আজ ‘১৬ই এপ্রিল’ ভারতীয় রেল দিবস

Written by SNS April 16, 2024 2:43 pm

নিশীথ সিংহ রায়

১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিলকে ভারতের রেল দিবস হিসেবে পালন করা হয় কিন্ত বাস্তব সত্য হল ভারতে প্রথম রেলের চাকা ঘুরেছিল ১৮৩৭ সালে৷ আর তারও পাঁচ বছর আগে ১৮৩২ সালে মাদ্রাজে ভারতে রেল ব্যবস্থার প্রয়োজনের কথা উল্লেখিত হয়৷ এর চার বছরের মাথায় আর্থার কটন কোম্পানি ১৮৩৬ সালে রেড হিল থেকে মাদ্রাজের চিন্তাদ্রিপেট পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কাজ করে৷ এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮৩৭ সালে মাদ্রাজে প্রথম ট্রেন চলে৷ তার নাম ছিল ‘রেড হিল’৷ এটি স্টিম ইঞ্জিন চালিত ছিল৷ এই ট্রেনটি বানিয়ে ছিলেন উইলিয়াম এভারি৷ ট্রেনটি রেড হিল থেকে মাদ্রাজের চিন্তাদ্রিপেট পর্যন্ত গ্রানাইট নিয়ে যাবার জন্য চালু হয়েছিল৷ এরপর ১৮৪৫ সালে রাজমুমারী দৌলেশ্বরম গোদাবরী নদীর ওপর বাঁধ নির্মানার্থে ‘গোদাবরী বাঁধ নির্মান’ রেললাইন নির্মিত বা ১৮৫১ সালের ২২শে ডিসেম্বর রুরকিতে একটি খাল নির্মান কার্যে মাল পরিবহণের স্বার্থে আরও একটি লাইন চালু হয়৷ রেলের চাকা ভারতের অনেক জায়গায় ঘুরলেও তা সবই ছিল পণ্য পরিবহণের কারণে এবং সবই সাময়িক প্রয়োজনের স্বার্থে৷ অর্থাৎ কোনো একটি সুনির্দিষ্ট কারনে এই সমস্ত রেলপথগুলি চালু হয়েছিল৷ তাই যেদিন কোনো একটি নির্দিষ্ট এবং সাময়িক কারণে নয়, যাত্রী পরিষেবা দেবার জন্য সুসংহত ভাবে ১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিল তৎকালীন বোম্বাইয়ের বোরি বান্দর থেকে থানের উদ্দেশ্যে যাত্রীদের নিয়ে ট্রেন ছুটেছিল সেই দিনটিকেই ভারতের ইতিহাসে ‘রেল দিবস’ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ তাই আজ ১৬ই এপ্রিল ভারতীয় রেল দিবস৷ বোরি বান্দর থেকে থানের দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার৷ ঠিক আজ থেকে ১৭১ বছর আগে ১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিল ভারতের রেল ইতিহাসের সাক্ষীস্বরূপ যাত্রীবাহী ট্রেনটি ৪০০ জন যাত্রীকে নিয়ে যায়৷ ট্রেন পথটির যাবতীয় দায়িত্ব বা নির্মান কার্যকরেছিল ‘দ্য গ্রেট পেনিনসুলার’ রেলওয়ে কোম্পানি৷ সাহিব, সুলতান ও সিন্ধু তিনটি লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ও ১৪টি বগি নিয়ে ভারতের রেল ইতিহাসের প্রথম যাত্রীবাহী রেল ছুটেছিল সেদিন৷ ১৮৩২ সালে ভারতীয় রেলের পরিকল্পনা, ১৮৩৭ সালে প্রথম পণ্য পরিবাহী ট্রেন চালু এবং এর ষোলো বছর পরে ১৮৫৩ সালে যাত্রী পরিষেবা দিয়ে এই অধ্যায়ের পরিসম্পাতি৷
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি অভিবক্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটো ছোটো রেলপথ স্থাপন করতে থাকে৷ আর বঙ্গের ক্ষেত্রে ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে’ কোম্পানি এই দায়িত্ব নেয়৷ তারা ১৮৫৪ সালের ১৫ই আগস্ট হাওড়া থেকে হুগলী প্রথম পরীক্ষামূলক যাত্রীবাহী রেল চালু করে৷ এর পরে হাওড়া থেকে হুগলী নয় একেবারে পান্ডুয়া পর্যন্ত নিয়মিত যাত্রীবাহী রেল পরিষেবা চালু হয় ও ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পান্ডুয়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি লাভ করে৷ দিল্লী থেকে হাওড়া রেল চালু হয় ১৮৬৪ সালে ও লক্ষ্ণৌ থেকে কানপুর রেল চালু হয় ১৮৬৭ সালে৷ এভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন কোম্পানির দ্বারা সারা ভারতবর্ষ জুডে় মাকড়সার জালের মতো রেল ব্যবস্থা চালু হয়৷ প্রথমে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ বা পরে বৃটিশ সরকার ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেলওয়ে সংস্থাকে রেল স্থাপনের জন্য উৎসাহিত করতে থাকে৷ ন্যারো গেজ, মিটার গেজ, ব্রড গেজ বা স্ট্যান্ডার্ড গেজ এরকম অনেক রেল লাইন চালু হলো৷ এগুলি সারা ভারত জুডে়ই চালু হয়৷ সরকারি সুরক্ষা থাকায় তখনকার আসাম থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থানে বা অন্য অঞ্চলেও প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৮৫৪ থেকে ১৮৬০ সালে মধ্যে ১৩৪৯ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপিত হয়৷ এরপর মাত্র কুডি় বছরে মানে ১৮৮০ সালের মধ্যে ভারতে ২৫৪৯৫ কিলোমিটার রেলপথ চালু হয়েছিল৷ তখনকার দিনে তা ছিল এক অভাবনীয় ব্যাপার৷ দেশের তিন প্রধান বন্দর কোলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজের সাথে যোগাযোগের স্বার্থে এই রেললাইনগুলি প্রধানত গডে় উঠেছিল৷ ভারতীয় রেল ব্যবস্থায় দেশীয় কোম্পানিগুলিও বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসে৷ যেমন বাবা শিবদয়াল বেদি এন্ড সনস্ নামে একটি সংস্থা যমুনা ব্রীজ তৈরি করে যা এখনও অটুট৷ শুধু তাই নয় দিল্লী থেকে সুদূর লাহোর পর্যন্ত রেললাইন এই কোম্পানি তৈরি করেছিল৷ ১৮৯৫ সালে ভারতে দেশীয় লোকোমোটিভ তৈরি হতে আরম্ভ করে দেয়৷ এমনকি ১৮৯৬ সালে আফ্রিকার উগান্ডায় রেললাইন নির্মান কার্যে ভারত থেকে ইঞ্জিনিয়ার ও লোকোমোটিভ ইঞ্জিন পাঠানো হয়েছিল৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সরকারের মিত্র দেশগুলিতে সৈন্য ও খাদ্য সামগ্রী পাঠাতে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা বিশেষ কাজে লেগেছিল কিন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারতীয় রেল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ রেলের ইতিহাসে প্রথম অধিগ্রহণ হয় ১৯০০ সালে৷ বৃটিশ সরকার জিআইপিআর নেটওয়ার্কটিকে অধিগ্রহণ করে কিন্ত ব্যবস্থাপনায় ছিল সংস্থাটিই কিন্ত ১৯২৩ সালে সরকার জিআইপিআর ও ইআইআর সংস্থাদুটিকেই সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রায়ত্বকরণ করে নেয়৷ রেলপথ চালুর ক্ষেত্রে সরকার কোম্পানিগুলিকে ৯৯ বছরের লিজে জমি দিত এবং রেলপথ শুরুর বছরগুলিতে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত খাজনা কোম্পানিগুলির থেকে নিত৷ সরকার ভবিষ্যতে এই রেলপথ কিনে নিতে পারবে তাও চুক্তিতে উল্লেখিত ছিল৷ ভারতের রেলওয়ের জনক বলা হয় তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসিকে৷ যিনি ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন৷ লর্ড ডালহৌসি তখনকার ভারতের প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলিকে একসূত্রে গাঁথার জন্য রেলওয়ে এক সুসংহত রূপ দেবার চেষ্টা করেন৷ তার আমলে শুধুমাত্র যাত্রীবাহী ট্রেন নয় ভারতের ইতিহাসে আরও অনেকগুলি যেমন বৈদু্যতিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা, অভিন্ন ডাক ব্যবস্থা, গণপূর্ত বিভাগ বা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের জন্য ‘উড’স এডুকেশন কমিশন’ গঠন হয়েছিল সেজন্য তাঁকে আধুনিক ভারতের নির্মাতাও বলা হয়৷ লর্ড ডালহৌসি যতই ভারতীয় রেলের জনক হোক না কেন এর সূত্রপাত করেছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ ১৮৪৪ সালে৷ তিনিই প্রথম বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ভারতে রেললাইন ও রেল চলাচল ব্যবস্থা করার অনুমতি দেন৷
দেশ স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় বিয়াল্লিশটি কোম্পানি ভারতে রেল ব্যবসার সাথে জডি়ত ছিল৷ ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে সমগ্র রেলওয়ে ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা হয় এবং এটি একটি সুসংহত রূপ নেয়৷ সেসময় রেল ব্যবস্থাকে ছয়টি জোনে বিভক্ত করা হয়৷ বর্তমানে ভারতীয় রেলে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি পঁচাশি লক্ষ যাত্রী চলাচল করে যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা৷ একা শিয়ালদহ স্টেশনেই প্রতিদিন দশ লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করে৷ আরও একটি কোনো সরকারি সংস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রেও ভারতীয় রেল পৃথিবীতে প্রথম৷ যা পৃথিবীতে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা৷ পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রেও ভারতীয় রেল ভারতের অর্থনীতিকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করে৷ কারণ ভারতীয় রেল প্রতিদিন কুডি় লক্ষ টনেরও বেশি মাল পরিবহণ করে৷ এতে ভারতীয় রেল একটা বিরাট টাকা মুনাফা করে যা ভারতীয় রেলের একটা বিরাট আয়৷ এর সাথে যোগ হয়েছে চক্র রেল, মেট্রো রেল ইত্যাদি৷ কলকাতায় জনসংখ্যার আধিক্যের কথা বিবেচনা করে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় এই চক্র রেলের স্বপ্ন দেখেছিলেন৷

১৯৮৪ সালে ভারতের মধ্যে কলকাতায় যেমন প্রথম চক্র রেল হয়েছিল তেমনি ১৯৮৪ সালেই মেট্রো রেলও প্রথম কলকাতায় চালু হয়েছিল৷ তাই রেলওয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইতিহাসে কলকাতার নাম প্রথমে না থাকলেও চক্র ও মেট্রো রেলের ক্ষেত্রে কলকাতা কিন্ত প্রথম৷ ১৯৮৪ সালের ২৪শে অক্টোবর ভারতের মধ্যে কলকাতায় প্রথম মেট্রো রেল চালু হয়েছিল যার চালকদ্বয়ও ছিলেন দুই বাঙালি তপন কুমার নাথ ও সঞ্জয় শীল৷ তেমনি ২০২৪ সালের ৬ই মার্চ গঙ্গা নদীর তলা দিয়ে মেট্রো রেল চালু কলকাতাকে আবার গর্বিত করলো৷ যদিও কলকাতায় মেট্রো রেল বসার প্রথম কথা হয় একশো বছরেরও আগে অর্থাৎ ১৯১৯ ও ১৯২১ সালে এবং তখনই গঙ্গা নদীর তলা দিয়ে বাঘমারি থেকে ঘুসুরি পর্যন্ত মেট্রো রেল চালুর কথা হয়েছিল৷ হাওড়া স্টেশন ২৩টি প্ল্যাটফর্ম ও ২৫টি ট্রাক নিয়ে ভারতের বৃহত্তম স্টেশন৷

বর্তমানে ১৮টি জোনে ও ৭০টি ডিভিশনে ভারতের রেলওয়ে বিভক্ত৷ এখন ভারতীয় রেল সংশ্লিষ্ট যা কিছু উৎপাদন ও আধুনিকীকরণ সবই দেশের মধ্যে হয়৷ ১৯৮৫ সালে স্টিম ইঞ্জিনের বদলে ডিজেল ও লোকোমোটিভ ইঞ্জিন চালু হয়৷ ১৯৯৫ সালে মধ্যে ভারতীয় রেল সম্পূর্ণভাবে কম্পিউটারাইজ হয়ে যায়৷ ২০০৩ সালে ভারতীয় রেলের সার্ধশতবর্ষ পালিত হয়৷ ১৮৫৩ সালে যে রেলের পথ চলা শুরু সেই রেল আজ ধারে-ভারে পৃথিবীতে এক অনন্য জায়গার অধিকারী৷ ভ্রমণপিপাসু ভারতীয় বা ভারতে ঘুরতে আসা বিদেশী পর্যটকদের কথা চিন্তা করে ভারতে উন্নত মানের হোটেলের সুবিধাযুক্ত বেশ কয়েকটি ট্রেন রেলমন্ত্রক চালু করেছে যার দায়িত্বে আছে আইআরসিটিসি৷ যেমন ‘মহারাজা এক্সপ্রেস’ যা ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলস এয়ার্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল ট্রেন হিসেবে ওয়ার্ল্ড লিডিং লাক্সারি ট্রেনের তকমা পেয়েছে৷ এছাড়াও ‘প্যালেস অন হুহলস’, ‘রয়্যাল রাজস্থান অন হুহলস’, ‘দ্য গোল্ডেন চ্যারিয়ট’ প্রভৃতি ট্রেনে রয়েছে পাঁচতারা হোটেলের সুযোগসুবিধা৷ ভারতীয় রেলে ওঠেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতীয় রেল বিশ্বে এক নম্বর৷ দূরত্ব অনুযায়ী ভারতীয় রেল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম নেটওয়ার্কে সমৃদ্ধ এবং একক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নেটওয়ার্ক৷ পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্ম ভারতের গোরক্ষপুর রেলওয়ে স্টেশন৷ ভারতে রেলওয়ে স্টেশন আছে সাত হাজার তিনশো পঁচিশটি৷

আসুন, আজকের দিনে সবাই মিলে সংকল্পবদ্ধ হই কলকাতার মেট্রো রেল যেমন পৃথিবীতে সবকিছুর দিক দিয়ে সুনামের অধিকারী তেমন আমরা আমাদের জাতির জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সরকারী রেল ব্যবস্থাকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে পৃথিবীতে এক অনন্য জায়গায় নিয়ে যাব ও রেলের ক্ষতিসাধন হয় এমন কাজ করব না৷