল স্যার একটা চ্যাপ্টার বোঝাতে গিয়ে আয়েশাকে প্রশ্ন করলেন। অন্যমনস্ক থাকায় উত্তর দিতে পারল না সে। আমিনুল স্যার আয়েশাকে ক্লাসের পর টিচারস রুমে ডাকলেন। মনে দ্বিধা নিয়েই ভয়ে ভয়ে ঢুকল আয়েশা। আমিনুল স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে আয়েশা, তোকে ক’দিন ধরে অন্যমনস্ক লাগছে। কিছু হয়েছে?’

আয়েশা মুখ নামিয়ে রাখল। আমিনুল স্যার আবার বললেন, ‘এখানে বস আয়েশা।’ একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করলেন। ‘জল খাবি?’
আয়েশা মাথা নেড়ে বলল, ‘না’।
আমিনুল স্যার আবার বললেন, ‘দেখ আয়েশা তুই পড়াশোনায় ভালো। সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা। কোনো অসুবিধা হলে বল৷’
আয়েশা আমতা আমতা করে বলল, ‘স্যার বাড়িতে আব্বু আর আম্মি বিয়ের জন্য জোর দিচ্ছে।’
আমিনুল স্যার শুনলেন চুপ করে। তারপর আয়েশাকে বললেন, ‘তুই কাল আব্বুকে স্কুলে আসতে বল। বলবি আমি ডেকেছি।’
‘আচ্ছা স্যার।’
‘এখন যা। পড়ায় মন দে। আমি কাল আব্বুকে যা বলার বলব।’

আয়েশা মাথা নাড়ল। পরের দিন আব্বুকে নিয়ে এল আয়েশা স্কুলে। টিচারস রুমে আমিনুল স্যারকে গিয়ে বলায় উনি বেরিয়ে এলেন। আয়েশাকে উনি ক্লাসে যেতে বললেন। আয়েশা চলে গেলে আব্বুর দিকে ঘুরে বললেন, ‘আপনার মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভালো। ওর পড়াশোনা কেমন চলছে বাড়িতে?’

আয়েশার আব্বু মাথা নেড়ে বললেন, ‘আজ্ঞে, পড়ে তো দেখি। রাতে পড়ে। আমরা তো অতো বুঝি না।’
‘সেই জন্যই তো আরও চেষ্টা করতে হবে ওর জন্য। ও যদি ভালো রেজাল্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়ায় আপনাদের ভালো লাগবে না?’
‘আজ্ঞে মেয়ে হয়ে জন্মেছে, অতো লেখাপড়া করে কী করবে? আমরা গরীব। ওর শাদি করাতে হবে। কিন্তু মেয়ে তো ক’ত্তেই চায় না। শুধু বলে পড়ব।’
‘শুনুন, আপনাকে একটা কথা বলি। এমনিতেও আঠারো বছর না হলে তো মেয়েদের বিয়ে করানো যায় না। আইনে তাই আছে।’
‘না স্যার, আমাদের এখানে বারো বচ্ছর হলেই হয়ে যায়। অতো ভালো ঘর হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার জেদের জন্যে। একেই তো তিন তিনটে ছেলেপুলে। কোনোমতে পেট চলে।’ একহাত দিয়ে চোখ মুছল আয়েশার আব্বু।
আমিনুল স্যার বললেন, ‘টাকা পয়সার কথাই যদি বলেন, তাহলে বলব, ওর আঠারো বছর বয়স হওয়া অবধি অপেক্ষা করুন। সরকার থেকে মেয়েদের টাকা দেওয়া হয়।’
‘টাকা? কত টাকা স্যার?’ চকচক করে উঠল আয়েশার আব্বুর চোখ।
‘তা প্রায় অনেকটাই পাবে, যদি ওর বিয়ে না হয়, পড়াশোনা করে। আমি নিজে ওর টাকা পাইয়ে দোওয়ার ব্যবস্থা করব স্কুলে বলে। কিন্তু একটা কথা দিতে হবে। আয়েশা যতদিন পড়তে চাইবে ওকে পড়তে দেবেন। ও খুব ভালো। একদিন ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। আপনাদের ভালো লাগবে না তখন?’
আব্বু চুপ করে রইল। মাথা নীচু। আমিনুল স্যার আবার বললেন, ‘কী ভাবছেন?’
‘আল্লা যদি নারাজ হন এত লেখাপড়া করলে?’
‘কখনোই না। আল্লা কখনও তাঁর সন্তানের ওপর রাগ করতে পারেন? আপনি তো কোনো ভুল কাজ করছেন না। তাহলে?’
‘শাদি হলে টাকা পাবে না?’
‘না। পাবে না। কথা দিন যে ওকে আপনারা পড়তে দেবেন।’
আয়েশার আব্বু মাথা নাড়ল। ‘ঠিক আছে স্যার। যেমন আপনি বলবেন।’
আয়েশার আব্বু চলে গেলে আমিনুল স্যার আয়েশা ও তার দুজন বন্ধুকে ডেকে পাঠালেন টিচারস রুমে। আয়েশা বলল, ‘আসব স্যার।’
‘হ্যাঁ আয়।’

ওরা তিনজন সামনে দাঁড়াল। স্যার বললেন, ‘তোদের একটা দায়িত্ব দেব। কাজটা করতে পারবি তো? তবে লুকিয়ে করতে হবে। যেন কেউ জানতে না পারে।’

ওরা মুখ চাওয়াচায়ি করল। খানিক ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী স্যার, বলুন?’
‘তোদের গ্রামে বা তার আশেপাশে কোথাও আঠারো বছরের কম কোনো মেয়ে, যারা স্কুলে পড়ে, তাদের বিয়ে হলে আমাকে বা প্রণব স্যারকে একটু জানাতে পারবি সঙ্গে সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ স্যার, এ আর এমন কী।’ আয়েশা বলল। পাশের বন্ধুর দিকে ইশারা করে বলল, ‘সোনামনির তো ফোন আছে বাড়িতে, ও জানিয়ে দেবে। কিন্তু কেন স্যার?’

‘সে অতো জানতে হবে না তোদের। শুধু জেনে রাখ, আমরা চাই সব মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করুক। তোরা শুধু জানাবি, তারপর যা করার আমরা করব। কিন্তু খবরদার তোরা যে আমাদের সাহায্য করছিস কেউ যেন জানতে না পারে। পারবি তো?’
ওরা তিনজন একসঙ্গে বলল, ‘পারব স্যার।’
‘ঠিক আছে এখন ক্লাসে যা। আর কাল থেকেই কাজটা শুরু করে দে।’

ওরা ক্লাসে চলে গেল। মনে এক অদ্ভুত আনন্দ। ক্লাসের এতগুলো বাচ্চার ভেতর ওদের তিনজনকে স্যারেরা বেছেছেন এমন এক কাজের জন্য, ওদের পারতেই হবে। তিনজন একে অপরের হাত ধরল শক্ত করে। মুখ চাওয়াচায়ি হল, হাসল। কত কী যে বিনিময় হল ওই নির্মল হাসির ভেতর। জেদ, লেখাপড়া করার অদম্য ইচ্ছে, ভালো কাজে পা বাড়ানোর আনন্দ। যাতে ওদের মতো আরও অনেক মেয়ে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত না হয়। ক্লাসে ঢুকে নিজের কালো হয়ে যাওয়া ব্যাগ থেকে বিজ্ঞান বইটা বের করল আয়েশা। কাউকে কখনও বলা হয়নি বড়ো হয়ে একজন বিজ্ঞানী হতে চায় সে। আয়েশার চোখ ছলছল করে উঠল। রাতে বাড়ি ফিরে ভাইবোনদের খাইয়ে পড়তে বসবে আজ। খুব মন দিয়ে পড়বে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা আর বেশিদিন বাকি নেই। নিজের স্বপ্ন পূরণ করবেই একদিন।