• facebook
  • twitter
Sunday, 14 December, 2025

দুই বাংলার শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সনজীদা খাতুনের প্রয়াণ

সনজীদার ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে বিশ্বভারতী থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

শিল্পী সনজীদা খাতুন। ফাইল চিত্র

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব যিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে মানুষের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং ক্রমশ এক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন, সেই সনজীদা খাতুন প্রয়াত হয়েছেন ঢাকার ‘স্কয়ার’ হাসপাতালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার অবিচ্ছেদ্য প্রেরণা। সঙ্গীত থেকে সাহিত্যে ছিল তাঁর সাবলীল বিচরণ। বাঙালির আত্মপরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর লড়াই ছিল আজীবন। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ– বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) সবচেয়ে প্রতিকূল সময়ে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, আন্দোলনে কখনো পেছনে থাকেননি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াও ছিল শাসকের চোখে অন্যায়। সেসময় যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানকেই নিজেদের প্রতিবাদী জীবনের পাথেয় করে তুলেছিলেন, তাঁদেরই অন্যতম সনজীদা খাতুন। ১৯৬৩ সালে  ‘ছায়ানট’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাও এই কারণেই। তিনি ছিলেন ওই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছিলেন তার সভাপতি।

গত ষাটের দশকে বাঙালি জাতির গণজাগরণের উত্তাল সময়ে  ‘ছায়ানট’ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক যাত্রাপথের দিশারী। পরবর্তী সময়ে, স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের প্রতি অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলা সংস্কৃতিকেই হাতিয়ার করে তুলেছিল এই সংস্থা। বাংলাদেশে রবীন্দ্র ভাবনা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন ‘ছায়ানট’-এর প্রাণপুরুষ ওয়াহিদুল হক। তিনি ছিলেন সনজীদা খাতুনের স্বামী। ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুর পর ‘ছায়ানট’-এর সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন সনজীদা।  ‘ছায়ানট’ বরাবরই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিল। তার প্রমাণ দেখা গিয়েছিল ২০০১ সালের বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে (বাংলা ১৪০৮ সালের পয়লা বৈশাখ) ধর্মান্ধরা সরাসরি আক্রমণ করেছিল এই অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে। রমনার বটমূলে বর্ষবরণের এই অনুষ্ঠানে জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১০ জন, আর আহত ২০ জন। কিন্তু তারপরেও ছায়ানটের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। পয়লা বৈশাখের ভোর থেকেই রমনার বটমূলে প্রায় চার-পাঁচশো শিল্পীদের নিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুলগীতি ও অন্যান্য বাংলা গানের যে অনুষ্ঠান, তার নেতৃত্বে থাকতেন সনজীদা।

Advertisement

সনজীদার পিতা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বিখ্যাত বিদ্বান ও জাতীয় অধ্যাপক। সনজীদার ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে বিশ্বভারতী থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৭৮ সালে বিশ্বভারতী থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

Advertisement

রবীন্দ্র চর্চার কারণে বেশ কয়েকবছর তাঁর কেটেছে শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন প্রমুখ কিংবদন্তি শিল্পীদের। বিশ্বভারতী তাঁকে প্রদান করেছে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মান। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করেছে। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেছে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ, ধ্বনি থেকে কবিতা, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনের দিনগুলি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রথম সারির এই ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান হয় মঙ্গলবার বেলা তিনটে নাগাদ ঢাকার ‘স্কয়ার’ হাসপাতালে। তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বাংলাদেশের এই অস্থির সময়ে তাঁর চলে যাওয়া বাংলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি। বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় ‘ছায়ানট’ সংস্কৃতি ভবনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।

Advertisement