ভারতের ফুটবল হারাল ‘চুনী’

মা’কে ছাড়া ছেলে যেমন অচল, ঠিক তেমনই মােহনবাগান ছাড়া চুনী ছিলেন পুরােপুরি অচল। তাই তাে কখনাে অন্য ক্লাবের হয়ে খেলার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

Written by Souren Dutta Kolkata | May 1, 2020 8:40 pm

চুনী গােস্বামী (File Photo: IANS)

চিরবিদায় চুনী… কখনাে ভুলব না আপনাকে… স্মরণে নয়, আপনি আমাদের হৃদয়জুড়ে রয়ে যাবেন সারাজীবন। শুধু ফুটলই নয়, ক্রিকেটেও দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন একটা সময়। জাতীয় দলে খেলার পাশাপাশি শতাব্দী প্রাচীন ক্লাব মােহনবাগানেও খেলেছেন। মায়ের মতন দেখতেন মােহনবাগানকে। মা’কে ছাড়া ছেলে যেমন অচল, ঠিক তেমনই মােহনবাগান ছাড়া চুনী ছিলেন পুরােপুরি অচল। তাই তাে কখনাে অন্য ক্লাবের হয়ে খেলার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

এমনকি ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটসম্পার দলের হয়ে খেলার সুযােগ এসে গিয়েছিল চুনীর কাছে। কিন্তু মায়ের মতন মােহনবাগানকে ছেড়ে বিদেশের মাঠে খেলতে যাওয়ার লােভটা তিনি সেদিনই ত্যাগ করেছিলেন। মােহনরত্ন চুনী শিখিয়ে দিয়েছিলেন দেশের হয়ে খেলাটাই গর্বের, বিদেশে যাওয়াটা নয়। ১৯৬৩ সালে অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত আর ১৯৮৩ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হন। ২০০৫ সালে মােহনবাগান রত্ন হিসাবে সম্মানিত হয়েছিলেন।

প্রয়াত চুনী গােস্বামীর পরিবারের তরফ থেকে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার যােধপুর পার্কের ফ্ল্যাটেই ছিলেন অসুস্থ চুনীবাবু। দুপুরে পর পর দু’বার হার্ট-অ্যাটাক হয় তাঁর। এরপরই স্থানীয় একটি বেসরকারি নার্সিংহােমে তড়িঘড়ি তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর বিকেল পাঁচটা নাগাদ আরও একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তারপরই সব শেষ হয়ে যায়।

আত্মীয় পরিজনদের চিরবিদায় জানিয়ে ইহলােকের মায়া ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী ও ছেলে সুদীপ্ত প্রত্যেকেই শােকে বাক্যহারা হয়ে যান। তাঁর মৃত্যুর খবরে শােকের ছায়া নেমে এসেছে ময়দানে। যে ময়দানে একটা সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন, সেই ময়দানকেই চিরতরে বিদায় জানিয়ে সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন চুনীবাবু।

সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের মধ্যে প্রথম যে নামটি ভেসে ওঠে তিনি হলেন চুনী গােস্বামী। তাঁর খেলার চরিত্রটাই ছিল একেবারে ভিন্নধর্মী। কারাের সঙ্গে তুলনা করা যেত না। মাত্র আট বছর বয়সে কলকাতার মােহনবাগান জুনিয়র দলে তাঁকে নিয়ে আসেন মােহনবাগানের অভিভাবক বলাই চট্টোপাধ্যায়।

১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের কিশােরগঞ্জে তাঁর জন্ম হলেও, কলকাতা ময়দান তাঁকে অন্যভাবে সবার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। চুনী গােস্বামীর আসল নাম সুবিমল গােস্বামী। কিন্তু, ফুটবল জগতে চুনী নামেই তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। জাতীয় ফুটবল থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর ফুটবলের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়।

কলকাতা ময়দানে যতদিন খেলেছেন ততদিন তিনি মােহনবাগানেই খেলেছে। কোনও দিন ভাবতে পানেনি শতাব্দীপ্রাচীন মােহনবাগানকে ছেড়ে তিনি অন্য কোনও দলে খেলবেন। মােহনবাগান দলের হয়ে তাঁর খেলা শুরু হয়েছিল ১৯৫৬ সাল থেকে। তিনি যতদিন মােহনবাগানে খেলেছে ততদিন চুনী গােস্বামী নামেই গ্যালারি পরিপূর্ণ হয়ে যেত। তিনি চারবার মােহনবাগান ক্লাবের অধিনায়ক হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক।

মাত্র একটা মাস… ভারতীয় ফুটবলের আকাশে দুই নক্ষত্রের পতন। এক মাস দশ দিন আগেই কিংবদন্তী ফুটবলার ও কোচ প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সকলকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, এবার সকলকে বিদায় জানালেন আমাদের আরাে এক প্রিয় ফুটবলার চুনী গােস্বামী। শােকস্তব্ধ ময়দান। বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় একটি বেসরকারি নার্সিংহােমে হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন চুনী, এতােদিন ধরে কঠিন লড়াই চালিয়ে শেষপর্যন্ত বিরাশি বছর বয়সে সকলকে চিরবিদায় জানালেন। তাঁর মৃত্যুতে শােকের ছায়া নেমে এসেছে ভারতীয় ফুটবল মহলে। ভারতীয় ফুটবলের একটা দিকবার্তা ছিলেন প্রয়াত চুনী গােস্বামী।

তাঁর অধিনায়কত্বেই ১৯৬২ সালে ভারতীয় ফুটবল দল এশিয়ান গেমসে সােনার পদক জয় করেছিল। জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে পঞ্চাশটি ম্যাচ খেলেছিলেন, ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। দেশের জার্সি গায়ে এগারােটি গােল করছিলেন এবং বলে রাখা ভালাে এশিয়া কাপে তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৬৪ সালে ভারত রুপাের পদক জয় করেছিল। বাংলা ফটকল দলের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতেও খেলেছিলেন। শুধু ফুটবলই নয়, ক্রিকেটেও দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন এই বর্ষীয়ান তারকা। বাংলা দলের হয়ে ৪৬’টি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও খেলেছিলেন, ১৯৬২ এবং ১৯৭৩ সালে।

ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলেছেন। কিন্তু প্রয়াত চুনীবাবু ক্রিকেটটা সেভাবে না খেললেও, ফুটকলটাকেই একটা সময় আপন করে নিয়েছিলেন। রঞ্জি দলেও সুযােগ পেয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলা দল ফাইনালেও পৌঁছেছিল। কিন্তু ক্রিকেট তাঁকে বেশি টানতে পারেনি, যতটা ফুটবল তাঁকে নিজের করে নিয়েছিল।

২০ মার্চ পিকের মৃত্যুর খবর শােনার পর কিছুটা মানসিক দিক দিয়েও ভেঙে পড়েছিলেন চুনী। কাউকে কিছু বলতে না পারলেও, পিকের মৃত্যুটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। করােনার আতঙ্কে প্রিয় বন্ধুর শেষযাত্রায় উপস্থিত থাকতে পারেননি চুনী গােস্বামী। সত্যিই ভাবতেও অবাক লাগে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দুই বন্ধুর চিরবিদায়। দুই নক্ষত্রের পতনে ভারতীয় ফুটবল যেন পিতৃহারা হয়ে গেল।