চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের দামামাআধুনিক বিশ্বে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ (এআই) হল চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের সমার্থক। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে এত হইচই হলেও, এর জনক হলেন – জন ম্যাকার্থি এবং অ্যালান টুরিং। ১৯৫৫ সালে জন ম্যাকার্থি একটি কর্মশালায় “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স” শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। এটি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নই নয়, মানব সমাজের গতিপথকেও অতি দ্রুততায় বদলে দিচ্ছে। নতুন যুগে, এই এআই-অধিপত্য কী ভাবে আমাদের জীবন, সমাজ এবং ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে তা নিয়ে আশা-আকাঙ্খার শেষ নেই। সাধারণ মানুষ থেকে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ থেকে রাষ্ট্র-পরিচালক। সকলে এখন একটাই উত্তর খুঁজছেন। ইতিমধ্যেই, অতি সাম্প্রতিক দিনের অধিকাংশ কাজ যা আগে মানুষ নিজ-হস্তে সম্পন্ন করত, তা আজ এআইয়ের দৌলতে স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, প্রথাগত-শিক্ষা ও চাকরির বাজারে এআইয়ের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ‘ম্যাকেনজি এবং গোল্ডম্যান স্যাচেস’-এর পরিসংখ্যা বলছে ইতিমধ্যে আমাদের জীবনের সত্তর শতাংশেরও বেশি কাজে এআই নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে।
নিজেদের স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ‘গুগল সার্চ’ বা ফোন-ক্যামেরাতে তোলা ছবির প্রসেসিং থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয়-গাড়ি চালানো – সব কিছুতেই এআইয়ের ব্যবহার সর্বাত্মক। ভার্চুয়াল সহকারী, যেমন – ‘অ্যালেক্সা’, ‘সিরি’ বা ‘চ্যাট জিপিটি’ ইত্যাদিতে এআই প্রকৃত অর্থেই বিপ্লব ঘটিয়েছে।কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আগামীর ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’?শুরুতেই কিছু চমকে যাওয়ার মত তথ্য জানাই । সারা বিশ্বে ২০২৭ সালের মধ্যে আট কোটি ত্রিশ লক্ষ চাকরি হারিয়ে যাবে (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী।) এই চাকরি হারানোর আশঙ্কাটা যে কতটা সত্য, তারই প্রমাণ পাওয়া গেল সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক সংবাদসূত্রে। ২০ লক্ষ কেন্দ্রীয় কর্মচারীকে ৮ মাসের বেতন দিয়ে স্বেচ্ছাবসরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত ট্রাম্প সরকারের তরফে। এই ঘোষণার পর, ৬৫ হাজার সরকারি কর্মচারী ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন। ধনুকবের ইলন মাস্কের সংস্থার কর্মীসংখ্যা দশ হাজার থেকে কমিয়ে ছ’শোর কাছাকাছি নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে হোয়াইট হাউজ সূত্রে৷ মূলত, কাদের চাকরি চলে যেতে চলেছে? এক – ডেটা এন্ট্রি, কেরানি ও সাধারণ প্রশাসক; দুই – কাস্টমার সার্ভিস পেশাদার; তিন – অ্যাকাউন্টিং পেশাদার; চার – ম্যানুফাকচারিং ও অ্যাসেম্বলিং – প্রভৃতি ক্ষেত্রে পেশাদারদের কাজ।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, উল্লেখিত কাজগুলি আগামী পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে গভীর সংকটে পড়বে। এছাড়াও আশঙ্কা রয়েছে আরও বহু পেশাদারদের জীবন-জীবিকা। অযথা আতঙ্ক তৈরি করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, যেগুলি আজকের রাজ্যবাসী তথা ভারতীয় এবং বিশ্ববাসীকে শিহরিত করবে, তা হল – শিক্ষা এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে এআইয়ের ক্রমবর্ধমান এবং সর্বগ্রাসী প্রভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা জানাচ্ছে, ২০৪৫ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ ডাক্তারদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন! আজকে সাধারণ ডাক্তারদের কাজ করে দেবে বিশেষ ‘এআই-বট’! তবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আগামীর ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’ হতে চলেছে?এআই কেন এত প্রভাবশালী?যে কেউ একটি প্রশ্ন করতেই পারেন, ‘এআই কেন এত দ্রুত প্রভাব বিস্তার করছে?’ ছোট্ট উত্তর এর সর্বাধিক দ্রুততা এবং যথাযথতা। অত্যন্ত দক্ষ এবং পারদর্শী একজন মানুষ বা কর্মী, একটা কাজ যত দ্রুততায় করবেন; একটা সাধারণ এআই তাঁর চেয়ে ১০০০ গুন দ্রুততা এবং নির্ভুলতার সঙ্গে কাজ করে দেবে মুহূর্তে! এবং খরচ প্রায় শূন্য। এবার আপনারাই বিচার করে বলুন। জীবনের দৈনন্দিন কাজ, এক নিমেষে ও বিনা খরচে সম্পন্ন হলে, আপনি কাকে অগ্রাধিকার দেবেন ? উত্তরটা নিশ্চয়ই এআই৷ তা-ই, না?একটা সিনেমা করবেন। গানের প্রয়োজন। ‘চ্যাট জিপিটি’ তা লিখে সুর করে আপনার সামনে তিন মিনিটের মধ্যে হাজির করবে। আপনি তখন লেখক-কবিদের কাছে যাবেন, না কি চ্যাট জিপিটির কাছে? যেখানে আপনার সময়, শ্রম এবং অর্থ সবই বেঁচে গেল। এ রকম আরও কী কী কাজ আজকের দিনে এআই করে দেখাতে পারে, তা বলাই বাহুল্য।
আগামীতে এআই কী পারবে, আর কী পারবে না, সে ভাবনা এখন কল্পনা না করাই ভাল!আশার আলোএবার আসা যাক আশার কথায়।পেশা বা চাকরির প্রশ্নে আগামী প্রজন্ম “এআই-ঝড়” সামলে কী ভাবে টিকে থাকবে? উত্তরটা খুব সোজা হলেও, পরিশ্রমসাধ্য। সরল কথায়, নিজেদের এআই রেডি বা উপযুক্ত করে তোলা। আজকের কলা কিংবা বাণিজ্য বিভাগে, সাধারণ ভাবে যে বিষয়গুলি পড়ানো হয়, এগুলি আগামীদিনে গুরুত্ব হারাবে এআইয়ের কাছে। এমনকী বেসিক সায়েন্সও যে আগামী ৩০ বছর পর সাধারণের গ্রহণযোগ্যতা হারাবে না – তার নিশ্চয়তা আজকের কোনও বিজ্ঞানী এখনই দিতে পারছেন না। আসলে স্যাম অল্টম্যানের কথায়, “আজকের এআই ক্লাস নার্সারির এক শিশু মাত্র৷ আমরা নিজেদের এআই থেকে বুদ্ধিমান না করে নিতে পারলে বা এআইকে চালনা করার মত জায়গায় নিজেদেরকে না নিয়ে গেলে, এআই আমাদেরকেই গিলে খাবে”।এআই রেডি হব কী ভাবে?কী ভাবে নিজেদের এআই রেডি করব? খুব সোজা, এআইয়ের আরও বেশি ব্যবহার করে। বিভিন্ন চ্যাটবট যেমন ‘জিপিটি’, ‘ডিপসিক’, ‘গুগুল জেমিনাই’, ইত্যাদির সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে। নিজের ভাল লাগার বিষয় জানিয়ে। এআইকেই জানতে চাওয়া যে, নিজের ভাল লাগার বিষয়টিতে কী ভাবে সেরা হওয়া যায়। তার ফিউচার স্কোপই বা কী, ইত্যাদি৷ আদৌ সেই বিষয়ে ভবিষ্যতে কোনও দাম বা চাহিদা আছে কি না? এক কথায় বললে ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ডে ‘এআই-ডেটাসায়েন্স’ বিষয়টা ফিউচার প্রুফ এবং এ বিষয়ের পণ্ডিতরাই যে ভবিষ্যৎ চালাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এর ফলে, নতুন ‘প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং’ শাখাটি দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে।
পড়ুয়াদের মুশকিল আসান
এবার দেখে নেওয়া যাক, একটি সাধারণ স্কুল-পড়ুয়া, তাদের দৈনন্দিন জীবনে এআই ব্যবহার করে কী কী সুবিধা পেতে পারে। তাদের জীবনকে আরও সহজ ও সুন্দর করে তুলতে পারে ।প্রথমত, ‘প্রচলিত’ পড়াশোনার ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করে শেখা ও নতুন জানার প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত ও কার্যকর করা যেতে পারে। যেমন ‘চ্যাট জিপিটি’, ‘ডিপসিক’ বা ‘গুগুলবার্ড’-এর মতে৷ এআই টুলস ব্যবহার করে যে কোনও জটিল বিষয় খুব সহজে বুঝে নেওয়া যায় ৷ এই টুলসগুলি যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম এবং জটিল ধারণাগুলিকে অত্যন্ত সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করতেও পারদর্শী।দ্বিতীয়ত, এআই ব্যবহার করে সময়-ব্যবস্থাপনা উন্নত করা যায়। যেমন ‘টুডুইস্ট, ‘ক্লকওয়াইয, নোশন’-এর মতো এআই টুলস ব্যবহার করে পড়াশোনার রুটিন, পরীক্ষার সময়সূচি, এবং অন্যান্য কাজের পরিকল্পনা করা যায় সহজেই। এই টুলসগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিমাইন্ডার পাঠায়, কাজের অগ্রগতি ট্র্যাক করে। ফলে, পড়ুয়াদের সময় বাঁচে এবং তাদের ওপরে প্রণোদিত মানসিক চাপ কমে৷ তৃতীয়ত, এআই ব্যবহার করে ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করা যায়। কারণ, মানব-সমাজে নিজেকে প্রকাশ করার অন্যতম উপায় হল সঠিক ভাষার প্রয়োগ ও উপযুক্ত ব্যবহার। এক্ষেত্রে ‘মেকস-ইউ-ফ্লুয়েন্ট, ‘গ্রামারলি’, ‘ডুওলিঙ্গ’-এর মতো এআই টুলস তাদের ফ্লুয়েন্সি, নতুন ভাষা জানানো বা শেখানো, লেখার দক্ষতা প্রভৃতি বিষয় পারদর্শী হতে সাহায্য করে খুব সহজেই। এই টুলসগুলি নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর দক্ষতা ও মানসিকতা বুঝে বানান, শব্দ এবং সঠিক ব্যাকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। এছাড়াও ‘স্পিচিফাই’-এর মত অ্যাপস ব্যবহার করে, পড়ুয়ারা তাদের বই বা নোটসকে অডিওতে রূপান্তর করে যে কোনও সময় শুনতে পারে। ফলে, গতানুগতিক পড়াশোনা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। চতুর্থত, এআইয়ের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের সৃজনশীলতা সহজেই বৃদ্ধি করতে পারে।
‘ক্যানভা’ বা ‘অ্যাডোবি স্পার্ক’-এর মতো এআই টুলস ব্যবহার করে, তারা তাদের প্রজেক্টের আকর্ষণীয় প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে পারে। এই টুলসগুলি নানা ধরনের ডিজাইন এবং লেআউটের পরামর্শ দিয়ে তাদের কাজকে আরও পেশাদার ও সহজতর করে তোলে। পঞ্চমত, এআইয়ের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের স্বাস্থ্য এবং মানসিক সুস্থতা নিয়ে যত্ন নিতে পারবে। ‘উইবট’ বা ‘ওয়াইজা’ এর মত এআই-চালিত মেন্টাল হেলথ অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে নানা ধরনের সমস্যা এবং উদ্বেগ কমানো সম্ভব। এই অ্যাপসগুলি তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের মানসিক অবস্থা বুঝে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে পরামর্শ দেয়৷ পড়ুয়াদের জন্য সরকারি উদ্যোগইতিমধ্যে কেন্দ্র ও সমস্ত রাজ্য সরকারের মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এআইকে নতুন পাঠক্রম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও, ভারত সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত| বিষয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পগুলির উদ্দেশ্য হল – শিক্ষার্থীদের এআইয়ের সঙ্গে পরিচিত করা, দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং গবেষণায় উৎসাহিত করা।
‘জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিকল্পনা’ ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটির মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এআইয়ের উপর প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার সুযোগ তৈরি করা। ‘রেসপন্সসিবল এআই ফর ইয়ুথ’ – ২০২০ সালে শুরু হয় এই প্রকল্পটি ভারতের স্কুল শিক্ষার্থীদের (অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) জন্য তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এআই, মেশিন লার্নিং এবং তথ্যবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলি শেখানো হয়৷ প্রকল্পটির লক্ষ্য হল তরুণদের এআই-এর প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং তাদের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা গড়ে তোলা। পরিশেষে বলা যায় এআইয়ের আধিপত্য মানব সমাজকে এক নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটি একদিকে যেমন সুযোগ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। আমাদের উচিত প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং নতুন দক্ষতা অর্জন করা। তবে, এআইয়ের নৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। নতুন যুগে টিকে থাকতে হলে, আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। এআইয়ের সঠিক এবং নৈতিক ব্যবহারই পারে মানবজীবনকে একটি উন্নত সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে।