স্মরণীয় সন্ধ্যার স্মৃতি ‘বাদাবন’

Written by SNS March 19, 2024 4:41 pm

অভীক মজুমদার

২৬ তারিখ রবিবার মিনার্ভা থিয়েটার থেকে বাড়ির দিকে যখন ফিরছিলুম, মনটা উথালপাথাল করছিল৷ সঙ্গে ছিল অর্ক দেব, ভাস্কর লেট৷ আমরা ‘বাদাবন’ দেখে বেরিয়ে নানা আলোচনায় মত্ত ছিলাম৷ আমরা অনেক কথা বলছিলাম৷ স্মরণীয় একটা সন্ধ্যা৷
ব্যক্তিস্তরে মিশেছিল একটা দীর্ঘশ্বাস৷ আমার মা-কে নাটকটি দেখাতে পারলাম না৷ তোমার স্ত্রী জানেন, মা নাটক দেখতে এতই ভালোবাসতেন যে প্রায়শই তাঁকে নিয়ে যেতাম বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে৷ মিনার্ভা বাড়ির কাছে৷ ফলে বহুবার৷ তোমার স্ত্রী শেষবার খুব সাহায্য করেছিলেন৷ ভোলবার নয়৷ আমরা, বাবার দিক থেকে, এপার বাংলার৷ মা ছিলেন বরিশাল থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ে৷ অন্য একটা সংস্কৃতি৷ অন্য একটা বেদনা৷ এ নাটক মায়ের জন্য৷ দেখাতে পারলাম না৷ খেদ মেটার নয়৷
দীর্ঘ নাটক৷ দু’ঘন্টা দশ-পনেরো মিনিট৷ আনকোরা, খ্যাতিহীন তরুণ-তরুণীদের অভিনয়, পুরোনোকোনো প্রখ্যাত নাটক নয়, সুদীপ সিংহের নাটক, নির্দেশক পৃথ্বীশ রাণা৷ কিন্ত্ত নাটক দেখতে দেখতে তারিফ করছিলাম পুরো পরিকল্পনার৷ মঞ্চায়ন, দৃশ্যরূপ এবং বিন্যাসের৷ শেষে যখন তুমি বলছিলে পৃথ্বীশ, ‘আমাদের সু্যোগ ছিল প্রতিষ্ঠিত তারকাদের নিয়ে এ নাটক করানোর, করি নি৷ আজ এদের নাম নেই৷ কাল নাট্যামোদীরা এঁদের নামে চিনবে৷’ তখন বোঝা যাচ্ছিল৷ শ্রেষ্ঠী অর্থ ব্যবসা চটক সফলতা নয়, এখানে চালিকাশক্তি দায়বদ্ধতা৷ যখন একটা বিশ্বাসকে দাঁতে দাঁত চেপে পরিবেশন করা হয়৷ ছোটো মুখে বড়ো কথা বলি, সবাই এখন রাজবাড়িতে দাঁতের মাজন বেচছেন৷ আগুন আর শিবের গাজন নিয়ে খুব মাথাব্যথা নোটোদের নেই৷ আমার ব্যক্তিগত মত৷ তোমাকে মানতেই হবে এমন কোনো দাবি নেই৷ পরিবর্তমান এই মুদ্রাযুগে আমি এইমুহূর্তে ‘দায়বদ্ধতা’ খুঁজি৷ জীবনানন্দকে মনে মনে আওড়ে চলি- ‘একজন বিপ্লবী তার সোনারূপা ভালোবেসেছিল’৷ অনেক দেবতার মূর্তির ভেতরের খড় দেখা হলো এ জীবনে পৃথ্বীশ, তোমাদের নাটক বেশ ঝাঁকুনি দিল৷ কিছুদিন যাবৎ বলছিলাম, আমাকেনিয়ে কমলকুমার মজুমদারের একটা উপন্যাস আছে- ‘অন্তর্জলী যাত্রা’৷ এ নাটক দেখার পর ভাবছি, ভুল বলতাম৷ সামান্য ক্ষমতায়, আরো দু-একবার কাশির দমক থামলে, বাঁচতে চেষ্টা করাই শ্রেয়৷ বয়স হলে, অলজ্জআত্মকথনের দিকে চলে যায় মানুষ, দেখতেই পাচ্ছো৷ ফিরে আসি ‘বাদাবন’ প্রসঙ্গে৷ এলোমেলো কিছু পর্যবেক্ষণ৷ হয়তো অগভীর, অর্থহীন- তবু বলি৷
১) নাটকের গোড়ার দিকে ‘কালচারাল হিষ্টরিক্যাল লোকেল’ কেন্দ্রে৷ বিলিতি ছবির সূত্রে ‘ডকু ফিচার’ শব্দটি আজ সুপরিচিত৷ নাটকে সেই ধরণের একটা প্রয়োগ চলতে থাকে৷ নিম্নবর্গের পুরাণ, আচার, পরব, ব্রত, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ, বিশ্বাস এবং যাপনের সঙ্গে তার বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধের মিথস্ক্রিয়া (আমার নিজস্ব তত্ত্ব নয়৷ Subaltern Studies II থেকে সংগৃহীত) স্পষ্টহয়৷ কোনো সরল সমাধান নয়, জটিল বহুমুখী তরঙ্গের উন্মোচন৷ এইসময় থেকেই নীলাঞ্জন গাঙ্গুলী, পান্না মন্ডল আর মৌমিতা দত্ত মুগ্ধ করতে থাকেন৷
২) নাটকের মধ্যে নাটকের অনুপ্রবেশ ঘটতেই শুরু হয় আরেক স্তরের ভোজবাজি৷ অভিনয় এবং সংলাপ উচ্চারণে খুলে যেতে থাকে একটার পর একটা মাত্রা৷ তার ওপর নারী চরিত্রে দাড়িওয়ালা পুরুষ আর পুরুষ চরিত্রে তেজস্বিনী নারীরা! ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যেতে পারতো৷ শিল্পে রূপান্তরিত হলো৷ মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে কথিত চিত্তপট-এর কথা৷ মনে হচ্ছিল ব্রেখ্টীয় বিয়োজন আর ‘আচ্ছন্নতা’ ভুলে ‘বিশ্লেষণ’-এর কথা৷ ঢুকে পড়ছিল নাগরিক বাস্তবতায় দুখের অলৌকিক গল্প৷ এই লৌকিক-অলৌকিক, বাস্তব-অবাস্তব, মঞ্চ বাদাবন মুখোশের বাঘ আর মানুষের সংঘর্ষময় অস্তিত্ব রচনা- ইতিহাস বর্তমানকে ছুঁয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছিল৷
৩) অনির্বাণ সরকারের মাস্টারকাকা, রাজ রাখালের কৌশিক এবার দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় স্তরে ঢোকে৷ কলকাতার বাবুসমাজ যেন প্রত্যক্ষ হয়৷ আসে শুটিং আর কৃত্রিম নির্মাণের মুখোশ৷ ভুলে না যাই, রানা গুহ, তন্ময় পাল, তনিমা মন্ডল, তিতুমীর দত্ত, সানন্দিতা দাশদের অকুন্ঠ সাধুবাদ প্রাপ্য৷ এভাবে নাম করে বলাটা বোধহয় ভুল হচ্ছে৷ তারা প্রত্যেকেই অনবদ্য৷ এটা একটা সুষম দলগত টানটান প্রযোজনা৷ পিয়ানোর এক-একটা রিড যেন৷ নির্দেশকের কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়৷ এইসব অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেভাবে দম দেওয়া ঘড়ির মতো নিখুঁত দক্ষতায়, অসামান্য দৈহিক নৈপুণ্যে মঞ্চে হৈ-হৈ ব্যাপার ঘটাচ্ছিলেন৷ একটা উৎসব-পরবের প্রৈতি (Energy), একটা সমবায়িক উপভোগ্যতার বিস্ফোরণ যেন! এই মিলিত ‘কার্নিভালেস্ক’ দায়বদ্ধতা ছাড়া অসম্ভব৷ অন্তত আমার মনে হচ্ছে৷
৪) মঞ্চ খুবই উচ্চমানের কল্পনা-প্রসূত৷ দুটি-তিনটি তল সযত্নে তৈরি করা হয়েছে৷ আলোর চমকপ্রদ ব্যবহারে তার নতুন নতুন কৌণিক ছায়ারূপ নির্মিত হয়েছে৷ সুরের আশ্চর্য সব মুভ্মেন্ট তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে৷ লোকায়তের ভাববিহ্বল প্রদর্শন নয়, যেন একটু দূরত্ব থেকে বিশ্লেষণী বিনির্মাণ৷ আজান, বাঘের গর্জন, শাঁখের আওয়াজ, স্টিমারের ভোঁ আর কৌশিকের বাবুবৃত্তান্ত বহুস্তরিক আর বহুশরিকের বাস্তবতা নিয়ে হাজির হচ্ছে৷ বহুস্বরেরও৷ বড়ো বিন্যাসের এমন নাটক খুব বেশি দেখি নি৷
৫) নির্দেশক খুব সতর্ক ছিলেন, একবগ্গা একমাত্রিক সরল ডিসকোর্সের ফাঁদে যাতে না পড়েন৷ ফলে যখনই রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বর্গ-বর্ণ-জাতি-রাজনীতি ঢুকে পড়েছে সংলাপে, তিনি যুক্তি-প্রতর্ক-পরিপ্রশ্নে দর্শককে অতিষ্ঠ করেছেন৷ যেন তাদের খোঁজার জন্য ছেড়ে রেখেছেন একটা স্পেস৷ মার্কসিস্ট মায়োপিয়ার সমস্যা এখানেই হয়৷ তাঁরা কিছুই দর্শকের হাতে ছাড়তে চান না৷ যদি তারা অন্য উত্তর আঁক কষে বার করেন৷ কখন কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না৷ ঐন্দ্রিলা চৌধুরীকে কৃতজ্ঞতা৷ তিনি জটিলতার নানা অভিমুখ ধরতে ধরাতে পারলেন৷ গ্রাম-শহরকে বহন করলেন অনায়াসে৷ আবার বলছি, এ একেবারে ভারসাম্যের শীর্ষে উঠে খেলা৷ যেকোনো সময় যেকোনো দৃশ্য একটু টাল খেলেই পুরো সৌধ ভেঙে পড়বে৷ সমবেত প্রয়াসে আশ্চর্য সব মুহূর্ত তৈরি হয়েছে৷ এক বিন্দু টাল খায় নি, কার্নিস বেয়ে হাঁটা৷
৬) গান এবং দুই নিরীহ বেড়া হঠাৎ শেষাংশে নতুন একটা তল নিয়ে ফেটে পড়ে৷ ভারত-বাংলাদেশ, দুপার বাংলা, তার স্মৃতি, মগ্নচৈতন্য, ইতিহাস, সাহিত্য, দাঙ্গা, স্বাধীনতা, আজগুবি মানচিত্র থেকে সে মোড় নিতে থাকে লাতিন আমেরিকা আফ্রিকা কানাডা স্লোভাকিয়া মায়ানমার হয়ে আজকের ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের দিকে৷ কার্পেন্তিয়ার মিশে যান নগিব মাহফুজ আর মান্টোর সঙ্গে, চুখতাই বা খুশবন্ত সিং মিশে যান হাসান আজিজুল হক হয়ে হুয়ান রুলফো আর ন্গুগি ওয়া থিয়ংগোর সঙ্গে৷
৭) এই মুহূর্তে হঠাৎ নগ্ন অ্যাটলাস দেখা দেন পশ্চাৎপটে, হাতে ঘূর্ণায়মান ভূগোলক৷ কার ইতিহাস? কার ভূগোল? কার সভ্যতা? কে আমার দেবতা? আধিপত্য আর কর্তৃত্বের কাড়া-নাকাড়া যেন চুরমার হয়ে যায়৷ প্রশ্নগুলো সজাগ থাকে৷ কে মানচিত্র আঁকছে? সে কোথায় থাকে? আমাদের লোকালয় আর লোকালয়হীনতা নির্ধারণ করে? এই সময় ওই ওপরের তলে ভ্রাম্যমাণ অভিযাত্রীদের দেখা যায়৷ এ শরণার্থী মিছিল, এই বাস্তুহারার ভিটেমাটি ছাড়ার ক্ষোভ বেদনা কতদূর অনুভব করছি আমরা? রণজিৎ গুহ-র তোলা প্রশ্নে একটু ভিন্ন প্রেক্ষিতে ফিরতে পারি আমরা৷ কতদূর হদিশ করা গেছে শরণার্থীর চৈতন্যকে? ভদ্রলোকের ‘নির্মাণ’-এ সাহিত্যে-নাটকে লোকায়ত-লোক, বাস্তুহারা, রিফিউজি দেখি আমরা৷ সে দেখায় একটা প্রশ্নচিহ্ন আর একটা সংশয়বোধক চিহ্ন জুড়ে দিতে পারলো এই নাটক৷ যাত্রা আর শহুরে রঙ্গনাট্য নিয়ে একটা স্পষ্ট দৃশ্যায়নের বিবৃতিও দিল৷ মঞ্চে এই প্রবাহ সমন্বয়ের উদ্যোগটিও মনে রাখার মতো৷ রানা বিশ্বাস, রূপম প্রসাদ এবং প্রলয় দত্ত তার প্রধান মাধ্যম৷
নিম্নবর্গ নয়, আমরা আসলে বুঁদ হয়ে দেখতে ভালোবাসি দিকুদের হাতে ‘নির্মিত’ নিম্নবর্গকে৷ বাবুরাম সাপুড়ের সাপ যেন৷ ‘সেই সাপ জ্যান্ত গোটা দুই আনতো/ তেড়েমেড়ে ডান্ডা করে দিই ঠান্ডা’৷ আমরা মধ্যবিত্ত মেধাজীবীরা সব জানি৷ সব সমাধান৷
৮) দুটি প্রতীকের ব্যবহার আলাদা করে বলবো৷
ক) চশমা দিয়ে শহর এবং কৌশিক নির্মাণ৷
খ) শেষে দৃশ্যের আগে স্থির হয়ে গেল সব৷ একদল নাকাড়া নিয়ে মূর্তি হলো, ঠিক যেন গণনাট্য সঙ্ঘের লোগো৷
কুর্নিশ নির্দেশককে৷ গোড়ায় চাকা-লাগানো নৌকাটিও চমৎকার৷
৯) একটা মতান্তরের কথা বলি৷ শেষপর্বে ডাক্তার দিদি স্রোতস্বিনী আর কৌশিকের প্রেমের দৃশ্য আমার এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে একটু বাড়তি৷ পরে মত পাল্টাতে পারে৷ তখন জানাবো৷ এখনো অবধি, হঁ্যা৷ বাড়তি৷
১০) কাঁটাতারে ঝুলছে মানুষ- গানটির সুরকারকে কুর্নিশ৷ গীতিকারকেও৷
দক্ষিণ দমদম সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রের সমস্ত কলাকুশলীকেও কুর্নিশ৷
আলাদা করে বলতেই হবে চালচিত্র থেকে দেবীর লোকবৃত্তে নামা এবং ফাঁকা চালচিত্রের অভ্যন্তরের বাস্তবতা নির্মাণ- অভিনব ভাবনা৷
পৃথ্বীশ, অনেক এলোমেলো কথা একনাগাড়ে বললাম৷ আরো কথা বলা যেত৷ সম্পাদনা করা ভালো৷ অতি আবেগ বর্জনীয়৷ এ লেখা ছেপো না৷ বাজে লেখা৷ শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘নিয়ন আলোয় পণ্য হলো যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত’৷ এ চিঠি ব্যক্তিগতই থাকুক৷ পরের নাটকে আমন্ত্রণ না করলে বুঝবো দর্শক হিসেবে আমি খুব খারাপ৷
ভালোবাসা৷৷