• facebook
  • twitter
Friday, 13 December, 2024

সংস্কৃত শব্দ ‘চিকিৎসক’ থেকে উদ্ভুত ‘চাঁদসি’ ডাক্তার: শুভ্র চক্রবর্তী

অভিজিৎ ভট্টাচার্য: বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অধিকার ও বৈশিষ্ট্যের জন্য ভারতবর্ষ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুখ্যত পরিচিত৷ বিশ্বের প্রচলিত জৈব ওষুধ ভাণ্ডারে সবিশেষ অবদান বহন করে আমাদের দেশ, পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যেও আমাদের দেশের বিশাল অবদান স্বীকৃত৷ নিঃসন্দেহে পশ্চিমী সভ্যতা স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, কিন্ত্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এক্ষেত্রে ভারতের ঐতিহাসিক অবদান ব্যাপক৷ প্রাচীন ভারতীয় স্বাস্থ্য

অভিজিৎ ভট্টাচার্য: বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অধিকার ও বৈশিষ্ট্যের জন্য ভারতবর্ষ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুখ্যত পরিচিত৷ বিশ্বের প্রচলিত জৈব ওষুধ ভাণ্ডারে সবিশেষ অবদান বহন করে আমাদের দেশ, পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যেও আমাদের দেশের বিশাল অবদান স্বীকৃত৷ নিঃসন্দেহে পশ্চিমী সভ্যতা স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, কিন্ত্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এক্ষেত্রে ভারতের ঐতিহাসিক অবদান ব্যাপক৷

প্রাচীন ভারতীয় স্বাস্থ্য বিশারদরা নিজেদের আত্মদর্শন ক্ষমতায় chikitsakযোগ্য ছিলেন বলেই উন্নত চিকিৎসা প্রণালী আবিষ্কারের ভিত্তিভূমি নির্মাণে সাফল্য পেয়েছেন এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঐতিহ্যের উত্তরসুরী হতে পেরেছেন৷ তিনশো শতাব্দীর ইতিহাসে ফিরে গেলে আমরা দেখি প্রাচীনতম ওষুধ আবিষ্কারক হিসেবে বোগার, তিরুমুলার, সুশ্রুত, চরক, প্রভৃতি চিকিৎসা বিজ্ঞানীর নাম জ্বলজ্বল করছে৷ এই চিকিৎসকরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের শল্য চিকিৎসা বিভাগেও বিস্তর সাফল্য অর্জন করেছিলেন৷ তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ অবদানের যথার্থ প্রভাব পডে়ছিল তৎকালীন ঔষধ গবেষণা ক্ষেত্রে, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রসারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল৷

ভারতের প্রচলিত ঐতিহ্য হলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যা কিছু ভালো যা কিছু মহান তার আত্তিকরণ৷ স্বামী বিবেকানন্দ, ১১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ তারিখে তাঁর চিকাগো বক্তৃতায় এই সত্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷ ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রেও ঐতিহ্যের আত্তিকরণ ঘটেছে সন্দেহ নেই৷ এই পথ ধরেই সোওয়া রিগপা প্রচলিত হয়েছে এ দেশে, চিনের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি, গ্রিকো-আরব চিকিৎসা ব্যবস্থার উপাদানগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভারতের প্রচলিত চিকিৎসা প্রণালীতে, তিব্বতের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি ২০১২ সাল থেকে সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিন দ্বারা স্বীকৃতি পেয়েছে৷ একইভাবে, আরব দুনিয়া থেকে আগত ইউনানি চিকিৎসা বিধি, প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসা বিধি এদেশে স্বীকৃতি লাভ করেছে, সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিন ১৯৭০ সালের আইএমসিসি আইন অনুসারে ইউনানি ওষুধ এবং ইউনানি চিকিৎসা বিধিকে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ১৯৭৩ সালে, ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে হোমিওপ্যাথিকে (জার্মানি থেকে উদ্ভুত) আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় স্তরের স্বীকৃতি দিয়েছে৷ সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ হোমিওপ্যাথি (সিসিএইচ) প্রতিষ্ঠা এর শিক্ষা ও অনুশীলনকে আরও বিকশিত করেছে৷

সিদ্ধা দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত একটি প্রাচীন ভারতীয় নিরাময় পদ্ধতি যাকে ভগবান শিবের সৃষ্টি বলে পুরাণের মত অনুসারে বিশ্বাস করা হয়৷ শিব থেকে পার্বতী হয়ে নন্দীর মাধ্যমে সিদ্ধার জ্ঞান নাকি নয়জন দেবতার কাছে পৌঁছায়৷সম্প্রতি,ভারত সরকারের আয়ুষ মন্ত্রকের অধীনস্থ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইন্ডিয়ান সিস্টেম অফ মেডিসিন আয়ুর্বেদ, ইউনানী, সিদ্ধা এবং সোওয়া রিগপা চিকিৎসা পদ্ধতিকে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি সহ অনুমোদন করেছে৷ [ন্যাশনাল কমিশন ফর ইন্ডিয়ান সিস্টেম অফ মেডিসিন অ্যাক্ট ২০২০-এর ধারা ৩৪(১)-এর উপধারা (সি)]

‘চাঁদসি’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘চিকিৎসক’ থেকে উদ্ভুত যার অর্থ স্বাস্থ্য অনুশীলনকারী, প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় যার শিকড়৷ পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাঁদসি শব্দটি হিন্দু দেব-দেবীদের কাছ থেকে পাওয়া বলে বিশ্বাস করা হয়৷ এমনও বিশ্বাস করা হয় যে একজন ভক্ত স্বপ্নে একটি গুরুতর দুরারোগ্য রোগের প্রতিকার পেয়েছিলেন দেবী মা কালীর কাছে৷ লোক বিশ্বাস, ঠাকুর হরিচাঁদ নিজে এই চাঁদসি চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন নমশূদ্র, পাউন্ড্র এবং মাঝি সহ বাঙালি সম্প্রদায়ের বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের রোগ নিরাময়ের জন্য৷ নমশূদ্র সম্প্রদায় থেকে উদ্ভুত বলে অনেকে এই পদ্ধতির প্রয়োগকারীকে ‘দীনের ডাক্তার’ বলে উল্লেখ করেন৷ ওপার বাংলার বরিশালের একটি জেলা ‘চাঁদসি’ নামে পরিচিত৷ পরবর্তী সময়ে এই জেলা থেকে যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার তৈরি হয়েছেন৷ উল্লেখ করা দরকার যে ডাঃ কাদম্বিনী বোস গাঙ্গুলি, প্রথম মহিলা ভারতীয় ডাক্তার, এখানকার বাসিন্দা ছিলেন৷ ডাঃ শুভ্র চক্রবর্তী, বিজ্ঞানী ও গবেষক সাধারণ সম্পাদক বঙ্গ ভাষা মহাসভা ফাউন্ডেশন জানিয়েছেন, ঐতিহাসিক তত্ত্ব অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, চাঁদসি চিকিৎসকরা বাইরে থেকে এদেশে এসেছিলেন যারা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সক্ষম ছিলেন৷ অস্ত্রোপচার না করেই পাইলস, ফিশচুলা বা ফিশারের মতো রোগ নিরাময়ের দক্ষতা ছিল তাদের, চাঁদসিরা শান্তি মলম-এর মতো ঐতিহ্যগত মলম সৃষ্টি করেছেন যা নিমেষে কাটা পোড়া ক্ষতর জ্বালা কমাতে সক্ষম৷

ভারত সরকারের আয়ুষ মন্ত্রকের ন্যাশনাল কমিশন ফর ইন্ডিয়ান সিস্টেম অফ মেডিসিনের কাছে আমার আন্তরিক আবেদন, চাঁদসি অনুশীলনকারীদের অবিলম্বে আয়ুষ স্বীকৃতি দিতে হবে৷ চাঁদসি চিকিৎসকরা (দীনের ডাক্তার) যাতে যথাযথ সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত না হন তার ব্যবস্থা করতে হবে, চাঁদসি চিকিৎসা প্রণালীর ঐতিহাসিক তথ্যসমুহ সংরক্ষণের রাষ্ট্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে৷