শোভনলাল চক্রবর্তী
বিজেপি শাসনের ভারতে, বিশেষত উত্তর ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি মুসলমান-বিদ্বেষে বহুদিনই রাখঢাকহীন। যে সংগঠনের অস্তিত্বের ভিত্তিই হল পরধর্মবিদ্বেষ, তার মতাদর্শ নিয়ে কথা চলে না— তাদের কাজকর্ম কোন কোন ক্ষেত্রে বেআইনি, অসাংবিধানিক, আইনের শাসন লঙ্ঘনকারী এবং সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক, কথা হওয়া দরকার সেই নিয়ে। ছটপূজার আবহে যেমন দিল্লিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষণা করেছে, প্রতিটি জেলায় তারা স্টল দেবে, যেখান থেকে পূজার ‘পবিত্র, বিশুদ্ধ’ সামগ্রী পাওয়া যাবে। এ ছাড়া যে হিন্দু দোকানদার, ফেরিওয়ালা, বিক্রেতা বা ছোট ব্যবসায়ীরা পূজার সামগ্রী বিক্রি করেন তাঁদের দোকানে-স্টলে ‘সনাতন প্রতিষ্ঠা’ স্টিকার সাঁটানো হবে। ছটপূজার সঙ্গে সনাতন প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক কী, সেই উত্তর চেয়ে লাভ নেই, কারণ উত্তরটি জানা: যে দোকান-স্টলে স্টিকার সাঁটা থাকবে না সেগুলি বিধর্মীর, সংখ্যালঘুর দোকান।
Advertisement
স্টিকার সাঁটার আসল উদ্দেশ্য পাড়ায় পাড়ায় মুসলমান দোকানি-ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করা এবং ঘুরিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে এই নিদান যে, তাঁদের কাছ থেকে কেউ যেন পূজার সামগ্রী না কেনেন। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের দোকান-বাড়ি ইত্যাদির গায়ে হলুদ তারাচিহ্ন সাঁটা হত, মনে পড়তে পারে। হাতে না মারতে পেরে ভাতে মারার উদাহরণ ইতিহাসে ভূরি-ভূরি। ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এই দু’টি উপায়েই মুসলমান-পীড়নের ‘বিশিষ্টতা’ অর্জন করেছে; এখানে সংখ্যালঘু নাম-পরিচয় মানেই নির্যাতিত হওয়ার পথ প্রশস্ত, ফ্রিজে গোমাংস আছে এই গুজবটুকুই কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট যুক্তি, মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বলতে বাধ্য করায় তো দেড়ে আনন্দ। এই সব কিছুর সঙ্গেই ইদানীং যুক্ত হয়েছে সংখ্যালঘু দোকানি ও ছোট ব্যবসায়ীদের একঘরে করে তোলার বিবিধ বিচিত্র কৌশল। ছটপূজার দিল্লিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নিদান কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বছর তিন আগে দিল্লিতেই এক বিজেপি সাংসদ মুসলমানদের থেকে জিনিসপত্র কেনা ‘সম্পূর্ণ বয়কট’-এর কথা বলেছিলেন, দু’বছর আগে হরিয়ানায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল মিলে সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের আর্থিক ভাবে একঘরে করা ও গ্রাম থেকে মুসলমান-বিতাড়নে উঠেপড়ে লেগেছিল। গত বছর হিমাচল প্রদেশেও ঘটে একই বয়কটের ঘোষণা, সঙ্গে সংখ্যালঘুদের চাকরি বা বাড়ি ভাড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচার। এ বছর জুলাইয়ে কাঁওয়ার যাত্রার সময়ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দিল্লির পাঁচ হাজার দোকানে ‘সনাতনী’ স্টিকার সেঁটে দেয়; সে সময় উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকার পথের পাশে ধাবা-রেস্তরাঁগুলির মালিক ও কর্মীদের নাম প্রদর্শনের যে নির্দেশ দিয়েছিল, শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়েছিল। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যে তার পরেও এতটুকু দমেনি, প্রমাণ ছটপূজার দিল্লি। এই স্পর্ধার কারণও অজানা নয়: শাসকের কল্যাণহস্ত, প্রশাসন ও পুলিশের প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য সমর্থন না থাকলে নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা ও সর্বোপরি আইন উড়িয়ে এ সব কাজ করা যায় না। ধর্মীয় উৎসবের আবহে এই গর্হিত অপরাধগুলি আজকের ভারতে হতেই থাকবে, অনুমান করা চলে। আদালত একটা বড় ভরসার জায়গা অবশ্যই, কিন্তু সমাজে যে ক্ষত ক্রমাগত বিষিয়ে উঠছে, তার কী হবে? গত দশ বছরে ভারত যে পথে হেঁটেছে, তাতে মাংস বিক্রির অভিযোগে কোনও সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে হেনস্থা করার ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই— এমনটা তো হয়েই থাকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা আশঙ্কাজনক।
Advertisement
সাম্প্রতিককালে এ রাজ্যে দৃশ্যত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রসার ঘটেছে, বিভিন্ন হিন্দু পার্বণ উপলক্ষে বাজারে মাছ-মাংস বিক্রি বন্ধ করা নিয়ে ইতস্তত দাবিও শোনা গিয়েছে। কিন্তু মাংস বিক্রি করছেন বলে কাউকে প্রহার করার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম ঘটল। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড মাঠে গীতা পাঠের অনুষ্ঠানে মাংসের প্যাটিস বিক্রির অপরাধে মার খেলেন একজন মুসলমান প্যাটিস বিক্রেতা। হিন্দুত্ববাদীরা খুশি হতেই পারেন যে, শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গও ‘ভারত’ হয়ে উঠল। কিন্তু যাঁরা সেই অসহিষ্ণু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী ভারতের অংশ হতে ইচ্ছুক নন, ব্রিগেডের ঘটনা তাঁদের বিচলিত করবেই। এমন আচরণের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের। দুশ্চিন্তার বিষয়, অন্তত এই ঘটনাটিতে পুলিশ যে ভঙ্গিতে পদক্ষেপ করেছে, তাতে পুলিশ নিজের দায়িত্ব বিষয়ে কতখানি সচেতন, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত করে আদালতে প্রমাণ পেশ করতে হবে এবং তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করতে হবে— যাতে এই বার্তাটি পৌঁছয় যে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এমন বর্বরতা চলতে দেওয়া হবে না।
সাংস্কৃতিক বহুত্বের বিরুদ্ধে যারা খড়্গহস্ত, তাদের কাছে ব্যক্তিগত রুচির অধিকারের কথা বলে লাভ নেই। কেউ চিকেন প্যাটি বিক্রি করলেও তা খাওয়া তো বাধ্যতামূলক নয়— ফলে, গীতাপাঠই হোক বা ফুটবল খেলা, যে কোনও পরিসরেই মাংস ভক্ষণ করলে যার ভাবাবেগ আহত হবে, সে না খেলেই ল্যাঠা চুকে যায়, এই কথাটি উগ্র গৈরিক রাজনীতির কারবারিরা কখনও স্বীকার করবেন না। নিজের ভাবাবেগ আহত হলেই যে অন্যের উপরে চড়াও হওয়ার ছাড়পত্র মেলে না, এই কথাটিও নরেন্দ্র মোদীর ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা অবলীলায় ভুলে যেতে পেরেছেন। কিন্তু বঙ্গের বৃহত্তর জনসমাজের কর্তব্য হল এই কথাগুলি সবসময় মনে রাখা এবং মনে করিয়ে দিতে থাকা। সেই কাজটি সমাজের, আর প্রকৃত রাজনীতিকে সামাজিক স্তরের ভাবনায় নেতৃত্ব দিতেই হবে। কিন্তু খাতায়কলমে পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রধানতম প্রতিপক্ষ, সে দল যখন ধর্মস্থানগুলিকে ঘোষিত ভাবেই নিজেদের প্রচারের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেওয়ার কথা বলে, তখন আশাবাদী হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়।
বঙ্গবাসীকে আরও একটি কথা ভাবাবে বটে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এ রাজ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ আমিষাশী। ফলে, ময়দানে চিকেন প্যাটি যাঁদের ভাবাবেগে আঘাত করেছিল, তাঁদেরও অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনে মাছ-মাংস খান বলেই অনুমান করা চলে। তবুও মাংসে তাঁদের ভাবাবেগ আহত হয় কেন? না কি, সাধারণত হয় না, কিন্তু আজকাল হচ্ছে? বিষয়টি বিপজ্জনক— তাঁরা যে ধর্মীয় রাজনীতিকে আজ মোক্ষ জ্ঞান করছেন, সেই রাজনীতি আমিষ-বিরোধী, ফলে নিজেদের সত্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও তাঁরা দ্বিতীয় বার ভাবছেন না। সর্বাধিপত্যকামী রাজনীতি এমন সমর্পণই দাবি করে। কিন্তু, যে বঙ্গসন্তানরা আজ হিন্দুরাষ্ট্রের খোয়াবে মশগুল, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’কে সেই হিন্দুরাষ্ট্র তার প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসাবে গণ্য করবে কি? হিন্দুত্বের যুদ্ধ জয় হয়ে গেলে ‘মছলিখোর বাঙালি’ সে রাষ্ট্রের ‘অপর’ হয়ে উঠবে না তো? ধর্মীয় রাজনীতির মোহে অন্ধ হওয়ার আগে এই কথাগুলি ভাবা প্রয়োজন।
Advertisement



