• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

সরকারি চাকরির সাতসতেরো

বিভিন্ন সরকারি চাকরি প্রত্যাশী, বিশেষ করে রাজ্য সরকারের ক্লার্কশিপ, মিসেলেনিয়াস, ডব্লিউবিসিএস থেকে শুরু করে, কেন্দ্রীয় সরকারের কম্বাইন্ড গ্র্যাজুয়েট লেভেল, এমনকি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতেও সংবিধানের মৌলিক অধিকার নিয়ে একাধিক প্রশ্ন থাকে প্রায় প্রতিবছরই। "সংবিধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ" বিভাগে এই নিয়ে আলোকপাত করলেন বিশিষ্ট শিক্ষা ও পেশা পরামর্শক এবং ভারতীয় নিরীক্ষা ও হিসেব দফতরের আধিকারিক অনিন্দ্য কিশোর দাস।

ফাইল ছবি

(পর্ব – ১০)

নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য

Advertisement

ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং কর্তব্যগুলি পরস্পর সম্পর্কিত এবং অবিচ্ছেদ্য হলেও, মূল সংবিধানে শুধুমাত্র মৌলিক অধিকারগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু, মৌলিক কর্তব্যগুলি পরে সংযোজিত হয়। সংবিধান-প্রণেতারা নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যগুলি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা– ‘প্রয়োজনীয়’ বলে মনে করেননি সেই সময়ে। তবে, তাঁরা ‘নাগরিকের কর্তব্যগুলি’ সংবিধানে ‘রাষ্ট্রের নির্দেশমূলক নীতি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পরে, ১৯৭৬ সালে, নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যগুলি সংবিধানে যোগ করা হয়। ২০০২ সালে, আরও একটি মৌলিক কর্তব্য যোগ করা হয়।

Advertisement

ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যগুলি পূর্বতন ‘ইউএসএসআর’-এর সংবিধান দ্বারা অনুপ্রাণিত। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি প্রধান গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যের কোনও তালিকা অন্তর্ভুক্ত নেই। জাপানের সংবিধান সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র গণতান্ত্রিক সংবিধান, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যের একটি তালিকা রয়েছে। বিপরীতে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি তাদের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং কর্তব্যগুলিকে সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তাই, পূর্বতন ‘ইউএসএসআর’-এর সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, নাগরিকদের অধিকার এবং স্বাধীনতা-প্রয়োগ; তাঁদের কর্তব্য এবং দায়িত্ব পালন থেকে অবিচ্ছেদ্য।

স্বরণ সিংহ কমিটির সুপারিশ

মৌলিক কর্তব্য সম্পর্কে সুপারিশ করার জন্য, ১৯৭৬ সালে তৎকালীন কংগ্রেস দলের ইচ্ছাক্রমে, সর্দার স্বরণ সিংহ কমিটি গঠন করা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থার (১৯৭৫-১৯৭৭) সময়ে। এই কমিটি সংবিধানে মৌলিক কর্তব্যগুলির জন্য একটি আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে। এটি জোর দেয় – নাগরিকদের সচেতন হওয়া উচিত যে, অধিকার ভোগ করার পাশাপাশি তাঁদেরও কিছু কর্তব্য পালন করতে হবে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার এই সুপারিশগুলি গ্রহণ করে এবং ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইন প্রণয়ন করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে একটি নতুন অংশ, যথা অংশ চার (ক) যোগ করা হয়। এই নতুন অংশে শুধুমাত্র একটি ধারা ৫১-ক রয়েছে। প্রথমবারের মতো নাগরিকদের দশটি মৌলিক কর্তব্যের তালিকা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল সংবিধানে মৌলিক কর্তব্য অন্তর্ভুক্ত না করাকে, একটি ঐতিহাসিক ভুল বলে ঘোষণা করে। যদিও, স্বরণ সিংহ কমিটি সংবিধানে আটটি মৌলিক কর্তব্য অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইন (১৯৭৬) মোতাবেক দশটি মৌলিক কর্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মজার বিষয় হল, কমিটির কিছু সুপারিশ কংগ্রেস পার্টি দ্বারা গৃহীত হয়নি এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এগুলির মধ্যে রয়েছে:-

১) মৌলিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা বা অস্বীকারের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হলে, সংসদ শাস্তি বা দণ্ড আরোপের বিধান করতে পারে।
২) এই ধরনের শাস্তি বা দণ্ড আরোপ করা, কোনও আইনকে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন বা সংবিধানের অন্য কোনও বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যের ভিত্তিতে কোনও আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
৩) কর-প্রদান করাও নাগরিকদের একটি মৌলিক কর্তব্য হওয়া উচিত।

মৌলিক কর্তব্যের তালিকা

ধারা ৫১-ক অনুসারে, প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের কর্তব্য হবে:-

ক) সংবিধান মেনে চলা এবং এর আদর্শ, গঠনতন্ত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা;
খ) স্বাধীনতার জন্য জাতীয় সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করা মহান আদর্শগুলিকে লালন করা এবং অনুসরণ করা;
গ) ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং সমর্থন করা;
ঘ) দেশকে রক্ষা করা এবং প্রয়োজন হলে জাতীয় সেবা প্রদান করা;
ঙ) ধর্ম, ভাষা, আঞ্চলিক বা বিভাগীয়-বৈচিত্র্য অতিক্রম করে, ভারতের সকল মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সাধারণ ভ্রাতৃত্বের চেতনা প্রচার করা এবং নারীর মর্যাদা-বিরোধী অনুশীলন পরিত্যাগ করা;
চ) দেশের সমৃদ্ধ ‘যৌথ-সংস্কৃতির’ ঐতিহ্য মূল্যবোধ গ্রহণ করা এবং সংরক্ষণ করা;
ছ) বনাঞ্চল, হ্রদ, নদী ও বন্যপ্রাণীসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা, উন্নত করা এবং জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শন করা;
জ) বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, মানবতাবাদ এবং অনুসন্ধান ও সংস্কারের চেতনা বিকাশ করা;
ঝ) সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করা এবং হিংস্রতা পরিত্যাগ করা;
ঞ) ব্যক্তি ও সমষ্টিগত কর্মকাণ্ডের সকল ক্ষেত্রে উৎকর্ষের জন্য প্রচেষ্টা করা। যাতে, দেশ এবং জাতি ক্রমাগত উচ্চতর স্তরে উন্নীত হয়; এবং
ট) ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী সকল শিশু বা সন্তানকে শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা। বর্তমানে, এটি একটি মৌলিক অধিকার। সংবিধান (ছিয়াশিতম সংশোধনী) আইন, ২০০২ মোতাবেক, ভারতের সংবিধানে ধারা ২১-ক যোগ করা হয়। ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী সকল শিশুর জন্য বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শিশুদের বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার (আরটিই) আইন, ২০০৯, যা ধারা ২১-এর অধীনে বর্ণিত পরিণামস্বরূপ একটি আইন।

মৌলিক কর্তব্যের বৈশিষ্ট্য

১) এগুলির মধ্যে কিছু নৈতিক কর্তব্য, আবার কিছু নাগরিক কর্তব্য। উদাহরণস্বরূপ, স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ লালন করা একটি নৈতিক কর্তব্য। অপরদিকে সংবিধান, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা-প্রদর্শন করা একটি নাগরিক কর্তব্য।
২) এগুলি এমন মূল্যবোধের প্রতি ইঙ্গিত করে যা ভারতীয় ঐতিহ্য, পুরাণ, ধর্ম ও প্রথার অংশ। অন্য কথায়, এগুলি মূলত ভারতীয় জীবনধারার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য কাজগুলিকে সংঘবদ্ধ করে।
৩) কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে যেগুলি সকল নাগরিক এবং বিদেশি – উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু, মৌলিক কর্তব্যগুলি শুধুমাত্র নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং বিদেশিদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
৪) রাষ্ট্রের নির্দেশমূলক নীতির মতো, মৌলিক কর্তব্যগুলিও বিচারযোগ্য নয়। সংবিধানে, আদালতের মাধ্যমে এগুলির সরাসরি প্রয়োগের ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া, এগুলির লঙ্ঘনের জন্য কোনও আইনি শাস্তির বিধান নেই। তবে, সংসদ উপযুক্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এগুলিকে প্রয়োগ করার স্বাধীনতা রাখে।

মৌলিক কর্তব্যের সমালোচনা

সংবিধানের চতুর্থ অংশে উল্লিখিত মৌলিক কর্তব্যগুলি বেশ কিছু কারণে সমালোচিত হয়েছে।

১) মৌলিক কর্তব্যগুলির তালিকা সম্পূর্ণ নয়। কারণ, এতে ভোটদান, কর-প্রদান, পরিবার-পরিকল্পনা ইত্যাদি অপরিহার্য কর্তব্যগুলি অন্তর্ভুক্ত করা নেই। বাস্তবে, স্বরণ সিংহ কমিটি কর-প্রদানের কর্তব্য সুপারিশ করেছিল।
২) কিছু কর্তব্য অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থক এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, ‘মহান আদর্শ’, ‘যৌথ সংস্কৃতি’, ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’ ইত্যাদি শব্দগুলির বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
৩) সমালোচকরা, এগুলিকে নৈতিক নির্দেশিকা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, এগুলি বিচারযোগ্য নয়। মজার বিষয় হল, স্বরণ সিংহ কমিটি মৌলিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার জন্য শাস্তি বা দণ্ড দেওয়ার সুপারিশ করেছিল।
৪) সমালোচকরা এগুলিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা অপ্রয়োজনীয় বলে বর্ণনা করেছেন।
৫) সমালোচকরা বলেছেন যে সংবিধানের চতুর্থ অংশে পরিশিষ্ট হিসেবে মৌলিক কর্তব্যগুলি অন্তর্ভুক্ত করার ফলে তাদের মূল্য ও তাৎপর্য হ্রাস করেছে। এগুলিকে মৌলিক অধিকারের সমতুল্য রাখতে তৃতীয় অংশের পরে যোগ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেক সমালোচকই।

গ্রন্থ সহায়তা: আমাদের সংবিধান; লেখক – সুভাষ সি কাশ্যপ। গণতন্ত্র; লেখক – ডেভিড বিথাম এবং কেভিন বয়েল। প্রকাশক: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট।
(বিশেষ কারণে এই সপ্তাহে এমসিকিউ প্রশ্নবলি ও গত সপ্তাহের উত্তর দেওয়া সম্ভব হল না।
এই বিভাগটি তোমাদের কেমন লাগছে, আর কী কী বিষয়ে জানতে চাও। আমাদের ইমেল করে জানাও।
ইমেল: [email protected])

Advertisement