অসমের সাংস্কৃতিক জগতের ‘আইকন’ জুবিন গর্গের আকস্মিক মৃত্যু এখন রীতিমতো আইন বিভাগ ও রাজনীতিতে প্রবল ঝড় তুলেছে। সিঙ্গাপুরে নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে গিয়ে নৌকাভ্রমণের সময় তিনি সমুদ্রে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনায় সংগীতপ্রেমী থেকে সাধারণ মানুষ, গোটা অসম জুড়ে শোকের পাশাপাশি দায়িত্বহীনতার অভিযোগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে।
অসম সরকার জানিয়েছে, উৎসবের মুখ্য আয়োজক শ্যামকানু মহন্ত এবং শিল্পীর ম্যানেজার সিদ্ধার্থ শর্মার বিরুদ্ধে যে একাধিক এফআইআর রাজ্যের বিভিন্ন থানায় দায়ের হয়েছে, সবকটিই সিআইডির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা শনিবার ঘোষণা করেন, ‘ডিজিপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সমস্ত অভিযোগ একত্রিত করে একটি মামলা হিসেবে সিআইডিকে তদন্ত করতে।’
Advertisement
সিঙ্গাপুরেই জুবিনের দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। শনিবার এই তথ্য দিয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী। সেখান থেকে এবার দেহ গুয়াহাটিতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে বলে সূত্রের খবর। এদিন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা শিল্পীর প্রয়াণে তিনদিনের শোক ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ ২০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে পালিত হবে এই রাষ্ট্রীয় শোক। এই সময়সীমায় সরকারি সব অনুষ্ঠান, উৎসব ও গণউৎসব বন্ধ থাকবে। তবে ‘সেবা সপ্তাহ’-র অধীনে জরুরি পরিষেবা ও প্রাথমিক কার্যক্রম চালু থাকবে। কিন্তু কোনও ধরনের সাংস্কৃতিক বা বিতরণ অনুষ্ঠান স্থগিত থাকবে।
Advertisement
জানা গিয়েছে, জুবিন গর্গ শুক্রবার সিঙ্গাপুরে স্থানীয় প্রবাসী অসমীয়াদের সঙ্গে ইয়টে ওঠেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একাধিকবার লাইফ জ্যাকেট পরার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তা মানেননি। সেই অবস্থাতেই তিনি সাগরে পড়ে যান এবং বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণনা জনমানসে গভীর প্রভাব পড়েছে।
আয়োজক শ্যামকানু মহন্ত দাবি করেছেন, ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ ইয়ট ভ্রমণের ব্যাপারে জানতই না। জুবিন স্থানীয় অসমীয় বন্ধুদের সঙ্গেই গিয়েছিলেন। যদিও এই ব্যাখ্যা জনরোষ প্রশমিত করতে পারেনি। বহু মানুষ মনে করছেন, শিল্পীর নিরাপত্তায় স্পষ্ট গাফিলতি ছিল।
সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই হাজার হাজার ভক্ত গুয়াহাটির শিল্পীর বাড়ির সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন। কেউ গান গেয়ে, কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে, কেউবা চোখের জল ফেলেই প্রিয় শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। সামাজিক মাধ্যমে উপচে পড়ছে আবেগঘন স্মৃতি আর তীব্র ক্ষোভের বার্তা।
প্রসঙ্গত, অসমবাসীর কাছে জুবিন গর্গ কেবল গায়ক নন, তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের প্রাণস্পন্দন। তিনি আঞ্চলিক গানে যেমন মুগ্ধ করতেন, তেমনই বলিউডে ‘ইয়া আলি’র মতো গান তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলেছিল। রাজনীতি, সমাজ ও পরিবেশ নিয়েও তিনি ছিলেন সরব, জনমনে ছাপ ফেলেছিলেন বহুমাত্রিক কণ্ঠস্বরের কারণে।
মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাঁর এই অকাল প্রয়াণ পরিবারের কাছে আরও বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে। কারণ ২০০২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান জুবিনের ছোট বোন, প্রতিশ্রুতিশীল গায়িকা জংকি বর্ধন। একই পরিবারে ফের আর এক সুরের তারকার উপর মৃত্যুর হাতছানি, রাজ্যের শোক যেন আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সিআইডি এখন খতিয়ে দেখবে, ইয়ট ভ্রমণের সময় নিরাপত্তা বিধি মানা হয়েছিল কি না এবং দায় কার উপর বর্তায়। ভক্তদের কাছে এই তদন্ত শুধু দোষারোপ নয়, সত্য জানার লড়াই। গুয়াহাটিতে এক শোকাহত ভক্তের কথায়, ‘তাঁকে আমরা ফেরাতে পারব না, কিন্তু সত্যটা জানতেই হবে। সেটাই হবে ওর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাঞ্জলি।’
Advertisement



