মাধ্যমিকে কলকাতাকে ফের পিছনে ফেলল জেলা

পরীক্ষা শেষের ৮৮ দিনের মাথায় ঘােষিত মাধ্যমিকের ফলাফল। মঙ্গলবার সকাল ৯টা নাগাদ সাংবাদিক সম্মেলন করে ফলাফল ঘােষণা করলেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়।

Written by SNS Bidhannagar | May 22, 2019 1:31 pm

সাংবাদিক সম্মেলন করে ফলাফল ঘােষণা করছেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। (Photo: Kuntal Chakrabarty/IANS)

পরীক্ষা শেষের ৮৮ দিনের মাথায় ঘােষিত মাধ্যমিকের ফলাফল। মঙ্গলবার সকাল ৯টা নাগাদ সাংবাদিক সম্মেলন করে ফলাফল ঘােষণা করলেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। আর এই ঘােষণা পর্বের মধ্য দিয়েই সূচনা হল এক ইতিহাসের। যেখানে পর্ষদের ইতিহাসে চলতি বছরে পরীক্ষায় পাশের হার সর্বোচ্চ হলেও শিক্ষা মহলের একাংশ এবছরের মাধ্যমিককে কলঙ্কিত বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার ইতিহাসে সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে এবার। প্রতিদিন পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে হােয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছে। যার জেরে বিধাননগর সাইবার থানার পুলিশ এবং পরে সিআইডি তদন্তে নেমেছিল। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে তদন্তও শুরু হয়। এদিন ফল প্রকাশর সময় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় নিজে বললেন, ৭৩ জন পড়ুয়ার কাছ থেকে মােবাইল পাওয়া গিয়েছিল। তাদের প্রত্যেকের পরীক্ষা বাতিল করা হয়ছে। তারা একটি হােয়াটস অ্যাপ গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে। প্রশাসন সজাগ আছে।

উল্লেখ্য, এবছর পরীক্ষায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য ১৩৬টি অভিযােগ জমা পড়েছিল তাঁর দফতরে। প্রশ্ন ফাঁস, টুকলি, মােবাইল নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই অভিযােগ, যা এক দৃষ্টান্ত। এত সংখ্যক অভিযােগ এর আগে কোনও বছর মাধ্যমিকে জমা পড়েনি।

প্রকাশ, এবছর পরীক্ষা শুরুর আগে পর্ষদ সভাপতি ঘােষণা করেছিলেন, তার কাছে এমন একটি সার্ভার আছে, যা থেকে গােটা রাজ্যের পরীক্ষা ব্যবস্থা তিনি পরিচালনা করতে পারেন, চালাতে পারেন নজরদারি। কোথাও কোনও দুর্নীতি হলে, তা কলকাতার নিবেদিতা ভবনে বসে দেখতে পাবেন বলেও দাবি করেছিলেন কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর সমস্ত দাবি যে ভিত্তিহীন, তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল পরীক্ষা চলাকালীন লাগামহীনভাবে প্রশ্ন ফাঁস।

বিভিন্ন জেলা থেকে হােয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছে পরীক্ষা শুরুর ঠিক আধঘণ্টার মধ্যেই। সে সময় পর্ষদ সভাপতি প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলেন, এমনকি কোনও সাংবাদিক বৈঠকও করেননি। বলেছিলেন, উপরমহলের নির্দেশ আছে, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা যাবে না পরীক্ষা চলাকালীন। সূত্রের খবর, লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্কিত ঘটনায় বিধ্বস্ত পর্ষদ সভাপতি পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তবে এদিন সাংবাদিক বৈঠকে তিনি তা অস্বীকার করেন। এমনকি এই বিষয়ে সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে রীতিমতাে ক্ষুব্ধ হয়ে পর্ষদ সভাপতি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আপনি কী করে জানালেন? শুধু তাই নয়, এদিন বারবার মেজাজ হারান পর্ষদ সভাপতি।

পাশের হারে দ্বিতীয় হলেও কেন মেধা তালিকায় ৫১ জনের মধ্যে কলকাতার ১ জন রয়েছে এই প্রশ্ন সাংবাদিকরা করলে সভাপতি জানান, তিনি তাে জেলার কাউকে ব্রাত্য করতে পারেন না। এরপরেও এই প্রশ্ন উঠে এলে তিনি জানান, আপনারা ফলাফল দেখে গবেষণা করে নিন কেন মেধা তালিকায় কলকাতার পড়ুয়াদের নাম আসেনি। আর তাঁর এই উত্তরের পরে শিক্ষা মহলের একাংশের দাবি, এতেই প্রমাণিত হয়ে গেল পর্ষদ সভাপতির দায়িত্ববােধ।

উল্লেখ্য, ফল প্রকাশর পর পর্ষদ সূত্রে বলা হচ্ছে, পাশের হার ৮৬.০৭ শতাংশ, যা ইতিহাসে প্রথম। কিন্তু অভিযােগের ভিড়ে পর্ষদের এই সুখস্মৃতি কালিমালিপ্তই রয়ে গেল। তবে, এই বছর সাফল্যের নিরিখে ছাত্রদের পিছনে ফেলে মাধ্যমিকেও জয়জয়কার ছাত্রীদের। পড়ুয়াদের উত্তীর্ণের হারের বিচারে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা। জেলায় পাশের হার ৯৬.১০ শতাংশ। পাশের হারে তিলােত্তমার পড়ুয়ারা রয়েছেন দ্বিতীয় স্থানে। কলকাতায় পাশের হার ৯২.১৩ শতাংশ। এরপরে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। জেলায় পাশের হার ৯১.৭৮ শতাংশ। তারপরে রয়েছে দুই ২৪ পরগনা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পাশের হার ৯০.৭০ শতাংশ, উত্তর ২৪ পরগনায় পাশের হার ৯০.৩৫ শতাংশ। পাশের হারে প্রথম আটে না থাকলেও বাঁকুড়া জেলার ৮ পড়ুয়া মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে।

এবছর পরীক্ষায় বসেন ১০ লক্ষ ৪৯ হাজার ৫১৩ জন। যার মধ্যে ছাত্র পরীক্ষার্থী ৪ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬৪০, ছাত্রী পরীক্ষার্থী ৫ লক্ষ ৯০ হাজার ৮৭৩। পর্ষদ সূত্রে খবর, এবছর ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রী পরীক্ষার্থীরা ১২.৫৬ শতাংশ বেশি। এবছর সাফল্য পেয়েছে ৮ লক্ষ ৭৬ হাজার ১৭৬। যার মধ্যে ছাত্রী পরীক্ষার্থী ৪ লক্ষ ৭০ হাজার ২৫৩।

এবছর মাধ্যমিকে ৬৯৪ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে পুর্ব মেদিনীপুর জেলার মহম্মদপুর দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ স্কুলের ছাত্র সৌগত দাস।

দ্বিতীয় হয়েছে দু’জন পরীক্ষার্থী-শ্রেয়সী পাল ও দেবস্মিতা সাহা। তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৯১। শ্রেয়সী আলিপুরদুয়ারের ফুলকাটা গালর্স হাইস্কুলের ছাত্রী আর দেবস্মিতা কোচবিহারের ইলা দেবী গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী।

তৃতীয় স্থান পেয়েছে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ গার্লস স্কুল হাইস্কুলের ছাত্রী ক্যামেলিয়া রায়। এছাড়াও নদিয়ার শান্তিপুর মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের ব্রতীন মণ্ডল। তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৯।

৬৮৭ নম্বর পেয়ে চতুর্থ হয়েছে আলিপুরদুয়ার বড়বিষা হাইস্কুল অরিত্র সাহা।  

পঞ্চম হয়েছে সুকল্প দে (হুগলি কলেজিয়েট স্কুল), রুমনা সুলতানা (কান্দি গার্লস হাইস্কুল)। তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৬।

ষষ্ঠ হয়েছে সােহম দে (গােঘাট হাইস্কুল), সাবর্ণী চ্যাটার্জি (রামপুরহাট), সাহিত্যিকা ঘােষ (বর্ধমান বিদ্যার্থী), সুপর্ণা সাহু (রাজনারায়ণ বালিকা বিদ্যালয়), অঙ্কন চক্রবর্তী (হাওভা)। তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৫।

সপ্তম হয়েছে গায়ত্রী মােদক (কোচবিহার ইলাদেবী গার্লস হাইস্কুল), অনীক চক্রবর্তী (ঘাটাল), সপ্তর্ষি দত্ত (নদিয়া)। তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৪।

অষ্টম হয়েছে সাহনওয়াজ আলম (কোচবিহার), সায়ন্তন বসাক গঙ্গারামপুর), অর্কগ্রভ সাহানা (বাকুড়া), কৌশিক সাঁতরা (বাঁকুড়া), সুদীপ্তা ধবল (বাঁকুড়া), সায়ন্তন দত্ত (বাঁকুড়া জেলা স্কুল), পৃথ্বীশ কর্মকার (বাকুড়া), দেবলীনা দাস (আরামবাগ গার্লস হাইস্কুল), অয়ন্তিকা মাঝি (বর্ধমান বিদ্যার্থী), পুস্কর ঘােষ (বর্ধমন, কাটোয়া কাশীরাম দাস ইনস্টিটিউশন), সেমন্তী চক্রবর্তী (আমতলা নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা)। সবার প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৩।

নবম হয়েছে জয়েশ রায় (আলিপুরদুয়ার), সৌগত পাণ্ডা, শুভদীপ কুণ্ড (বাকুড়া), সৌকর্য বিশ্বাস (বীরভূম), প্রত্যুষ করণ (কাথি), অরুণীমা ত্রিপাঠী (পুর্ব মেদিনীপুর), অভিনন্দন জানা।

দশম হয়েছে সৌম্যজিৎ দত্ত, অরিত্র মাহারা, সৌম্যজিৎ ঘােষ, সায়ন্তিকা রায়, শুভজিত মাঝি (ঝাড়গ্রাম), সায়নি রায়, দেবমাল্য সাহা, প্রত্যাশা মজুমদার (বিরাটি বিদ্যালয়), অঙ্কিতা কুণ্ডু (উত্তর ২৪ পরগনা), সােহম দাস (যাদবপুর বিদ্যাপীঠ)। তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৮১।

এদিন মাধ্যমিকের ফলাফল ঘােষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সফল পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানান। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সােশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্টে সফল পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে লেখেন তােমাদের অভিভাবক শিক্ষক এবং ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা। এদিন শিক্ষা মহলের তরফে তালিকায় কলকাতার এক পড়ুয়া থাকা নিয়ে বেশ চর্চা চলে। কেউ কেউ প্রশ্ন তােলেন, কলকাতায় পড়াশুনার মান পড়ে গিয়েছে। আবার কারও মতে, কলকাতার বেশির ভাগ পড়ুয়া বর্তমানে মধ্যমেধার হয়ে পড়ায় পাশের হারে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও মেধা তালিকায় সেভাবে স্থান পায়নি। আবার অন্য একদলের দাবি, কলকাতার স্কুলগুলির পঠনপাঠনের মান পড়ে যাওয়া ভালাে পড়ুয়ারা সিবিএসসি, আইসিএসসি বাের্ডে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছে। তাই পর্ষদ পরিচালিত মাধ্যমিকে কলকাতার থেকে সেভাবে কেউ মেধা তালিকায় স্থান করে নিতে পারছে না। তবে এবার ছাত্রদের সাফল্যে সকলেই উৎসাহ প্রকাশ করেন।