• facebook
  • twitter
Thursday, 6 November, 2025

আরেকরকম কবি নীলাঞ্জন

‘অন্ধকারের অনন্ত রং’ কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাই ফিরে দেখা। ফেলে আসা লড়াইয়ের দিনগুলি। দিনবদলের স্বপ্নগুলি কবি নীলাঞ্জনকে বারবার উদ্ভাসিত করেছে।

প্রচ্ছদ চিত্র

বিমল দেব

কবিতা নানারকম। পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ের ইতিহাস বিবর্তনের ইতিহাস। কবিতার ইতিহাসও সেরকমই। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে কবিতার নিবিড় সখ্য। প্রতিবাদে প্রতিরোধে প্রেমে অ-প্রেমে বিষাদে আনন্দে কবিতা উদ্ভাসিত হয়েছে।
এরকমই একটি কাব্যগ্রন্থ—

‘অন্ধকারের অনন্ত রং’। কবি নীলাঞ্জন দত্ত। দীর্ঘদিন কবিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। নানা অভিজ্ঞতা। স্মৃতি ও বিস্মৃতি। ফিরে দেখা। এইসব নিয়েই ‘অন্ধকারের অনন্ত রং’ কবিতার বই। ৩৮ পৃষ্ঠার এই বইটির কবিতাগুলি পড়তে পড়তে এক অনন্য উপলব্ধির উপকূলে পৌঁছে যান পাঠক। এই পাঠকও কখনো কখনো কবির সফরসঙ্গী হয়ে ওঠেন।
‘সব রেখা ভাঙতে ভাঙতে
ভাঙতে ভাঙতে অবশেষে যখন বিন্দু হয়ে যায়
অসংখ্য বিন্দু মিলে তৈরি হয় অন্ধকার
অন্ধকার আমাদের অবচেতনায় শীত আনে’।

‘একুশে জানুয়ারী’ নামক কবিতায় এই অমোঘ পঙ্‌ক্তি পড়ি এবং জেগে উঠি আরেক ভাবনায়। সমগ্র বইটি জুড়েই এক অন্যরকম স্মৃতির যাপন। মিলান কুন্দেরার সেই স্মরণীয় পঙ্‌ক্তি মনে পড়ে The Struggle of Memory against
forgetting. কবি নীলাঞ্জন দত্ত সেই স্মৃতির দরজায় কড়া নেড়েছেন। যেসব স্মৃতি সমাজ বদলের ভাবনায়। দিন বদলের স্বপ্নে। যাঁরা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের কথা বারবার মনে করেছেন এবং মনে করিয়েছেন। ভুলে যাননি। ‘বন্ধুকে’ কবিতায় নীলাঞ্জন বলেছেন : ‘সময়ের জ্বর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে আরোগ্যের/আশ্বাস রেখেছে কেউ; তুমি তা জেনেছো/ তাই অনায়াসে শীতরাতে /নির্জনতার খাদ পার হয়ে চলে গেছ মেরুর ওধারে।’

সত্তর দশকের দিনবদলের স্বপ্ন দেখা একজন মানুষ আশু মজুমদার। তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দ্রোহকালে। আশু মজুমদার শহিদ হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে, তাঁর স্মৃতিতে কবি লিখেছেন : ‘সন্দেহের তির্যক চোখে আর সাতরং খেলে না আশুদা / জমি দখলের রাতে / শিবির বদল করা সঙ্গীদের ছবিগুলো/ শববাহী ব্রহ্মপুত্রের মত কালো’।

‘অন্ধকারের অনন্ত রং’ কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাই ফিরে দেখা। ফেলে আসা লড়াইয়ের দিনগুলি। দিনবদলের স্বপ্নগুলি কবি নীলাঞ্জনকে বারবার উদ্ভাসিত করেছে। কখনো দ্রোহে। কখনো বিষাদে। কখনো ভালোবাসায় রামধনুর সাতরঙের মতোই বিস্তার দিয়েছে। এক অনন্য দীপন যেন এই কবিতাগুলি সময়ের ইতিহাস। রাজনৈতিক ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়ে আমরা পৌঁছে যাই নীলাঞ্জনের হাত ধরেই। কারণ কবি ইতিহাসের পিঠে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। তবে লক্ষ্য করার বিষয়ে, এইসব বার্তাবাহকের কথা বলতে গিয়ে কবিতার নির্মাণের ভাষা ভুলে যাননি। কারণ নীলাঞ্জন প্রকৃতই একজন উল্লেখযোগ্য কবি। অসামান্য কবির ছন্দজ্ঞান। শব্দচয়নের পরিমিতি বোধ উজ্জ্বল। শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কবিতাই হয়ে উঠেছে অনুভবে মহৎ। দক্ষকবির এই হয়ে ওঠা আমরা লক্ষ্য করি। সময়ের সনাক্তকরণে নীলাঞ্জনের বিচরণভূমি বিস্তৃত। সময়কে ছাড়িয়েও তিনি হেঁটে যান অন্য দিগন্তে।

‘বার্লিন’, ‘জিসনে লাহোর নেহি দেখা’, ‘চাওয়া’, ‘স্বপনকে’, ‘দুর্গপ্রাকারে হ্যামলেট’, ‘ভাদু’, ‘মিছিলে এসো’, ‘উচ্ছেদ’ অসামান্য উপলব্ধির কবিতা। আমাদের আলোকিত করে। কবি বলেছেন : ‘ভালোবাসা নিজেই আগুন / ভালোবাসা আগুনে পোড়ে না’।

ভালোবাসার কবি। দ্রোহের কবি। নীলাঞ্জনন দত্ত অনন্ত রং-এর কবি। তাঁর কবিতা আমাদের আলোকিত করে।

অন্ধকারের অনন্ত রং
নীলাঞ্জন দত্ত
বর্ণমালা প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : সোমনাথ ঘোষ
মূল্য ৮০ টাকা