আধার কার্ড থাকলেই কোনও ব্যক্তি ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য হবেন না, সোমবার দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে জ্ঞানেশ কুমার জানিয়েছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, আধার আইন অনুসারেই আধার কার্ড ব্যবহার করতে হবে। আধার আইনের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। এটি পরিচয় প্রমাণের নথি।’
সোমবারের পর মঙ্গলবার রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের নেতৃত্বে সর্বদল বৈঠক করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সেখানে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজকুমার আগরওয়াল স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের এসআইআর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমাদের তৈরি ভোটার তালিকা ১০০ শতাংশ স্বচ্ছ হবে।’
Advertisement
বাংলা-সহ ১২ রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে মঙ্গলবার শুরু হয়েছে বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর-এর কার্যক্রম। এদিন বিকেলে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজকুমার আগরওয়ালের নেতৃত্বে সর্বদল বৈঠক করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। বৈঠকের শুরুতেই আধার কার্ডকে কেন্দ্র উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এনুমারেশন ফর্মে একটি কিউআর কোড থাকবে। প্রতিটি ভোটারের জন্য থাকবে পৃথক পৃথক কিউআর কোড। এই এনুমারেশন ফর্মে প্রত্যেক ভোটারকে সই করতে হবে।
Advertisement
রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের আশ্বাস, ‘এটা প্রথমবার এসআইআর হচ্ছে না। ফলে আশঙ্কার কিছু নেই। এটি একটি প্রকল্প যার দেখভাল করে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। এর আগেও দেশে এসআইআর হয়েছে। বিহারেও হয়েছে। তাই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।’
বিহারে এসআইআর চলাকালীন আধার কার্ডের মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সুপ্রিম কোর্ট আধার কার্ড ব্যবহারের অনুমতি দিলেও স্পষ্ট করে দেয় যে , আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। আদালত বিহারের ভোটার তালিকার সংশোধনের জন্য পরিচয়পত্র হিসেবে আধার অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর জাতীয় নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে, এসআইআর-এ আধার কার্ড মান্যতা পাবে, যদিও এটি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সর্বদল বৈঠক।
মঙ্গলবার আধার কার্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে সিপিএম। পাশাপাশি সিএএ-তে আবেদন করলে তার ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় নাম উঠে যাবে, বিজেপির এই দাবির প্রেক্ষাপটে কমিশনের বক্তব্য জানতে চান সুজন চক্রবর্তী। শুধু তাই নয়, কে নাগরিক এবং কে নাগরিক নয়, এটি কমিশন কীসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করছে তাও জানতে চায় সিপিএম।
রাজনৈতিক দলগুলি সর্বদলীয় বৈঠকে আধার সংযুক্তির পাশাপাশি এনুমারেশন ফর্ম নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা জানতে চেয়েছে যে, যারা ভোটার তালিকায় নিজেদের নাম একাধিকবার তালিকাভুক্ত করেছেন, তাদের নাম শুধুমাত্র একটি জায়গায় রাখা হবে কিনা এবং এই প্রক্রিয়ায় এনুমারেশন ফর্ম কাকে দেওয়া হবে ?
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে এসআইআর-এর সময় এনুমারেশন ফর্ম ছিল না। এই ফর্ম কেন নিয়ে আসা হয়েছে, এর ভিত্তি কী সেই প্রশ্ন তোলে রাজনৈতিক দলগুলি। যে ভোটার ২০০২ সালের এসআইআর-এর পর ৫টি নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে, ২০০২-এর তালিকায় তার নাম না থাকার কারণে কেন তাকে আবার প্রমাণ দিতে হবে সে যোগ্য, এই প্রশ্ন তোলেন সুজন। রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, এসআইআর-এর পর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের পর অন্ততপক্ষে ১ বছর এই এনুমারেশন ফর্ম সংরক্ষণ করতে হবে।
সুজন চক্রবর্তীর আরও সংযোজন, যে ১১টি তালিকা নথি হিসেবে দেওয়া হয়েছে, সেগুলিই যে নাগরিকত্বের প্রমাণের দলিল, তা স্থির করার দায়িত্ব কমিশনকে কে দিয়েছে। তাঁর আরও বক্তব্য, বাংলাদেশি বলে বাংলাভাষীদের দাগানো চলবে না।
এদিন বৈঠকে তৃণমূলের তরফে ফিরহাদ হাকিম বলেন, বাংলার যাঁরা প্রকৃত ভোটার তাঁদের নাম বাদ গেলে জোরালো প্রতিবাদ করা হবে। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি একসঙ্গে চলতে চাইছে। কোনওরকম চক্রান্ত হলে পা ভেঙে দেওয়া হবে।
এনআরসি-র আতঙ্কে পানিহাটির এক প্রৌঢ় আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে অরূপ বিশ্বাস বলেন, এর দায় কমিশনকে নিতে হবে। কারণ ভারতীয় নাগরিক কে, সেই মান্যতা কমিশন দিতে পারে না। তাঁর আরও অভিযোগ, এসআইআর হল এনআরসি এবং সিএএ চালুর আগাম পরিকল্পনা।
নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, সোমবার রাত ১২টা থেকেই ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভোটার তালিকা ‘ফ্রিজ’ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করা, সংশোধন বা পরিবর্তনের মতো কোনও কাজ আর করা যাবে না।
২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হবে এনুমারেশন ফর্ম ছাপার কাজ । সেই দিনই বিএলওদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে, চলবে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। পরবর্তী ধাপে ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হাতে এনুমারেশন ফর্ম তুলে দেওয়া হবে। প্রবাসী বা রাজ্যের বাইরে থাকা নাগরিকরা অনলাইনেও ফর্ম পূরণ করতে পারবেন।
খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে ৯ ডিসেম্বর। কেউ তালিকায় ভুল বা বাদ পড়া নাম নিয়ে অভিযোগ জানাতে পারবেন ৯ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। এরপর ৯ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া চলবে। সবশেষে ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা।
Advertisement



