• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

আরজি কর আন্দোলন মমতাকে জব্দ করার রাজনীতি কেন হবে?

সেদিনও টিভিতে দেখাচ্ছে অনশনরত আন্দোলনকারীদের। কর্মবিরতি প্রত্যাহার হয়নি। ওদের স্বামী-স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া হল, ‘বাংলায় রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই হয় না। এখানে যারা আরজি কর নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল, তারা সকলেই বুঝে গিয়েছে, এতবড় একটা কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনের নামে শধুই রাজনীতি হচ্ছে। সিবিআই কেন কিছু করতে পারছে না, সেসব কথা কেউ বলছে না।’

ফাইল চিত্র

প্রবীর ঘোষাল

আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এক নামি চিকিৎসকের কাছে চোখের চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলাম। তাঁর চেম্বারে বসেছিলাম। চিকিৎসকের মোবাইল বেজে উঠল। ও প্রান্তে কে আছেন না জানলেও, কথাবার্তায় বোঝা গেল, মূল আলোচ্য বিষয়, আরজি কর কাণ্ডের জেরে আন্দোলন। জুনিয়র ডাক্তারদের লাগাতার কর্মবিরতি সহ নাগরিক সমাজের আন্দোলন তখন সংবাদের শিরোনাম। তুঙ্গে চর্চা।

Advertisement

চিকিৎসক পরামর্শের সুরে মোবাইলে বলছিলেন, ‘তোরা দুটো জিনিস মাথায় রাখবি, এক হল, পরিচিতির জেরে হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে সাধারণ মানুষ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ আন্দোলনের বিরুদ্ধে চলে যাবে। আর দুই হল, তোদের আন্দোলনে রাজনীতির লোকজন মাতব্বরি করলে, কর্মসূচির প্রতি আস্থা হারাবে আমজনতা।

Advertisement

এই সাবধানবাণী যে যুক্তিযুক্ত ছিল, তা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় আড়াই মাসের আন্দোলন অবশেষে দিশা হারিয়েছে। সেভাবে দাগ কাটতেই পারেনি। সাধারণ মানুষ যে আন্দোলনে নিঃস্বার্থে নিজেদের যুক্ত করেছিল, তাদের বড় অংশ বিরক্ত এবং বীতশ্রদ্ধ হয়েছে। এই ইস্যুতে গণ আন্দোলন গোটা বিশ্বে ফণা তুলেছিল। ১৪ আগস্ট বহু দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে কলকাতার মতোই মিছিল করেছিল প্রবাসী মানুষরা। আরজি কর কাণ্ডের বিচার এবং অভিযুক্তদের শাস্তি চেয়ে জনগর্জন শোনা গিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

অথচ, সেই প্রবাসীদের সিংহভাগ বর্তমানে অত্যন্ত হতাশ। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন সাতসকালে বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। মূলত উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহরকে কেন্দ্র করে ছিল আমাদের এবারের সফরসূচি। ভীষণ টেনশন নিয়ে স্ত্রী মিঠুকে সঙ্গী করে সাতসকালে পৌঁছে গিয়েছিলাম দমদম বিমানবন্দরে। টেনশন কিসের? ঠাকুর পরম দয়ালের আশীর্বাদে বহু বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু এমন টেনশন নিয়ে কখনও বেড়াতে বেরোইনি। তার কারণ হল, এর আগে দেশে কিংবা বিদেশে কোথাও আমরা কেবল স্বামী-স্ত্রী মিলে বেড়াতে যাইনি। বরাবর সদলবলে সফর করেছি। দলের সদস্য সংখ্যা আট থেকে আঠাশ পর্যন্ত হয়েছে।

দমদম থেকে দুবাই। দুবাই থেকে বিমান বদল করে ব্রাসেলস। বেলজিয়ামের রাজধানী। দুবাইয়ে গিয়ে আর একটি বিমান ধরার সময়ের ব্যবধান মাত্র এক ঘণ্টার কিছু বেশি। খুবই স্বল্প সময়। তার ওপর টেনশন বাড়িয়ে দিল, দমদম থেকে আকাশে উঠতে বিমান ১৫ মিনিট লেট করল। প্রায় চার ঘণ্টা জার্নির পর এক ঘণ্টারও কম সময় হাতে রয়েছে। বস্তুত ছুটে গিয়ে ব্রাসেলস বিমান ধরার গেটে পৌঁছতে হল। দুবাই বিমানবন্দর দুনিয়া কাঁপানো একটা ডেস্টিনেশন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা রয়েছে। আর তার পরিধিও বিশাল। ট্রেন এবং লিফট ধরে যেতে হল গেটে।

প্রায় সাত ঘণ্টার জার্নি। আমাদের পাশের আসনেই বসেছিলেন ডা. সুবীর সরকার। সপরিবারে কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাড়িতে দুর্গাপুজো কাটিয়ে ফিরছেন ব্রাসেলসে। ৩২ বছর সেখানেই বসবাস। বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছেন। আলাপের পর কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনায় এল আরজি কর কাণ্ড। এই ইস্যুতে ১৪ আগস্ট সহ তিনদিন ব্রাসেলসে প্রতিবাদ-মিছিলে সুস্মিতাকে নিয়ে শামিল হয়েছিলেন সুবীরবাবু। নিজেই সেকথা জানিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আমরা কিন্তু কোনও রাজনৈতিক স্বার্থে এই আন্দোলনে যুক্ত হইনি। একজন জুনিয়র ডাক্তারকে যেভাবে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, তা মেনে নিতে পারিনি। আমর মতো বহু প্রবাসী ভারতীয় সেই কারণেই মিছিল পর্যন্ত করেছি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখলাম, দাবি আদায়ের আন্দোলনে এসে পড়ল রাজনীতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জব্দ করার রাজনীতি। কেন তা হবে? বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তো প্রথম থেকেই এই ঘটনার বিচার চেয়ে সরব। আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকটি দাবি মেনে নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি সহানুভূতিও দেখিয়েছেন মমতা। তাহলে কেন তাঁকে অপদস্থ করার জন্য আন্দোলন চালাতে হবে?
পাঠকের নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, প্রবাসী মানুষজন, যাঁরা আরজি কর কাণ্ডে আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। ব্রাসেলস বিমানবন্দরে নেমে নির্দিষ্ট গন্তব্যে অর্থাৎ হোটেলে পৌঁছতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। সেখানে আমাদের আগে পৌঁছে গিয়েছিল দলের আট সদস্য। তারা দুর্গোপুজোর অষ্টমীর দিন রওনা হয়ে লন্ডন যায়। সেখান থেকে ব্রাসেলস। স্বাভাবিকভাবেই সবাই মিলিত হওয়ার পর একটা অনাবিল আনন্দের পরিবেশ। দু’দিন আমরা ব্রাসেলসে বেড়ালাম।

এরপর চলে এলাম হল্যান্ডের রাজধানী অ্যামস্টারডামে। দু’ঘণ্টার ইউরো-স্টার ট্রেনে দুই দেশের রাজধানীর সময়ের দূরত্ব। ট্রেনে চেপে সুন্দর সবুজে সাজানো গ্রাম আর ছবির মতো বাড়িঘর দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম রেল স্টেশনে। সেখান থেকে হোটেলে। চারদিন থাকা হবে ইউরোপের অন্যতম আকর্ষণীয় শহরে। পরের দিন ছিল রবিবার। ছুটির দিন। অয়ন ঘোষের সঙ্গে সন্ধ্যায় গেলাম হারলেম। আমার একজন বন্ধুর পুত্র অয়ন। অত্যন্ত অল্প বয়সে, মাত্র কয়েক বছর হল্যান্ডে থেকে প্রকৃত উন্নতি করেছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বড় চাকরির সুবাদে বাড়ি এবং গাড়ি কিনেছে। অ্যামস্টারডাম থেকে হারলেম গাড়িতে যেতে আধ ঘণ্টার মতো লাগলো। খুব সুন্দর শহর। উত্তর হল্যান্ডের রাজধানী। অয়নের ঘরে ঢুকে অবাক হলাম। সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে স্ত্রী কল্পনা টিভি দেখছে। বাংলা খবরের একটি জনপ্রিয় চ্যানেল। ওদের কথায়, ‘ছুটির দিনে বাংলা চ্যানেল দেখলে নিজেদের দেশের খবরাখবর জানা যায়। তাই দেখি। হালে তো আরজি কর কাণ্ড নিয়ে কত কী ঘটে গেল!’
সেদিনও টিভিতে দেখাচ্ছে অনশনরত আন্দোলনকারীদের। কর্মবিরতি প্রত্যাহার হয়নি। ওদের স্বামী-স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া হল, ‘বাংলায় রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই হয় না। এখানে যারা আরজি কর নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল, তারা সকলেই বুঝে গিয়েছে, এতবড় একটা কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনের নামে শধুই রাজনীতি হচ্ছে। সিবিআই কেন কিছু করতে পারছে না, সেসব কথা কেউ বলছে না।’

প্যারিসে তো বিমল চ্যাটার্জি আরও অবাক করে দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর ফ্রান্সের রাজধানীতে পৌঁছেছি। প্যারিসে প্রাতঃভ্রমণে ফুটপাতে হাঁটছি। হঠাৎ স্ত্রীকে এগিয়ে এনে আলাপ করলেন বিমলবাবু। মধ্যপ্রাচ্যের শহর বাহরিনের বাসিন্দা। বেড়াতে এসেছেন। একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদ-চ্যানেলের উচ্চ পদাধিকারি। আরজি কর কাণ্ড নিয়ে আন্দোলন তাঁরাও টিভিতে দেখেছেন। বিমলবাবু বলেই দিলেন, ‘কিসসু হবে না, ওই আন্দোলনের লাভ কমিউনিস্টরা নেবে, না হিন্দুদের ধ্বজাধারীরা নেবে, তার দড়ি টানাটানি চলছে। সত্যিকারেই সাধারণ নাগরিকদের নাড়িয়ে দেওয়া একটা এত বড় আন্দোলন দিশা হারিয়ে রাজনীতির চোরাগলিতে ঢুকে গেল!’

প্যারিসে রেস্তরাঁতে আলাপ হয়েছে নদিয়ার যুবক কালীচরণ বিশ্বাসের সঙ্গে। তাঁরও ক্ষোভ, ‘গোটা বিশ্বের কাছে বাংলার মাথা কী করে হেঁট করে দেওয়া যায়, তার চেষ্টাই চলছে। এটা কিসের আন্দোলন? ডাক্তাররা কাজ না করলে হাসপাতাল চলবে কী করে? এসব দেশে এরকম ভাবাই যায় না।’

Advertisement