বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ-র বিরাজ জয়ে উল্লসিত ও পুলকিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র কর্মীদের উদ্দেশ্যে জানালেন, এই অভূতপূর্ব জয় পশ্চিমবঙ্গে ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার গঠনে সাহায্য করবে। শুনে উৎসাহে ফেটে পড়ল। দলীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং হাততালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বাহবা জানালেন।
বিহার হয়ে গঙ্গা বয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছি ঠিকই। কিন্তু বিহারে ভোটের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গে প্রভাবিত হবে—প্রধানমন্ত্রীর এই আশা নিরাশায় পরিণত হবে না তো? কারণ এখানে যে প্রশাসনের হাল শক্ত হাতে ধরে আছেন আর কেউ নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে হারিয়ে বিরোধী বিজেপি প্রশাসনের হাল ধরবে, সেই আশা, সেই স্বপ্ন বিফলে যাবে না তো? পশ্চিমবঙ্গ বিহার নয়— এ রাজ্য এমন একটি রাজ্য যার মানুষ মুখ্যমন্ত্রীকে ভালোবাসেন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রচুর সংখ্যক জনহিতকর প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের ফলে উপকৃত। মুখ্যমন্ত্রীও তাঁদের ভালোবাসেন। মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রী খুশি, আপ্লুত। সুতরাং ২০২৫ বিধানসভা নির্বাচনে বিহারে বিজেপি যে বড় জয় পেল, পশ্চিমবঙ্গেও এই দলের সেই জয় পাবে, এটা কল্পনায় আশা করা যায়, কিন্তু বাস্তবে পরিণত করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ রাজ্যের মানুষ তৃণমূল প্রার্থীদের ভোট দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাই বিহারে বিজেপি জয় ছাব্বিশে এখানেও দেখা যাবে, প্রধানমন্ত্রীর এই আশা বাস্তবসম্মত নয় বলেই মনে হয়। ২০১১ ভোটে বিজেপি সেই স্বপ্নই দেখেছিল— শাসক দলকে উৎখাত করে বিজেপির পদ্ম প্রতীক মার্কা পতাকা এ বঙ্গে উড়বে। কিন্তু পতাকা উড়ল তো নাই-ই— যে আসনগুলি (৭৭) পেয়েছিল, তাও ধরে রাখতে পারল না। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বিজেপির টিকিটে জিতে শাসক দল তৃণমূলে যোগ দিলেন। এখন যাঁরা এই দলের বিধায়ক আছেন, তাঁদের মধ্যেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল, সমন্বয়ের অভাব। রাজ্যের বিজেপি নেতারা মনে করেন, বিহারের ভোটের ফলাফল তাদের দলকে প্রেরণা জোগাবে এবং তৃণমূলকে উচ্ছেদ করে গৈরিক পতাকা উড়বে— বিহার সেই রাস্তা দেখাল। কিন্তু এই রাস্তা সোজা রাস্তা নয়— বিজেপির পক্ষে এই রাস্তায় হাঁটা কখনও সাবলীল হতে পারেনি। পারবে বলেও মনে হয় না।
Advertisement
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বড় বড় নেতা যাঁরা এই দলকে শক্তিশালী করে তুলবে এবং আগামী বিধানসভার ভোটে তৃণমূলে র সাথে টক্কর দেবে, তাঁদের মধ্যেই একতার অভাব। মানুষের ভোটে দল জিতে এবং সেই দল সরকার গঠন করে— কিন্তু সেই মানুষই যদি বিজেপির এই দৈন্য দশা দেখে, তাহলে কি তাঁরা এই দলকে ভোট দিতে জেতাবে? বিশ্বাস করবে এই দল সুশাসন দেবে এবং সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াবে? শুধু দুর্নীতি এবং তৃণমূল সরকারের অপশাসন বলে রব তুললে এই দলের ঝুলিতে ভোট আসবে না। রাজ্যের মানুষ ততটা গুরুত্ব দিয়ে এই দুর্নীতির বিচার করে না। তারা দেখে কোন দল তাদের পাশে থেকে তাদের সুখ-দুঃখের ভাগী হবে— সেই দল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। এই দলকেই তারা বেশি বিশ্বাস করে। সুতরাং ভোটে এই দলই জেতে। ২০২৬-এর নির্বাচনেও ক্ষমতা ধরে রাখবে এই বিশ্বাস আছে।
Advertisement
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে দাঁড় করাতে পারছে না রাজ্যের নেতারা। কারণ তাদের মধ্যে সমন্বয়ের যেমন অভাব, তেমনই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও প্রবল। একমাত্র বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দলকে টেনে তুলতে একটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করছেন। যেখানে গণ্ডগোল, যেখানে মানুষ বিপন্ন সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। এই দলে এতদিন পূর্ণ সময়ের জন্য সভাপতি ছিল না। যিনি ছিলেন তিনি সুকান্ত মজুমদার— পরে তিনি কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়ে দলের কাজে সেভাবে মন দিতে পারতেন না। সম্প্রতি শমীক ভট্টাচার্য রাজ্য বিজেপির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মুখে তৃণমূলের যত সমালোচনা করেন, তার নিজের দলের উত্থানে সেরকম কার্যকরী ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না। কথায়, শাসক দলের সমালোচনায় ভোট পাওয়া যায় না। ভোট পেতে হলে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়।
কেন্দ্রের বিজেপি নেতারা চান, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি মাথা তুলে দাঁড়াক। তার জন্য তাঁরা চেষ্টারও ত্রুটি রাখছেন না। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তিনবার এসে রাজ্যে ঘুরে গেছেন। তিনি রাজ্যের মানুষকে আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর জনসভায় লোক হয়। তাঁরা তাঁর কথা শোনে, কিন্তু ভোট দেয় তৃণমূলের বাক্সে। এমনটাই হল ২০১৬-এর নির্বাচন। ভোটের আর বেশি দেরি নেই। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ভোটকুশলী গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচনের আগে বারবার আসবেন এবং ভোটের আসর গরম করবেন। তৃণমূল একটি বড় সংগঠিত দল— এ দলেও গোষ্ঠী কলহ আছে। কিন্তু মানুষ তা গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন তৃণমূলের হাল ধরে আছেন, ততদিন দল রাজ্যের মানুষের সমর্থন এবং ভোট পাবে, সে আশা করাই যায়। সুতরাং বিহারের ফল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা উচ্ছ্বসিত হলেও, এখানে তার ফল মিলবে বলে মনে হয় না। তবে ভোটে কোন দল জিতবে, নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ভোট দেবেন রাজ্যের মানুষ।
Advertisement



