অবসরের ঠিক কয়েক দিন আগেই তফসিলি জাতিভুক্তদের সংরক্ষণনীতি নিয়ে ফের বিতর্ক ছড়িয়ে দিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি ভূষণ রামকৃষ্ণ গাবাই। বছর খানেক আগে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণ নিয়ে তাঁর মন্তব্যকে ঘিরে সমালোচনা শুরু হয়েছিল। এ বার আর্থিক মানদণ্ডকে ভিত্তি করে তফসিলি জাতিভুক্তদের মধ্যেই ‘অবস্থাপন্ন’ অংশকে সংরক্ষণের বাইরে রাখার পক্ষে মত দিয়ে নতুন করে বিতর্ক বাড়ালেন তিনি।
সম্প্রতি একটি আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতি গাবাই বলেন, তফসিলি জাতিভুক্ত কেউ যদি দেশের উচ্চতম প্রশাসনিক পদে পৌঁছতে পারেন, তাঁর পরিবারকে সংরক্ষণের সুবিধার আওতায় রাখা আদৌ যুক্তি সঙ্গত নয়। তাঁর কথায়, একজন ক্ষমতাশালী সরকারি আধিকারিকের সন্তান যে পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, সাধারণ ক্ষেতমজুরের সন্তানের সেই পরিসর থাকে না। এই বৈষম্য দূর করতে হলে সংরক্ষণনীতি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।
Advertisement
কিন্তু এই যুক্তিকে ‘বাস্তবতা-বিবর্জিত’ বলে কটাক্ষ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তফসিলি জাতিভুক্ত নেতানেত্রীরা। আরামবাগের তৃণমূল সাংসদ মিতালি বাগের প্রশ্ন, তফসিলি জাতিভুক্তদের মধ্যে এমন কতজন আছেন, যাঁরা উচ্চস্তরের প্রশাসনিক পদে পৌঁছেছেন? বিভিন্ন সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি দাবি করেন, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সামাজিক বৈষম্য ও নির্যাতন পুরোপুরি দূর হয়নি। এই বাস্তবতায় অবস্থাপন্নদের বাদ দেওয়ার যুক্তি মানা যায় না।
Advertisement
বুধবার সংসদের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন বিষয়ক স্থায়ী সমিতির বৈঠকেও বিষয়টি পরোক্ষভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। বৈঠকে বিরোধী সাংসদরা অভিযোগ করেন, তফসিলি জাতিভুক্তদের জন্য যে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তার তথ্য সময়মতো জানানোই হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি পৌঁছচ্ছে না। তাঁদের মতে, নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
রানাঘাটের প্রাক্তন সাংসদ ও সামাজিক ন্যায় বিচার মঞ্চের নেতা অলকেশ দাস মনে করেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্য বাস্তব তথ্যের উপর নির্ভর করছে না। তাঁর প্রশ্ন, তফসিলি জাতিভুক্তদের মধ্যে প্রকৃত ‘অবস্থাপন্ন’ অংশের সংখ্যা ক’জন? এই তথ্য কেউ দিতে পারবেন না। তিনি জানান, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ক্ষেত্রেও একই ধরনের ‘অবস্থাপন্ন শ্রেণি’ আলাদা করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু রোহিণী কমিশনের রিপোর্ট বলছে, অনগ্রসরদের ২২টি সম্প্রদায় এখনও কোনও সুবিধাই পায়নি।
পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাডেমির প্রধান এবং তৃণমূল বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী সরাসরি মন্তব্য না করলেও সামগ্রিক অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সমাজের দলিত অংশকে খণ্ডিত করার নানা কৌশল বহুদিন ধরে চলে আসছে, যা এখনও অব্যাহত।
তবে প্রশাসনিক মহলের একাংশের মত আবার ভিন্ন। তাঁদের মতে, গাবাই নিজে তফসিলি জাতিভুক্ত সমাজের সন্তান। মহারাষ্ট্রের আমরাবতীর একটি সাধারণ বিদ্যালয় থেকে জীবনের পথ শুরু করেও তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে আরও গভীর ও কার্যকর করতে কীভাবে যুক্তি সাজাতে হয়, তা তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, তফসিলি জাতিভুক্ত পরিবারের আর্থিক ভাবে শক্তিশালী অংশ যদি সংরক্ষণের সুবিধা পান এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা কোনও সাধারণ পরিবার কেবল ‘তফসিলি’ না হওয়ায় বঞ্চিত হন, তবে সংরক্ষণের মূল দর্শনটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
ফলে অবসরের আগে সংরক্ষণ প্রশ্নে এমন মন্তব্য দেশে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দেশের দ্বিতীয় দলিত প্রধান বিচারপতি হিসেবে গাবাইয়ের বক্তব্য সমাজ-রাজনীতিতে কী প্রতিক্রিয়া আনে, তা এখন দেখার অপেক্ষা।
Advertisement



