ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর-পূর্বের প্রত্যন্ত একটি জেলা হল দক্ষিণ দিনাজপুর। জেলার কুমারগঞ্জ ব্লক অধীনস্থ আত্রেয়ী নদীর একেবারে কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে সাফানগর উচ্চবিদ্যালয়। ভৌগলিক দিক দিয়ে বিদ্যালয় থেকে উত্তরে ছ’কিলোমিটার এবং পূর্বে দশ-বারো কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থিত। এটি দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রান্তিক এলাকার একটি বিদ্যালয় যা ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যালয় থেকে জেলা সদর শহর বালুরঘাট দক্ষিণ দিকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার। একে একে প্রধান শিক্ষক এসেছে এবং তাদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়কে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করে গেছে। এইভাবে বর্তমানে বিদ্যালয়ের এগারোতম প্রধান তথা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক বিপুলকৃষ্ণ ঘোষ মহাশয় বিদ্যালয়ের দ্বায়িত্বভার বহন করছে। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও পরিচালন সমিতির সদস্য-সদস্যা বিদ্যালয়ের সার্বিক সমৃদ্ধিতে আন্তরিকভাবে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের পাশে থাকেন যা একটা পরিবারের ছবি মনে করিয়ে দেয়।
শুধুই সৎ ইচ্ছে থাকলে যে একটা সাধারণ বিদ্যালয়কে রীতিমত তীর্থস্থান বানানো যায় তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ সাফানগর উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকের তিনতলা বিল্ডিংয়ের প্রথম ফ্লোর কাঞ্চনজঙ্গা, দ্বিতীয় ফ্লোর গডউইন অস্টিন এবং তৃতীয় ফ্লোর মাউন্ট এভারেষ্ট।উত্তর দিকের বিল্ডিং ‘গীতাঞ্জলি’ এবং ‘বিদ্রোহী’ নামাঙ্কিত ব্লকে বিভক্ত। বিদ্যালয়ের দক্ষিণ অংশ প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক দুটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে এবং পশ্চিমে গ্রাউন্ড ফ্লোর ‘সম্প্রীতি ভবন।’ সাংস্কৃতিক ভবনটি অত্যাধুনিক স্মার্ট রুম যেখানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সৃজনশীল কর্ম সরাসরি প্রজেক্টরের মাধ্যমে উপস্থাপনার ব্যবস্থা করা হয় যা তাদের পড়াশোনাকে বোঝা মুক্ত ও আনন্দ দায়ক করে তোলে। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ঝাঁ চকচকে অফিস রুমের পাশে দিদিমণিদের জন্য আলাদা কমন রুম ও অ্যাটাচ ওয়াশ রুম যেখানে ক্লাসের অবসরে বসেন। শিক্ষকদের বসবার জন্য পৃথক কমন রুম আছে। দ্বিতীয় তলে ঐ শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের কমন রুমের বাইরে বেলকুনিতে অবাক করা ভাসমান মনোরম সবুজ গার্ডেন। মৃদু সতেজ হাওয়া সবসময় খেলা করে ও মনকে নাড়িয়ে দেয়।
বিদ্যালয়ে CWSN বা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবন্ধী সহায়ক আলাদা কক্ষ আছে যেখানে কমটসহ সুন্দর ওয়াশ রুমের ব্যবস্থা আছে। বিদ্যালয়ে সকাল দশটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের থাকতে হয়। এই ছয়-সাড়ে ছয় ঘন্টার মধ্যে যদি কোন শিক্ষার্থী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তার জন্য ‘Sick Room’ বা ‘মেডিক্যাল রুমে’ প্রাথমিক চিকিৎসা ও সেবা সশ্রুষার পর সুস্থ্য বোধ করলে শিক্ষার্থী পুনরায় ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারে। বিদ্যালয়ে ‘আনন্দ পরিসর’ নামে পৃথক জোন বা ব্লক আছে। সেখানে একটি ‘ক্যুইজ বক্স’ এবং একটি ‘বাণী বক্স ‘রাখা আছে। যেকোন শিক্ষার্থী কোন ক্যুইজ কার্ড এবং কোন বাণী লিখে ঐ বক্সে জমা করতে পারে। সেখান থেকে বাছাই করে উক্ত বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক সেরাটা পাশেই রাখা বড় ব্ল্যাক বোর্ডে তা লিখে দেন। সাথে সেই শিক্ষার্থীর নাম বাণীর পাশে উল্লেখ করা হয়।
এভাবেই শিক্ষার্থীদের পাঠক্রম ভিত্তিক পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীলতা ও নান্দনিকতা সহায়ক পরিমন্ডল সরবরাহ করা হয়। এছাড়া বিদ্যালয়ে ‘সততা বক্স’, ‘কন্যাশ্রী মনের কথা’, ও ‘অভিমত বক্স’ এ শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সব বক্সে যথাক্রমে কুড়িয়ে পাওয়া দ্রব্য জমা দেওয়া, ছাত্রীরা তাদের বিবাহ বিষয়ে মনের কথা বা সমস্যা ব্যক্ত করা এবং নিজের কোন ব্যক্তিগত মতামত ইত্যাদি ঐ সমস্ত বক্সে জমা করতে পারে। শিক্ষার্থীদের পুঁথিগত জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি তাদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বিদ্যালয় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নের জন্য প্রত্যহ ঝাড়ুদার দিয়ে ঝাড়-ঝাঁটা দেওয়া হয়। প্রতিটি কক্ষে ছাত্র-ছাত্রীরা নির্দিষ্ট ডাষ্টবিনে নোংরা-আবর্জনা ফেলে। এছাড়া ঘরের মেঝেয় যাতে ধুলোবালি না জমে তার জন্য শিক্ষার্থীরা পাপোস ব্যবহার করে।শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও কর্মের প্রতি দায়িত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে তাদের দিয়ে ক্লাস শেষে নিজ নিজ শ্রেণীকক্ষের দরজা, জানালা এবং লাইট ও ফ্যানের সুইচ বন্ধ করিয়ে নেওয়া হয়। এই অভ্যাস ধীরে ধীরে তাদের যে মধ্যে সাবলম্বী বোধ ও কর্মঠ চরিত্র তৈরি করছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৯০০ শিক্ষার্থী, ১৭জন শিক্ষক, ছয়জন পার্শ্বশিক্ষক এবং একজন গ্রন্থাগারিক ও একজন কম্পিউটারের শিক্ষক কর্মরত।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক বিপুলকৃষ্ণ ঘোষের আহ্বানে আমার সেই বিদ্যামন্দিরের পবিত্র মাটি স্পর্শের পরম সৌভাগ্য হয়েছিল অল্প কিছুকাল আগে। বিদ্যালয়ে উত্তর প্রান্তভাগে দুই মনীষী হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ এবং বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি। আর এবার (২৭ জানুয়ারির ‘২৫) নতুন করে আরও চার বাংলা সাহিত্যের মহান দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবক্ষ মূর্তির শুভ উদ্বোধনের এক পবিত্র ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পাই। একটা বিদ্যালয়ে একসাথে এতোজন মহান মনীষীর মূর্তি স্থাপন জেলার ইতিহাসে বিরল। আসলে যাদের পথ ও আদর্শের শিক্ষা আমাদের সকলের প্রতিমুহূর্তের প্রেরণা তাদের মধ্যে বেড়ে ওঠা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। যাইহোক বিদ্যালয়ে ‘লেখার মাঠ ‘নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের এক অভিনব মাধ্যম।এছাড়া বিদ্যালয়ে ‘আত্রেয়ী তট’ নামাঙ্কিত অত্যাধুনিক মঞ্চে শিক্ষার্থীরা বছরভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও প্রদর্শন করতে পারে। বিদ্যালয়ে ‘রান্নাঘর বাগান’ এ সবুজ ফুল ফল গাছে সজ্জিত। সেখানে টিফিনের সময় শিক্ষার্থীরা তাদের পরিচর্যা করে এবং পরিবেশ বান্ধব চরিত্র অর্জনের সুযোগ পায়। বিপুলকৃষ্ণ বাবুর চোখে আগামী দিনে বিদ্যালয়ের প্রতিটি কক্ষ স্মার্ট ক্লাস করার স্বপ্ন ঠিকরে পড়ছিল। বিদ্যালয়ের অত্যাধুনিক ল্যাব এবং প্রতি কক্ষে সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনার কথা তিনি শোনালেন। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাবাসীর একটা গর্বের নাম ‘সাফানগর উচ্চ বিদ্যালয়।’ এই জেলার একটা প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয়কে শুধুই সৎ ইচ্ছা আশ্রয়ে যে এইভাবে আদর্শ বিদ্যালয়ে উন্নীত করা যায় তার প্রকৃত দৃষ্টান্ত সাফানগর উচ্চবিদ্যালয়। আমাদের জেলা তথা রাজ্যের নিকট সাফানগর উচ্চবিদ্যালয় একটা প্রেরণা, একটা মাইল স্টোন।