সোমবারের সেই সন্ধ্যা ছিল অন্য দিনের মতোই সাধারণ। কেউ ফিরছিলেন অফিস থেকে, কেউ অটোরিক্সা চালিয়ে বাড়ির পথে। লালকেল্লার সামনে তখনও ভিড়, রোজকার ব্যস্ততা। মুহূর্তের মধ্যেই সব শেষ। এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে থেমে গেল বারোটি প্রাণের যাত্রা।
মঙ্গলবার পর্যন্ত ৮ জনের দেহ শনাক্ত করা গেছে। বাকি দেহাংশগুলির পরিচয় জানার জন্য ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা সংগ্রহ করেছেন ডিএনএ নমুনা। লোক নায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ হাসপাতালের সামনে ভিড় করেছেন শোকাহত পরিবারের সদস্যরা। কারও চোখে কান্না, কারও মুখে অনিশ্চয়তা। কেউ খুঁজছেন নিখোঁজ স্বজনকে, কেউ কফিনবন্দী প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করছেন।
শনাক্ত হওয়া মৃতদের মধ্যে আছেন দিল্লি ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাসকর্মী অশোক কুমার (৩৪)। উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা অশোক কাজ সেরে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেই বন্ধু লোকেশ আগরওয়ালও মারা গিয়েছেন। অশোকের বাড়িতে এখন স্তব্ধ নীরবতা—দুই মেয়ে ও এক ছেলে হারিয়েছে বাবাকে।
দীনেশ মিশ্র, উত্তরপ্রদেশেরই আর এক বাসিন্দা, ১২ বছর ধরে থাকতেন দিল্লিতে। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সংসার। তাঁর দেহ শনাক্তের পর গ্রামের বাড়িতে শেষকৃত্যের আয়োজন চলছে।
শাস্ত্রী পার্কের রিক্সাচালক জুম্মানকে বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে দেখা গিয়েছিল চাঁদনি চক এলাকায়। তারপর আর কোনও খোঁজ মেলেনি। পরদিন সকালে হাসপাতালের মর্গে স্বামীর দেহ চিনে ফেললেন স্ত্রী তনুজা। মেয়েটি জামাকাপড় দেখে বলে উঠল—“এটাই আমার বাবা।” কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা।
মীরাটের মহসিন জীবিকার তাগিদে এসেছিলেন দিল্লিতে, গাড়ি চালাতেন। বিস্ফোরণের পর আর ফেরেননি। সামলির নোমান এসেছিলেন বন্ধুর সঙ্গে বাজার করতে, ফিরলেন কফিনবন্দী হয়ে। তাঁর বন্ধু আমান এখনও নিখোঁজ। নোমানের দেহ পৌঁছতেই দরজায় জ্ঞান হারান মা। বিহারের পঙ্কজ সাইনি, বয়স মাত্র ২২। চাঁদনি চকে যাত্রী নামিয়ে ফেরার পথে প্রাণ হারিয়েছেন তিনিও। তাঁর গ্রামের বাড়িতে এখন শোকের মিছিল।
শনাক্ত হয়নি চারটি দেহ। কারা তাঁরা? তাঁদের পরিবার কোথায়? উত্তর খুঁজছে প্রশাসন। এশিয়ান সোসাইটি ফর ইমার্জেন্সি মেডিসিনের প্রাক্তন সভাপতি ডঃ তামোরিশ কোলে জানান, মৃতদের শনাক্তকরণে নির্দিষ্ট মেডিকো-আইনি প্রোটোকল মেনে চলা হয়। প্রথমে ময়নাতদন্ত, এরপর উচ্চতা, ওজন, কঙ্কালের গঠন, দাঁতের ছাপ, ট্যাটু, পুরনো অস্ত্রোপচারের দাগ—সব লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর নেওয়া হয় হাই-রেজোলিউশনের ছবি, সংরক্ষণ করা হয় পোশাক, গয়না ও পরিচয়পত্রের মতো ব্যক্তিগত জিনিস। সবশেষে ডিএনএ প্রোফাইল মেলানো হয় পরিবারের দেওয়া নমুনার সঙ্গে। তবেই মেলে নিশ্চিত পরিচয়।
ঘটনাস্থলে এনএসজি-র সদস্যরা তদন্তে নেমেছেন। বিস্ফোরণের ধরন ও ব্যবহৃত বিস্ফোরকের প্রকৃতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সরকারি সূত্রের দাবি, এখনই সন্ত্রাসের ইঙ্গিত মেলেনি, তবে সব দিকেই তদন্ত এগোচ্ছে কেন্দ্রীয় সংস্থা, দিল্লি পুলিশ ও এনএসজি মিলিয়ে।দিল্লির আকাশে আজ ধোঁয়া নেই, তবু শোকের ছায়া ঘন। লালকেল্লার প্রাচীন প্রাচীরের নীচে শহর যেন নিঃশব্দে প্রশ্ন করছে—কে ফিরিয়ে দেবে হারানো মানুষগুলোকে? আর কতদিন লাগবে শেষ পরিচয় ফিরে পেতে?