বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা সোনালি বিবি ওরফে সোনালি খাতুন এবং তাঁর আট বছরের সন্তান সাবিরকে ভারতে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। বুধবার কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও একবার দেশে ফেরানোর নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। সেই সঙ্গে সোনালির সব রকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতে নিয়ে আসার পরে সোনালি এবং তাঁর সন্তানকে বীরভূমের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে স্থানীয় মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সোনালির যাবতীয় চিকিৎসা করবেন বলে জানায় আদালত।
সরকারি নিয়ম মেনেই সোনালিদের দেশে ফেরানো হবে বলে সুপ্রিম কোর্টে জানালেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। বাংলাদেশে থাকা বাকি চারজনকে দেশে ফেরানো নিয়েও কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে আদালতে। ১২ ডিসেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে। তার আগে যাবতীয় নথিপত্র যাচাই করে তা আদালতে জমা দিতে হবে।
Advertisement
বীরভূমের সোনালিকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ সংক্রান্ত মামলাটির বুধবার শুনানি ছিল দেশের প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্তের বেঞ্চে। এজলাসে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, দেশে ফিরিয়ে আনার পরে মানবিক কারণে সব রকম চিকিৎসার সুবিধা দিতে হবে সোনালিকে।
Advertisement
দেশে ফেরানোর পরে তিন চিকিৎসকের দল সোনালির চিকিৎসা করবে। বীরভূমের বাসিন্দা সোনালি বিবি অন্তঃসত্ত্বা, অ্যাডভান্স স্টেজ। বাংলায় কথা বলার জন্য তাঁকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল দিল্লি পুলিশ। অসম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করেছিল বিএসএফ।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে কেন্দ্রও জানায়, তাঁরা সোনালিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে রাজি। বাংলাদেশ থেকে সোনালিকে প্রথমে দিল্লিতে আনা হবে। সোনালি ভারতীয় কি না, তা যাচাই করা হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র। শুনানির একটি পর্যায়ে কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলে আদালত। প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত কেন্দ্রের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা আপনাদের কাজে বাধা দিচ্ছি না। তবে আপনাদের পদ্ধতি সঠিক নয়।‘
কেন্দ্রের কাজের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি বাগচীও। তিনিও কেন্দ্রের উদ্দেশে বলেন, ‘মামলাকারী ভদু শেখ ভারতীয় নাগরিক নন, এ কথা একবারও বললেনি। অর্থাৎ, ভদু শেখ ভারতীয়। তাঁর সন্তান সোনালি ভারতীয় নাগরিক। ভারতের নাগরিকত্বের যে নিয়ম রয়েছে সেই অনুযায়ী তো আপনারা কাজ করেননি।‘
এর আগে গত ২৫ নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি ছিল। সঠিক ভাবে যাচাই প্রক্রিয়া না করেই সোনালি এবং আরও পাঁচ জনকে কেন বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আদালতে। সোনালিদের বক্তব্য না শোনা নিয়েও আদালতের প্রশ্নের মুখে পড়েছিল কেন্দ্র। ওই সময়ে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলেছিল, ‘অনেক তথ্য রেকর্ডে রয়েছে। জন্মের শংসাপত্র, আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতেন এটাও এক ধরনের প্রমাণ। বক্তব্য না শুনেই আপনারা পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
এর পরেই বেঞ্চের মন্তব্য, ‘বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে প্রবেশের কারণে আপনারা পুশব্যাক করতেই পারেন। তা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। তবে এটা নিশ্চিত করতে হবে তিনি যেন দেশের নাগরিক না হন। কেউ যদি বলেন ভারতে জন্ম নিয়েছেন, এখানে ছোট থেকে বড় হয়েছেন তবে তাঁর অধিকার রয়েছে। তাঁর কথা শোনা উচিত।’
দিল্লিতে পরিচারিকার কাজ করতেন বীরভূমের মুরারইয়ের সোনালি বিবি। তাঁর সঙ্গেই কাজ করতেন সুইটি বিবি নামে আরও এক মহিলা। দিল্লিতে থাকতেন সোনালির স্বামী দানিশ, আট বছরের ছেলে সাবিরও। গত কয়েক মাসে ধরে ভিনরাজ্যে বাংলাভাষীদের নানা ভাবে হেনস্থার যে অভিযোগ উঠছিল, সেই আবহেই বাংলায় কথা বলায় সোনালিদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
সোনালি-সহ পাঁচ জনকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করা হয়। চলতি বছরের ২১ জুন দিল্লি থেকে ধরা হয় তাঁদের। ফরেনার্স রেজিস্ট্রেশন অফিস বা এফআরআরও অর্ডার নিয়ে ২৬ জুন তাঁদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়। সেখানকার জেলে রাখা হয় সোনালিদের। মামলা হয় আদালতে।
সুপ্রিম কোর্ট দেশে ফেরাতে বলে সোনালিকে। সোনালির জামিনের আবেদন মঞ্জুর হয় বাংলাদেশের আদালতেও। তার পরেও কেন অন্তঃসত্ত্বা একজন মহিলাকে ভিন দেশে ফেলে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরব হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সোনালির প্রেগন্যান্সির এখন অ্যাডভান্স স্টেজ। এই অবস্থায় ভিন দেশে প্রায় চার মাস ধরে জেলবন্দি ছিলেন! তাঁর বাবা-মা ভদু ও জ্যোৎস্নার নামও রয়েছে ২০০২ সালের এসআইআর-এ। এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়েছেন তাঁরা। সোনালির ভাই সুরজও এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করেছেন। পাইকরের ভোটার এই পরিবার। সুরজের জন্ম ১৯৯২ সালে। ফলে ২০০২-এর তালিকায় তাঁর নাম নেই।
ভারতের নাগরিক হওয়ার দাবি প্রথম থেকেই তুলছিলেন সোনালির বাবা এবং মা। মেয়েকে বাংলাদেশি বলে কীভাবে পুশ ব্যাক করা হল তা নিয়ে বার বার সরব হন তাঁরা। বুধবার সুপ্রিম কোর্টেও কার্যত সে একই প্রশ্ন করা হল। এখন কবে সোনালি বিবি দেশে ফেরেন, অপেক্ষায় বাবা ভদু শেখ, মা জ্যোৎস্না বিবি-সহ বীরভূমের গোটা পরিবার।
Advertisement



