• facebook
  • twitter
Tuesday, 15 July, 2025

পেটেন্ট আইন অনুসারে সরস্বতী পুজোর উপর ট্যাক্স বসবে?

রাশিয়া, থাইল্যান্ড, জাভা, মায়নামার, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে মা সরস্বতীর পুজো হয়ে থাকে

প্রতীকী চিত্র

ড. কুমারেশ চক্রবর্তী

মহা ধুমধাম সহকারে পুজো হচ্ছে। ভক্তদের মধ্যে, ভিড়ের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ তরুণী ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু ইনি কে? বেনতেন! জাপানে এরকম আরো বহু মন্দিরে মন্দিরে, মন্ডপে মন্ডপে পুজো চলছে। কোথাও তিনি মীও বেনতেন, কোথাও তিনি বেন জাইতেন, কোথাও বেন জামিনী। আরো নাম আছে যেমন, মিও-ওঙ্গাকুতেন, মিও-ওন-তেন, বিওন-তেন এবং বেন তেন। তবে জাপানে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম বেন-তেন। পুজো যে নামেই হোক না কেন সর্বত্রই যৌবনের জোয়ার, সর্বত্রই যেন রঙিন প্রজাপতি পাখনা মেলেছে। আশ্চর্য ইনিই দেবী সরস্বতী!
আমাদের দেশে শিল্প ও সংস্কৃতি, খেলাধুলা, ক্রীড়া সর্বোপরি বিদ্যার দেবী হিসাবে পরিচিত সরস্বতী। অবশ্য কিছু অঞ্চলে জলের এবং সম্পদের দেবী হিসেবে তিনি পুজো পেয়ে থাকেন। তিনি রূপ ও যৌবনের প্রতীক। এমনকি আমাদের হিন্দু শাস্ত্রের শ্লোকে ও এই রূপের বর্ণনা আছে, যা আমরা অনেক সময় না বুঝেই অঞ্জলির মন্ত্র উচ্চারণ করি তাকে উদ্দেশ্য করে। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী সরস্বতী। কিন্তু শুধু ভারত নয়, ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলিতে তাদের রাষ্ট্রের নিজস্ব দেবী হিসেবে সরস্বতী ধুমধাম সহকারে পূজিত হন। অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন নামে, কোথাও তাঁর নাম বেনতেন কোথাও বা মিও-ওন-তেন। সেই সব এসো, মা সরস্বতী শিল্প সংস্কৃতি শিক্ষা খেলাধুলা দেবী হিসেবেই পূজিত হন।

আবার অনেক স্থানেও তিনি জল, শস্য ও ফসলের দেবী  বিদেশের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন জাপানে। জাপানের তরুণ তরুনী ও ছাত্রসমাজে বেন্ তেনের জনপ্রিয়তা আমাদের সরস্বতীর থেকেও অনেক বেশি। ভারতে যেমন সরস্বতীর ছাড়াও তাঁকে আমরা পলাশপ্রিয়া, সারদা, বাগদেবী প্রভৃতি নানা নামে ডাকি এবং চিনি তেমনি জাপানেও তাদের সরস্বতীর অনেক নাম। সবচেয়ে জনপ্রিয় পাঁচটি নাম হলো বেন-তেন, বেন-যামিনী, মিও- ওঙ্গা কুতেন, মিও-ওন-তেন, বিওন-তেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম হচ্ছে বেনতেন। তবে দেবী বেনতেন শুধু পড়াশোনা আর গান বাজনা নিয়ে থাকেন না, তিনি জাপানিদের মতন অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং তাঁকে নারী শক্তির প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। এমনকি তিনি দেবতা মহলে আন্দোলনের নেত্রী হিসাবে পরিচিত। কারণ তিনিই প্রথম “নারী দেবতা” হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন। তাই জাপানে যেমন বৌদ্ধ মন্দিরের আধিক্য আছে তেমনি সর্বত্র বেনতেন টেম্পল দেখা যায়। জাপানে দেবী বেন তেন এর রূপ-বৈচিত্র দেখার মত। কোথাও তিনি দ্বিভূজা, কোথাও চতুর্ভূজা কোথাও ষড়ভুজা। আবার কোথাও অষ্ট পূজা। অধিকাংশ স্থানে দেবীর হাতে থাকে বইপত্র এবং বাদ্যযন্ত্র। কোথাও কোথাও তিনি নানা অস্ত্রে সুসজ্জিত। তবে জাপানে আরেকটা অতুলনীয় সরস্বতী বা বেনতেন মূর্তি আছে। তা হল নগ্ন দেবী সরস্বতী। না, আমাদের কুমোরটুলির মা কালীর মত নয়, বরং বলা যায় রোমান মানবী মূর্তির মতই আকর্ষণীয় অসামান্য শিল্প নৈপুণ্যের নিদর্শন দেবী বেনতেন!

এরপর সরস্বতীর জনপ্রিয়তা চীনে রয়েছে। অবশ্যই সরস্বতী নামে নয় ওখানে তিনি তিয়েন-মু নামে পরিচিত! অবশ্য ওখানেও তার অনেক নাম। যার মধ্যে একটি বিশাল নাম হল, মিয়াও-ইন-তিয়েন-মু। তবে অধিকাংশ অঞ্চলেই এর ভক্তরা নামটাকে ছোট করে শুধু তিয়েন-মু বলে থাকেন। ইনি শুধুমাত্র বিদ্যা জ্ঞান সংগীতের দেবী হিসেবে পরিচিত। আমাদের বাঙালি সরস্বতীর মতোই এখানে তাঁর দুই হাত, হাতে আছে বীনা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। চীনে তো আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই তাঁর পুজো করে, এমনকি কমিউনিস্টরা তাঁর দারুন ভক্ত!

তিব্বতে বহু প্রাচীন কাল থেকে মা সরস্বতী পুজো পেয়ে আসছেন। তবে ওই দেশে পুজোর প্রধান উপাসক হলেন বৌদ্ধ তান্ত্রিকগণ। তিব্বতে মা সরস্বতীর নাম হল জং-চন-ম! এই নামের মানে হচ্ছে মিষ্টি সুরের রানী। জং-চন-ম আসলে শিল্প ও সংস্কৃতির দেবী। তবে বিদ্যার নন! তিব্বতে বিদ্যার দেবীকে বলা হয় প্রজ্ঞা পারমিতা। বর্তমানে কিন্তু ক্রমশ এই স্থান দখল করে নিয়েছেন জং-চ-ম। নেপালের সরস্বতীর এক অদ্ভুত মূর্তি দেখা যায়। এখানে দেবীর তিনটি মস্তক! মহা ধুমধাম করে পূজো হয়। আমাদের সরস্বতীর নামের সঙ্গে নেপালের সরস্বতীর মিল আছে। কারণ তিনি সেখানে মহাসরস্বতী এবং বৌদ্ধ মহাসরস্বতী নামে পরিচিত। তবে একমাত্র বৌদ্ধ মহাসরস্বতীর তিনটি মাথা দেখা যায়।

এছাড়া ভারতের বাইরে রাশিয়া, থাইল্যান্ড, জাভা, মায়নামার, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে মা সরস্বতীর পুজো হয়ে থাকে। এইসব দেশের মানুষ মনে করেন সরস্বতী তাদের দেশের নিজস্ব দেবী।
যেমন বিভিন্ন রূপ এবং দৈহিক গঠন আমরা দেখলাম তেমনি সরস্বতীর বিভিন্ন বাহনও আছে। বিখ্যাত ফিল্মস্টার এবং শিল্পপতিরা যেমন নিত্যনতুন গাড়ি পাল্টান তেমনি মা সরস্বতীকেও আমরা বিভিন্ন বাহনে আবির্ভূত হতে দেখেছি। সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন হল হাঁস, শ্বেত শুভ্র রাজহংস। এছাড়া অনেক স্থানে ময়ূর দেখা যায়। তাছাড়া সরস্বতীর বাহনরূপে আছে মোরগ, মেষ, মৃগ এবং সিংহ। না খামখেয়ালিভাবে মা সরস্বতী এসব ব্যবহার করেন না। একেবারেই লাইসেন্স প্রাপ্ত মানে শাস্ত্রসম্মত বাহন এগুলি। প্রত্যেকটি বাহনেরই পেছনে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা রয়েছে। ছবিও আছে বহু মিউজিয়ামে।

সরস্বতীর এই বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন গঠন বিভিন্ন ধরনের তার বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্র প্রভৃতি দেখে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এই ভিন্নতার কারণ? আর বিদেশে কেনই বা সরস্বতী অর্চনার এত প্রচলন ঘটল? এর উত্তর পাওয়া যায়, লোকসাহিত্যে। বিশেষ করে লোকসংস্কৃতি সংক্রান্ত গ্রন্থ ও গবেষণাতে। এরূপ একটি পত্রিকা হলো “লোকসংস্কৃতি গবেষণা”। এই পত্রিকাতেও ছবিসহ এর সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। লোকসাহিত্যের গবেষকদের মতে, প্রাচীনকালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এবং এশিয়ার লাগোয়া কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রে ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতির বিশাল প্রভাব পড়েছিল। বিশেষ করে করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমাজ ও সংস্কৃতিকে বৌদ্ধ ধর্ম গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যার থেকে হিন্দু দেবদেবীর পূজা এবং মূর্তি আমরা ঐসব দেশে দেখতে পাই। সরস্বতী ছাড়াও সেখানে শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু ও দুর্গা প্রভৃতি দেবদেবীর যথেষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু যদি এর উল্টোটা হয়? মানে এই ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাবের ব্যাখ্যা তো আমাদের দেশের গবেষকরা দিয়েছেন! অর্থাৎ আমাদের দেশের প্রভাবে বিদেশে সরস্বতীর প্রচলন হয়েছে। কিন্তু বিদেশী গবেষকরা যদি দাবি করেন যে, না, ওইসব দেশ থেকেই ভারতে সরাসরি পূজার প্রচলন ঘটেছে! তাহলে? তাঁরা তো বলতেই পারেন, সরস্বতী আসলে ওই সব দেশের ভূমিকন্যা, ভারত হচ্ছে তার শ্বশুরবাড়ি। তাহলে কি হবে? তাই গবেষণালব্ধ উত্তরের বাইরে গিয়ে মনের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে, হৃদয়ের গভীরে ভয় ভিড় করে আসে!

আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে পেটেন্ট আইনের যাঁতাকলে আমাদের দেশের নিম, রসুন, হলুদ, বাসমতি হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন যদি চিন কিংবা জাপান সরস্বতীর পেটেন্ট নিয়ে নেয় তাহলে! আমাদের তরুণ তরুণী ছাত্র-ছাত্রী তাদের কি হবে? বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পরে অথবা হলুদ পাঞ্জাবি পরে পকেটে লুকানো আতর মেশানো প্রেমপত্র কাকে দেবে? অঞ্জলি দিতে গিয়ে কারা চোখে চোখে কথা বলবে? ছেলেমেয়েগুলো স্কুলে কলেজে রাত জাগবে কাকে নিয়ে! তখন কি সরস্বতী পুজোর জন্য পেটেন্ট আইনের প্যাঁচে উদ্যোক্তাদের ট্যাক্স দিতে হবে? তাহলে! এদের কি হবে? কোথায় যাবে?