• facebook
  • twitter
Thursday, 15 May, 2025

গঙ্গাটিকুরী অতীন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দির

শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পরে রবীন্দ্রনাথ চট্টরাজ ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। ২০০১-এ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে উন্নীত হয়।

‘গঙ্গাটিকুরী অতীন্দ্রনাথ বিদ্যা মন্দির’ সত্যিই যেন বিদ্যার মন্দির। কি সুন্দর নাম করণ! দেবতার মন্দিরে গেলে যেমন দেবতার দর্শন মেলে ঠিক এখানেও এলে তেমন বিদ্যার দর্শন পাওয়া যায়। এই বিদ্যা মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ইংরাজীর ঊনিশশো পঞ্চাশ সালের ছাব্বিশে জানুয়ারি। প্রতিষ্ঠা করেন রস সাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের পৌত্র তৎকালীন কাটোয়া কোর্টের সম্মানীয় বিচারক তথা গঙ্গাটিকুরী গ্রামের জমিদার শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি একাধারে ছিলেন সমাজসেবী এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিও। এলাকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলোকে জ্বালানোর উদ্যোগে ওনার পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত করন গঙ্গাটিকুরি অতীন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দির। কিন্তু এ কাজ মোটেই সহজ সাধ্য না থাকলেও অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাতা মহাশয় এই স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। মাটির তৈরি অনেকগুলি ঘর নিয়ে বিদ্যা মন্দির স্থাপিত হয়। প্রথমে জুনিয়ার হাই স্কুল অর্থাৎ ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত চালু হয়। বিদ্যা মন্দির তো প্রতিষ্ঠা হল কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক কোথায় পাওয়া যায়? যেটা এখনকার দিনে কোনটারই সমস্যা নাই তখনকার দিনে ওই দুটোর খুবই সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা মহাশয় ওই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। ঘুরেছেন গ্রামে গ্রামে। উনি অত বড় মাপের মানুষ হয়েও উদার মানবিকতা নিয়ে আশপাশে গ্রামে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা করে ছাত্র ভর্তির জন্য আবেদন জানিয়েছেন। ভর্তির ক্ষেত্রেও স্কুলটি ব্যতিক্রম।

ওই স্কুলে প্রথম যে ছাত্রটি ভর্তি হয় তা অন্য স্কুল থেকে এসে ক্লাস সেভেনে। তাঁর ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে বালুটিয়া নিবাসী যামিনী মোহন চট্টরাজ মহাশয় তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ চট্টরাজকে ইংরেজি ১৯৫০ সালে অন্য স্কুল থেকে এনে এখানে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করেন। তিনিই হলেন ওই স্কুলে প্রথম ছাত্র। ওই সময় প্রতিষ্ঠাতা মহাশয়ের সুযোগ্য পুত্র অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শংকর নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একই সঙ্গে ওই বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হয়েছিলেন। ঐ বিদ্যা মন্দিরের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শিবনাথ ভট্টাচার্য। উনি বনোয়ারী বাদ মহারাজার্স হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পিতা ছিলেন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাক্তার সৌরেন ভট্টাচার্য। উনি কিছুদিনের জন্য ছিলেন কিন্তু যতদিন ছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে ওই বিদ্যা মন্দিরে উন্নতির স্বার্থে সেবা করে গেছেন। তারপর কিছু দিন পর রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞান মুখোপাধ্যায়, রাম রঞ্জন মজুমদার, সাতকরি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ চন্দ্র প্রমুখ শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। তারাপদ চন্দ্র পাঁচথুপি থেকে এই বিদ্যামন্দিরে যোগদান করেন। উনি ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। এরপর ইংরেজি ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসের এক তারিখে দশম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলটি অনুমোদন পায়।

শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পরে রবীন্দ্রনাথ চট্টরাজ মহাশয় ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। স্কুলটি ২০০১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। একসময় এই বিদ্যালয়ে তপশিলি জাতি-উপজাতি ছাত্রদের জন্য বিনা খরচে সরকারি অর্থানুকূলে ছাত্রাবাস চালু ছিল। বর্তমানে এই বিদ্যামন্দিরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্র চালু আছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে নতুন নতুন বিষয় চালু রয়েছে যার মান বেশ উন্নত। স্কুলে বৃত্তিমূলক শাখা চালু আছে। এখানে বুদ্ধিমানদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। গর্বের বিষয় এই বিদ্যালয়ে জেলার মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী গ্রন্থাগার আছে। যেখানে সংযুক্ত পড়াশোনার জন্য ঘর থাকার দরুন ছাত্র-ছাত্রীরা বসে পড়াশোনা করতে পারে। প্রতিবছর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ফলাফলের ভিত্তিতে ‘তারকব্রহ্ম স্মৃতি পুরস্কার’, ‘ঝরনা দেবী স্মৃতি পুরস্কার’, ‘রাধা বিনোদ স্মৃতি পুরস্কার’ প্রভৃতি চালু আছে। যা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার অভ্যাস গড়ে তোলে। এই বিদ্যামন্দিরে আমিও পড়ার সুযোগ পেয়ে ছিলাম। সে স্মৃতি আজও অমলিন। আমার সময়ে যেসব শিক্ষক মহাশয়কে পেয়েছিলাম তাঁরা হলেন ননী গোপাল রায়, তারাপদ চন্দ্র, সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। করণিক শিবনাথ বাবাকে কোনোদিন ভুলবেন না। কারণ উনি শিক্ষক না হয়েও আমাদের শিক্ষক ছিলেন। কখনো হয়তো কোন ক্লাসে কোন শিক্ষক যাওয়ার নেই, তখন শিবনাথ বাবু চলে যেতেন। যে ক্লাসই হোক, যে বিষয়টি হোক, উনার সমস্ত বিষয়ে অসীম দক্ষতা ছিল।

চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী গৌড় গোপাল রায়। যে ছিল সকলের দাদা আমিও বলতাম গৌরদা তো আমার মেয়ে যখন পড়তে গেলো সেও বলে এসেছে দাদা। আর ছিলেন অন্নপূর্ণা মিত্র যিনি মেয়েদেরকে দেখভাল করতেন আর একজন ছিলেন শুভঙ্কর হাজরা। সময় বড় স্বার্থপর আজ তোমার কাছে যা আছে তো কাল অন্যের কাছে চলে যাবে। আমার সহপাঠীরা সকলেই আজ উপজীবনের তাগিদে কে কোথায় আছে জানা নেই। তখনকার দিনে তো ভ্রাম্যমান ফোনের প্রচলন ছিল না। সুখ রবি কাকে কোথায় কিভাবে রেখেছেন প্রায় সকলেরই অজানা। আজ প্রতিযোগিতার যুগে তবু মাঝে মাঝে সেই সীমাহীন নিবিড়তা হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। শিক্ষকদের পুত্রসম ভালবাসা কুড়ি বছর পর দেখা হলেও কি-রে কেমন আছিস? সেই আন্তরিকতা কোথায় পাবো? পরে অবশ্য আমার সহপাঠী লক্ষণ দাস বৈরাগ্য ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করেছে। এতে আমরা খুবই গর্বিত। আমার পরিচিতর মধ্যে মাননীয় তড়িৎকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ভাতৃসম সন্তোষ পান, সঞ্জীবঘোষ ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে এই বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করে তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করছেন, মাননীয় অরিন্দম মিশ্র মহাশয়।