• facebook
  • twitter
Monday, 8 December, 2025

শিরাকাটা ৩ দেহ বাড়িতে আরও ৩ আহত বাইপাসে

ট্যাংরাকাণ্ডে গভীর রহস্য

নিজস্ব চিত্র

বুধবারের মধ্য রাত। গড়ফা থানার অভিষিক্তা মোড়ের কাছে পিলারে ধাক্কা মারে একটি গাড়ি। সেই গাড়িতে দুই ব্যক্তির সঙ্গে ছিল এক কিশোর। কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা উদ্ধার করে কিশোরসহ তাঁদের নিয়ে যান হাসপাতালে। পুলিশ সূত্রে খবর, গাড়ির মধ্যে ছিলেন ট্যাংরার বাসিন্দা একই পরিবারের দুই ভাই এবং এক কিশোর। গাড়ি চালাচ্ছিলেন বড় ভাই প্রসূন দে। পাশে ছিল ছোট ভাইয়ের কিশোর পুত্র এবং পিছনের সিটে ছোট ভাই প্রণয় দে। পরে হাসপাতালে পুলিশ গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই প্রকাশ্যে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জেরার মুখে আহতদের দাবি, ‘পরিবারের সবাই আত্মহত্যা করেছে। তাই আমরাও আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম।’ আহতদের বয়ান অনুযায়ী খবর দেওয়া হয় ট্যাংরা থানায়।

ট্যাংরা থানা এলাকার অতুল শূর লেনের তিনতলা বাড়ি। সেই বাড়ির দ্বিতীয় তলার তিনটি আলাদা আলাদা ঘরে পড়ে মা, মেয়ে এবং কাকিমার দেহ। বুধবার সকালে বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে এমনই দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছিলেন ট্যাংরা থানার আধিকারিকেরা।

Advertisement

ট্যাংরার ওই বাড়িতেই দীর্ঘদিন ধরে বাস ‘দে’ পরিবারের। এ দিন সকালে সেই বাড়ি থেকেই উদ্ধার করা হয় বাড়ির বড় ছেলে প্রসূন দে-র স্ত্রী রোমি দে (৪৪), ছোট ছেলে প্রণয় দে-র স্ত্রী সুদেষ্ণা দে (৩৯) এবং এক কিশোরীর দেহ। সূত্রের খবর, পেশায় চর্ম ব্যবসায়ী প্রসূন দে-র মেয়ে ওই কিশোরী। মা রোমি এবং কাকিমা সুদেষ্ণার হাতে ধারালো অস্ত্রের ক্ষত চিহ্ন থাকলেও কিশোরীর গায়ে কোনওরকম বাহ্যিক চিহ্ন মেলেনি বলেই জানিয়েছে পুলিশ। তবে তার মুখে এবং নাক থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। কিশোরীর নাকে এবং ঠোঁটে মিলেছে রক্ত জমাট বাঁধার দাগও। তা থেকে তদন্তকারী আধিকারিকদের একাংশের অনুমান, শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়ে থাকতে পারে কিশোরীকে। সত্যিই কি আত্মহত্যা, নাকি পরিবারের তিন সদস্যকে খুন করে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন দুই ভাই? তা এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে তা স্পষ্ট হবে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।

Advertisement

স্থানীয় সূত্রে খবর, বাড়ির কাছেই  দে-পরিবারের চামড়ার কারখানা রয়েছে। সম্প্রতি তাঁদের সংসারে দেখা দিয়েছিল অভাব। শুধু তাই নয়, বাজারে প্রায় লাখ তিরিশেক টাকার দেনা হয়েছিল দে-পরিবারের। সম্প্রতি তাঁদের প্রায় ২৩ লক্ষ টাকার চেক বাউন্স করে। আরও জানা গিয়েছে, সম্প্রতি কারখানা ছেড়ে দিয়েছেন একাধিক শ্রমিক। সেই সঙ্গে ছিল পাওনাদারদের তাগাদা। সব মিলিয়ে এই আর্থিক সমস্যা থেকেই কি চরম সিদ্ধান্ত দুই ভাইয়ের? তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে পুলিশ।

অন্যদিকে, স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত কারখানা খোলা থাকলেও দে-বাড়ি ছিল অন্ধকার। তা দেখে খানিকটা সন্দেহও হয় স্থানীয়দের। তারপরেই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় তিনজনের মৃতদেহ। এ দিন ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় একটি রক্তমাখা ছুরিও। পুলিশ সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, জেরার মুখে আহতরা দাবি করেছেন, গত সোমবার থেকেই তাঁরা নিজেদের শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। সেইমতো বাড়ির ছয় জনেই পায়েসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ এবং রক্তচাপের ওষুধ মিশিয়ে খেয়েছিলেন। তবে তাতে কাজ না হওয়ায় বিকল্প পথ বেছে নেন তাঁরা।

এদিন একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যুর খবর জানা মাত্রই একে একে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড শাখা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দল। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যান নগরপাল মনোজ বর্মা, যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) রূপেশ কুমারসহ অন্যান্য আধিকারিকেরা। সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে রূপেশকুমার বলেন, ‘একটি দুর্ঘটনা হয়েছিল। গাড়ি পিলারে ধাক্কা মারে। তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁদের সূত্রে জানা যায়, একটি ঠিকানায় তিনজনের মৃতদেহ পড়ে আছে। সেই দেহগুলি উদ্ধার করা হয়েছে। সকলে একই পরিবারের সদস্য। হাসপাতালে যাঁরা, তাঁরা তিনজনই পুরুষ। দেহ মিলেছে দুই মহিলা এবং এক কিশোরীর। আহতদের মধ্যে এক জন সচেতন আছেন। দু’জন অর্ধচেতন। তাঁদের বয়ান নেওয়া হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিন জন। তার পর তাঁরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পিলারে ধাক্কা মারেন। কী ঘটেছে, ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে।’

অন্যদিকে দুপুরে লালবাজারে সাংবাদিক সম্মেলন করেন নগরপাল মনোজ বর্মা। আহতরা সুস্থ হয়ে উঠলেই ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হবে বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আরও কিছু তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। হাসপাতাল থেকে আহতেরা যা বয়ান দিয়েছেন, তা যাচাই করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই আমরা সব তথ্য প্রকাশ করতে পারছি না। কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি।’ যদিও কবে মৃত্যু হয়েছে কিশোরীসহ দুই মহিলার তার সময় নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। অন্যদিকে বাড়ির সদস্যরা আত্মহত্যা করেছেন বলে যদি দুই ভাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকেন, তাহলে গাড়ি নিয়ে কেন বেরিয়েছিলেন বাড়ি থেকে, সেই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্তকারী আধিকারিকদের মনে।

Advertisement