ওড়িশা জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আতঙ্কের পরিবেশ। প্রশাসনের অমানবিক চিত্র ফুটে উঠেছে রাজ্যের একাধিক এলাকায়। বাংলার ৩৬ জন পরিযায়ী ওড়িশায় কয়েকদিনের বন্দিদশা কাটিয়ে বাড়ি ফিরলেও তাঁদের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। ওড়িশা জুড়ে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণের অস্থায়ী ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ থেকে মুক্তি পেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকরা। অভিযোগ, বাংলায় কথা বলার ‘অপরাধে’ তাঁদের উপর যখন ওড়িশা পুলিশের অত্যাচার চলছে, তখনই ১০-২০ বছর কাজ করা ঠিকাদাররা মুখ ফোটাননি। তাঁদের মৌনতা নিয়েও ক্ষোভ উগরে দিলেন রুজিরুটির জন্য গত কয়েক বছর ভিন্রাজ্যে থাকা ওই যুবক ও প্রৌঢ়রা।
ওড়িশার ঝাড়সুগুদা, জগৎসিংহপুর, জাজপুর, কেন্দ্রপাড়া, কোরাপুট, ভদ্রক জেলার একাধিক জায়গায় অস্থায়ীভাবে তৈরি হয়েছে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প।’ জগৎসিংহপুর জেলার ১৫টি থানার মধ্যে ১২টিতে চলছে অস্থায়ী শিবির। বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের কোথাও তিন দিন, আবার কোথাও তিন সপ্তাহ আটকে রাখা হয়। এরকমই একটি ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ প্রায় দশ দিন বন্দি থাকার পর মুক্ত নদিয়ার নুরসেলিম শেখ, আনোয়ার হোসেনরা জানাচ্ছেন, সকালের খাবারে চিঁড়ে আর গুড় দেওয়া হত। অর্ধেক চিঁড়েতে পোকা ভর্তি। দু’বেলা ডাল-ভাত আর আলু সেদ্ধ দেওয়া হত। তবে সে খাবারও সকলে পাননি। ডিটেনশন ক্যাম্পের মেঝেয় কাপড় বিছিয়ে শুতে হত। আতঙ্ক ও ভয়ে দু’চোখের পাতা এক হত না তাঁদের। যাঁরা আটকে আছেন, তাঁদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা।
বাংলাদেশের রাজশাহি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর জেলা সম্পর্কে একাধিক প্রশ্ন করা হয় বন্ড পেপার দেখে। ওড়িয়া টানের বাংলা উচ্চারণে বার বার জানতে চাওয়া হয়েছিল, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাগমারা, গোদাগাড়ি, শিবগঞ্জ, নাটোর, গুরুদাসপুর এলাকায় পরিচিত কেউ রয়েছেন কি না। এমনকি আগে সেখানে কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। জবাব ‘হ্যাঁ’ হলেই উত্তরদাতাদের চিহ্নিত করে নিয়ে যাওয়া হয় আলাদা ঘরে। শুরু হয় বাংলাদেশি প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা। আর যাঁদের উত্তর ‘না’, তাঁদের উপরে শুরু হয় মানসিক অত্যাচার। কখনও শারীরিক নির্যাতনও করা হয়।
রাকিবুল ইসলাম, সাইনুল ইসলাম ও হাসিবুল শেখ হলেন মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থানার তোক্তিপুরের তিন বাসিন্দা। তাঁরা ওড়িশার জগৎসিংহপুর জেলার বালিগোদা থানায় দীর্ঘ দিন ধরে ঠিকাদারের অধীনে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁদের দাবি, ২০ বছর আগে স্থানীয় এক ঠিকাদারের হাত ধরে প্রথম ওড়িশা গিয়েছিলেন। তার পর দীর্ঘ দু’দশক তাঁদের সেখানেই কেটেছে। ভিন্রাজ্যের অনেক ঠিকাদারের সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক সম্পর্কও তৈরি হয়।
কিন্তু চলতি সপ্তাহেই ঘটে বিপত্তি। হঠাৎই এক দিন ওড়িশা পুলিশের তিনটি ভ্যান তাঁদের কাজের জায়গায় উপস্থিত হয়। শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার ‘অপরাধে’ হরিহরপাড়ার তিন শ্রমিক-সহ মোট ৩৬ জনকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাকিবুলের দাবি, তাঁদের কথা বলার কোনও সুযোগই দেওয়া হয়নি। ওড়িয়া ঠিকাদারদের বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তাঁরা নীরব দর্শক থেকেছেন।
রাকিবুল জানিয়েছেন, তাঁর কাছে পাসপোর্ট, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড— সমস্ত পরিচয়পত্র ছিল। তা সত্ত্বেও দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জানতে চাওয়া হয়, তিনি পাসপোর্ট কেন করেছেন! বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর কত দিনের যোগাযোগ ইত্যাদি। এমনকি তাঁর বাবা-মায়ের জন্ম কোথায় হয়েছে, কী করতেন, সে সবও জানতে চাওয়া হয়। তার পর বাড়ির লোকের কাছ থেকে ১৯৭৫ সালের আগের জমির দলিল চাইতে বলে পুলিশ। সব কিছু জোগাড় করে দিলেও তাঁদের কপালে জুটেছে পুলিশের খারাপ ব্যবহার।
সাইনুল শেখ নামে আর এক পরিযায়ী শ্রমিক জানান, তাঁরা ২০ বছর ধরে ওড়িশার ঠিকাদারদের কাছে কাজ করছেন। তাঁরা তো জানেন যে, তাঁরা বাংলাদেশি নন। ওদের ভাষায় ওরা পুলিশকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারতেন। কিন্তু একদম চুপ করে ছিল।