মধুচন্দ্রিমায় হত্যারহস্যের জট অবশেষে খুলল। ইন্দোর থেকে মেঘালয়ের শিলংয়ে পৌঁছে নবদম্পতির অন্তর্ধান এবং ১৭ দিনব্যাপী রহস্যময় পর্বের সমস্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য প্রকাশ্যে এল। রাজা রঘুবংশীকে কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা ধৃতদের জেরা করে সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় রাজার স্ত্রী সোনম-সহ ৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডের মূল চরিত্র রাজা রঘুবংশীর স্ত্রী সোনম রঘুবংশী।
মেঘালয়ের হানিমুন হত্যাকাণ্ডে অবশেষে স্বামীকে খুনের ছক কষার অভিযোগ স্বীকার করেছেন স্ত্রী সোনম। বুধবার মেঘালয় পুলিশ সোনম রঘুবংশী এবং তাঁর প্রেমিক রাজ কুশওয়াহাকে সামনাসামনি বসিয়ে জেরা করেন। সেই সময়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন সোনম। তদন্তকারীদের কাছে সমস্ত দোষ কবুল করেন। সূত্রের খবর, জোরদার তথ্যপ্রমাণ সহ তদন্তকারী টিম রাজ এবং সোনমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এদিন। ফলে কোনও কিছুই লুকোতে পারেননি তাঁরা।
৪২টি জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ, রক্তাক্ত জ্যাকেট, সোনমের রেনকোট রাজা রঘুবংশীর হত্যাকাণ্ডে সবথেকে বড় তথ্যপ্রমাণ হয়ে উঠেছিল। এই তথ্যপ্রমাণগুলি সোনমের কাছে পালানোর কোনও পথ খোলা রাখেনি। ফলে সিট আধিকারিকদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। জেরায় স্বীকার করে নেন, তিন সুপারি কিলার আকাশ রাজপুত, বিশাল ওরফে ভিক্কি ছাকুর এবং আনন্দ কুর্মীর সঙ্গে ছক কষে রাজাকে খুন করিয়েছিল তিনি।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, হানিমুনে গিয়ে মেঘালয়ের সাইট সিইং করার নাম করে স্বামীকে সোহরা এলাকায় নিয়ে গিয়েছিল সোনম। এলাকাটি বেশ শুনশান ছিল। সেখান থেকে সুপারি কিলারদের লোকেশন পাঠায় সোনম। শাশুড়িকে একাদশীর ব্রত রাখার মিথ্যা খবর দেন। হোটেল রেকর্ড থেকেই জানা যায় সে ওই দিন খাবার খেয়েছিলেন সোনম।
রাজাকে হত্যার পর সোনম রাজার সমাজ মাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে ‘সাত জন্মের সাথী’ পোস্ট করেছিলেন। এর মাধ্যমে সবাইকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বামী বেঁচে রয়েছেন এই বার্তা দিতে এবং পরবর্তীকালে তদন্ত হলে যাতে তিনি রেহাই পান সেইজন্যই এই কৌশল নিয়েছিলেন সোনম।
ঠিক কীভাবে ঘটেছিল এই হত্যাকাণ্ড, তার ঘটনাক্রম নির্মাণ করেছেন তদন্তকারীরা। ২৩ মে, ভোর সাড়ে ৫টায় মেঘালয়ের নোংরিয়াটে শিপারা হোমস্টে ছেড়ে দেন রাজা রঘুবংশী এবং তাঁর স্ত্রী সোনম। সকাল ৬টায় নোংরিয়াট থেকে ট্রেকিং-এ বের হন রাজা-সোনম। শিপারা হোমস্টে থেকে কিছুটা দূরে আরও একটি হোমস্টেতে ছিলেন সোনমের ‘প্রেমিক’ রাজ কুশওয়াহার তিন বন্ধু আকাশ, বিশাল এবং আনন্দ। সোনমরা যখন হোমস্টে ছেড়ে ট্রেকিংয়ে বার হন, ঠিক ওই সময়েই পাশের হোমস্টে থেকে ট্রেকিংয়ে যান আকাশরা।
সকাল ১০টায় সোনম এবং রাজা নোংরিয়াটে ২০০০ সিঁড়ি ট্রেক করে ওঠেন। সেখানে দেখা হয়ে যায় সোনমের তিন সঙ্গী আকাশ, আনন্দ এবং বিশালের সঙ্গে। রাজার সঙ্গে ওই তিন জন পরিচয় করেন। এর পর তাঁরা একসঙ্গে আগে আগে হাঁটছিলেন। পিছনে ছিলেন সোনম। পুলিশ সূত্রে খবর, ৫ জনকে একসঙ্গে দেখতে পেয়েছিলেন স্থানীয় গাইড অ্যালবার্ট পেড। যাঁর বয়ান এবং তথ্যের ভিত্তিতেই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ।
দুপুর সাড়ে ১২টায় শাশুড়ি উমা রঘুবংশীকে ফোন করেন সোনম। উমাকে সোনম জানান, অনেকটা হেঁটে ক্লান্ত লাগছে তাঁর। ছেলে রাজার সঙ্গেও কথা বলেন উমা। আর সেটাই ছিল রাজার সঙ্গে তাঁর মায়ের শেষ কথা।
দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট। ৫ জন মিলে মাওলাখিয়াত থেকে ওয়েই সডং জলপ্রপাত দেখতে যান। সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় পৌঁছতেই সোনমের ইঙ্গিতমতো কাটারি নিয়ে পিছন থেকে রাজার মাথায় আঘাত করেন বিশাল। লুটিয়ে পড়েন রাজা। কিছু পরেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় রাজার। দুপুর সওয়া ২টোয় রাজার ফোন নিয়ে তাঁর সমাজ মাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করেন, ‘সাত জন্মের সাথী আমরা।’
দুপুর ২টো ৩০ এ সোনম এবং তাঁর তিন সঙ্গী রাজার দেহ খাদে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
মেঘালয় পুলিশ জানিয়েছে, সোনমের উদ্দেশ্য ছিল, রাজাকে জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা। প্রেমিক রাজকে বিয়ে করে সংসার পাতার জন্যই সমস্ত পরিকল্পনা সোনমের। ইন্দোর পুলিশের তরফে এডিসিপি রাজেশ দন্ডৌতিয়া জানিয়েছেন, সোনমের প্রেমিক রাজকে ইন্দোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। যেহেতু সোনম রাজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন, তাই পুলিশই রাজকে দিয়ে সোনমকে ভিডিও কল করায়। প্রেমিক পুলিশ হেফাজতে রয়েছে জানার পরই সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েন সোনম। তিনি বুধতে পারেন তাঁর আর পালানোর কোনও পথ নেই। পুলিশ তাঁকেও গ্রেপ্তার করবে এটা বুঝেই সোনম গাজিপুরের কাছে ধাবায় পৌঁছন এবং সেখান থেকে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে রাজাকে হত্যার পর কে তাঁকে ধাবায় রেখে এসেছিল, এবং সে কোথায় ছিল তা এখনও রহস্য।
জানা গিয়েছে, রাজা রঘুবংশীর সঙ্গে বিয়ের আগেই বয়সে অনেক ছোট পারিবারিক ব্যবসার কর্মচারী রাজ কুশওয়ার সঙ্গে প্রণয়ের কথা মাকে জানিয়েছিলেন সোনম। এমনকী তাঁরা যে বিয়ে করতে চান সেকথাও বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। রাজার বড় ভাই বিপিন রঘুবংশী সাংবাদিকদের একথা জানিয়েছেন। বিপিনের দাবি, সোনমের পারিবারিক এক বন্ধু তাঁকে জানিয়েছেন, সোনম রঘুবংশীর মা মেয়ের জোর করে বিয়ে দেন। কারণ তাঁরা একই কুলশীলের বলে। তিনি বিয়ের আগেই জানতেন, মেয়ে অন্য একজনের সঙ্গে প্রেম করে। শুধু তাই নয়, মেয়ে বিয়ের আগেই মাকে হুমকি দিয়ে বলে রেখেছিলেন, ‘এরপরে যা হবে, তার জন্য আমাকে দোষী করবে না।’ সোনমের সেসব কথায় পাত্তা না দিয়ে তাঁর বাড়ির লোক জানিয়ে দেন, তুমি যার সঙ্গে খুশি প্রেম করতে পারো। কিন্তু তোমায় বিয়ে করতে হবে নিজের জাতপাতের মানুষকেই।
অভিযুক্ত রাজ কুশওয়া অপরাধের কথা স্বীকার করে পুলিশকে জানিয়েছে, সোনম খুনের সময় সেখানেই ছিল এবং স্বামীকে সে নিজের চোখে খুন হতে দেখেছে। শুধু তাই নয়, খুনিরা শেষপর্যন্ত এই মারাত্মক কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাদের নগদ টাকা দেওয়ার কথা বলেন সোনম। খুনের পর হাতে নগদ টাকাও গুঁজে দেন সোনমই। সেই টাকাও দেওয়া হয় মৃত স্বামীর টাকার ব্যাগ থেকে বের করে।
পুলিশ আরও জানতে পেরেছে যে, সোনম হত্যার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় বিকল্পের কথাও ভেবে রেখেছিলেন। আর সেটা হল, শুনশান পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে গিয়ে সেল্ফি তোলার নাম করে স্বামীকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া। কিন্তু, বরাতজোরে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে, টাকার বিনিময়ে চোখের সামনে রাজাকে হত্যা করা চাক্ষুষ করতে চান।
রাজা রঘুবংশীর ভাই সচিন এবং বাবা অশোক রঘুবংশী সোনমের ফাঁসির সাজার দাবি করেছেন। সোনমের নিজের ভাই গোবিন্দও হত্যাকারীদের ফাঁসির সাজা চেয়েছেন। তবে তাঁর দাবি, সোনমের ভূমিকা নিয়ে কোনও ধারণাই ছিল না তাঁর।