বহুমখুী প্রতিভার অপর নাম —– ফাল্গুনী সান্যাল

Written by SNS February 6, 2024 3:37 pm

নিশীথ সিংহ রায়
টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে এই মূহুর্তে বহু প্রতিভাবান পরিচালক, চিত্র নাট্যকার, অভিনেতা রয়েছেন যাঁদের নানা কাজ আমাদের প্রতি মহুূর্তে মুগ্ধ করে চলেছে৷ কিন্ত্ত এমন খুব মানুষই আছেন যাদের মধ্যে পরিচালনা, চিত্রনাট্য রচনা, অভিনয়ের মতো বহুগুনের সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায়৷ এমনই একজন মানুষ হলেন ফাল্গুনী সান্যাল৷ এক বিকেলে ফাল্গুনীবাবুর সাক্ষাৎকার নিতে তাঁর উত্তর কলকাতার কুঠিঘাটের বাডি়তে পৌঁছে গেলেন আমাদের পত্রিকার প্রতিনিধি নিশীথ সিংহ রায়৷

প্রশ্ন: নমস্কার ফাল্গুনী বাবু৷ বাংলার দর্শক দীর্ঘদিন ধরেই আপনাকে ছোটোপর্দায় এবং বড়োপর্দায় অভিনেতা হিসেবে দেখে আসছে৷ অভিনেতা হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আপনি ছোটো পর্দায় পরিচালকের ভূমিকাও পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন৷ এই জগতে আসার শুরুটা আপনার কেমন ছিল যদি একটু বলেন৷

উত্তর : দেখুন সঠিকভাবে শুরুর কথা বলতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হয়৷ পাড়ায় যে ভাবে অ্যামেচার নাট্য চর্চা হয়, আমার শুরুটাও সেভাবেই৷ সেখানেই একদিন আমাকে নজর করেন যিনি, তিনিই আমার প্রথম অভিনয় গুরু বলা যেতে পারে৷ তাকে আড়াল থেকে এবার প্রকাশ্যে আনা দরকার৷ তিনি হলেন তপন গাঙ্গলুী৷ তিনিই আমার মধ্যে অভিনয়ের খিদেটা জ্বালিয়ে দেন৷ এরপর বিভিন্ন সখের নাটক আর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে চলতে থাকে অভিনয়ের অনুশীলন৷ এরই মাঝে একদিন আমার বন্ধু প্রবীর আমাকে জানায় যে রবীন্দ্রভারতীতে নাকি অভিনয় নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ আছে৷ ব্যাস, ভর্তি হয়ে গেলাম ওখানে উনিশশো চুরাশিতে৷ সেখান থেকেই এম এ পাশ করি অভিনয়ে৷ এখন তো ওখানেই অভিনয়ের শিক্ষক হিসেবে কাজও করছি৷

প্রশ্ন: পর্দায় আপনার আসা কবে?
উত্তর: এটাও ওই রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশোনার সুবাদেই৷ ওখানে থাকতেই একদিন শ্রদ্ধেয় পীযুষদা বললেন যে, দূরদর্শনের নানা প্রজেক্টের জন্য এমন একজনকে খোঁজা হচ্ছে যে চিত্রনাট্য লিখতে পারে৷ আমি যেহেতু এ বিষয়টা জানতাম তাই পীযুষদার পরামর্শ মেনে চলে গেলাম একদিন জগন্নাথ গুহর (জগাদা) কাছে৷ ছোটো পর্দা বলুন, সিনেমা বলুন, এসব ক্ষেত্রেই জগন্নাথ গুহ হলেন আমার আরেক গুরু৷ আমি দীর্ঘ দশ বছর তার সাথে থেকে কাজ শিখেছি৷ তার বকাঝকা, এমনকি মারধোর খেয়েছি৷ কারণ এসবের থেকে তার স্নেহ মিশ্রিত শেখানোর ব্যাপারটাই আমার কাছে বেশি ছিল৷ শ্রদ্দেয় অসিত বসু একদিন বলেন যে, আমাকে দিয়ে অভিনয় করানো যেতে পারে৷ সে কথা শুনে জগন্নাথদা আমাকে প্রথম ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসেন একজন অভিনেতা হিসেবে৷ সে সময় ‘সলিউশন এক্স’ নামে দূরদর্শনে তেরো পর্বের গল্প দেখান হতো৷ সেই গল্পে শ্রদ্বেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাডি়র পরিচারক হিসেবে আমার ছোটো পর্দায় আসা৷ প্রথম স্ক্রিন শেয়ার করার সুযোগ ঘটে এই মহান অভিনেতার সাথে৷ এরপর জগন্নাথদার পরবর্তী কাজ ‘মনোরমা কেবিনে’ অভিনয় করি৷ সেখানে আমার সহ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছিলাম চন্দন সেন, কৌশিককে (বাবান)৷ সেই সিরিয়ালের হাত ধরে আমার পরিচিতি বাডে়৷ লোকে চিনতে শুরু করে৷ এরপর বহু সিরিয়াল, মেগা সিরিয়ালে অভিনয় করতে করতে হায়দ্রাবাদে যাই নীতিশ রায়ের একটা সিনেমা ‘জামাই নম্বর ওয়ানে’ কাজ করতে৷ আজকের স্বনামধন্য পরিচালক শিবু অর্থাৎ শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি ছিল এটা৷

প্রশ্ন: সে সময় কি ই টিভি বাংলা এসে গেছে?
উত্তর :  না, না৷ ওই রামোজিতেই শুটিং চলাকালীন শ্রদ্ধেয় নীতিশ রায়ের মাধ্যমে জানতে পারি যে মিঃ রামোজি রাও বাংলায় একটা চ্যানেল খুলতে চলেছেন যেটার নাম হবে ই টিভি বাংলা৷ এই চ্যানেলেই প্রথম একটা মেগার পরিচালক হিসেবে কাজের সুযোগ পাই৷ এই মেগা সিরিয়ালটার নাম হলো ‘বনলতা বোর্ডিং’৷ যদিও এটার আগে নাম ছিল পান্থনিবাস৷ সে সময় আমার গুরু জগাদার (জগন্নাথ গুহ) হাতে তেমন কোনো কাজ না থাকায় আমি গুরুদক্ষিণা হিসেবে জগাদাকে পরিচালক হিসেবে কাজটা করার প্রস্তাব  দিই৷ আর আমি সহকারী হিসেবে প্রজেক্টটায় কাজ করি৷ সাথে একটা গুরুত্বপূর্ন চরিত্রে অভিনয় করি৷ কিন্ত্ত যে কোনো কারণেই হোক মাত্র বাহান্নটা এপিসোডের পর সিরিয়ালটা বন্ধ হয়ে যায়৷ এরপর নীতিশ রায়ের কাছে থেকে আরেকটা মেগা সিরিয়াল ‘মা মনসা’ করার সুযোগ পাই আমি৷ পরিচালক হিসেবে নীতিশ রায়ের নাম থাকলেও পুরো কাজটা আমাকেই করতে হয়৷ আর চিত্র নাট্যকার হিসেবে নিয়ে আসি আমার বন্ধু সুভাশিষ গাঙ্গুলিকে (মামু)৷ আমি গর্বের সাথে বলতে পারি যে আজকের ছোটো পর্দা এবং বড়ো পর্দার অনেক প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা অভিনেত্রীই সেদিন ওই মেগা সিরিয়ালটিতে কাজ করতে পেরে সমদ্ধৃ হয়েছিলেন৷ এই মেগাটিতে অভিনয় করেছিলেন দুলাল লাহিড়ী, রিতা দত্ত চক্রবর্তি, শংকর চক্রবর্তী, সোনালী চক্রবর্তী, চন্দন সেন, লকেট চ্যাটার্জি, সুভাশিষ ব্যানার্জি, শান্তিলাল মুখার্জীর মত অনেকে৷ এরপর ই টিভি বাংলা শুরু করে টেলিফিল্মের স্লট নিয়ে কাজ৷ আমি সেখানে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের দুটো গল্প নিয়ে কাজ করি৷ একটা ছিল ‘শাজাহানের জতুগৃহ’ আরেকটি ‘তনয়’৷

প্রশ্ন: তাহলে স্বাধীন পরিচালক হিসেবে আপনার প্রথম কাজ এই দুটি টেলি ফিল্মে?
উত্তর: হা, ঠিক তাই৷ এর মধ্যে আকাশ বাংলা চলে এসেছে৷ সেখানে সৌরভ সারঙ্গী আমাকে ডেকে একটি সিরিয়ালের কাজ দেয়৷ এই প্রজেক্টের নাম ছিল ‘মিঃ ফালতু’৷ গল্পটা ছিল সুভাশিষ গাঙ্গুলির৷ এটা ছিল অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরীর প্রথম সিরিয়াল৷ এখানেও নামী দামী অভিনেতারা কাজ করেছেন৷ একেকটা এপিসোডে একেকটা গল্প ছিল৷ এরপর আকাশ আটে অনেক কাজই করি৷ চ্যানেল এইটের সাথে যুক্ত হয়ে পুলিশ ফাইল, সোম থেকে শনি সাহিত্যের সেরা সময় এগুলোও পরিচালনা করি৷ আমি কৃতজ্ঞ স্বর্গীয় অশোক সুরানার কাছে৷ তিনি আমাকে একের পর এক কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন৷ এরপর জি বাংলা, স্টার জলসা এসে যাওয়ায় অভিনেতা হিসেবেও সেখানে অনেক কাজ করেছি৷ আর হ্যাঁ, ই টিভি বাংলায় ‘জনতা এক্সপ্রেস’ বলে একটা গেম শো করি যেখান থেকে কাঞ্চন অনেকটাই পরিচিতি পায়৷ আর প্লাস চ্যানেলে একটা কমেডি রিয়্যালিটি শো করেছিলাম যেটার নাম ছিল ‘হাসতে যাদের মানা’৷

প্রশ্ন: আপনি তো পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়টাও করে গেছেন নিয়মিত?
উত্তর: একদম তাই৷ অভিনয়টা আমার প্রাণের জিনিস৷ দূরদর্শনের অনেক সিরিয়াল জি বাংলা, স্টার জলসার সিরিয়াল, এছাড়া প্রচুর ফিল্মের কাজও করেছি৷ ‘রাখী পূর্ণিমা’, ‘বাডি়ওয়ালী’, ‘ঠাম্মার বয়ফ্রেন্ড’ এরকম অনেক ছবিতেই কাজ করেছি৷ এখনো করে চলেছি আপনাদের ভালোবাসায়৷

প্রশ্ন: আপনি তো একজন অভিনয় প্রশিক্ষকের ভূমিকাও পালন করে চলেছেন?
উত্তর: হ্যাঁ, বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে চলেছি৷ নতুন ছেলে মেয়েদের অভিনয় শেখাতে ভালো লাগে৷

প্রশ্ন: সিনেমা বানানোর কোনো পরিকল্পনা আছে?
উত্তর: চেষ্টা তো চলছেই৷ এখন যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো গৌরী সেনের দেখা পাচ্ছি ততক্ষন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারছি না (হাসি)৷

প্রশ্ন: হিন্দিতেও তো আপনি কাজ করেছেন?
উত্তর : ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম৷ সুদীপ্ত চ্যাটার্জির সহযোগী পরিচালক হিসেবে ‘নাম গুম যায়ে গা’ বলে একটা সিরিয়ালে কাজ করেছি ৷ সেখানে হেমাজি অভিনয় করেছিলেন৷

প্রশ্ন: এতগুলো মাধ্যমে কাজ করেছেন আপনি৷ এর মধ্যে কোন মাধ্যমে কাজ করে আপনি সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছেন?
উত্তর : অবশ্যই মঞ্চ৷ মঞ্চের ওই অনুভূতি অন্যত্র পাওয়া যায় না৷

প্রশ্ন : এই প্রজন্মের অভিনেতা, পরিচালক এদের কাজ আপনার কেমন লাগে?
উত্তর: দেখুন আমি তো চার দশকেরও বেশি অনেকের সাথেই কাজ করেছি৷ আজকের ছেলেমেয়েরাও কিন্ত্ত খুব ভালো কাজ করছে৷ এদের মধ্যে অনেকেই তৈরি হয়ে এখানে আসছে৷ আশা করি আগামীদিনে আমরা এদের কাছ থেকে প্রচুর ভালো কাজ পাবো৷