• facebook
  • twitter
Thursday, 6 February, 2025

সর্বভারতীয় অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বিঠল রামজি শিণ্ডে

সমাজ সংস্কারক, গবেষক এবং লেখক বিঠল রামজি শিল্ডে ছিলেন ধর্মীয় ঐক্যের প্রবক্তা। তাঁর লেখায় তিনি জাতিভেদ প্রথা, মূর্তিপূজা এবং নারী ও অবদমিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে অসাম্যের বিরোধিতা করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান, বংশগত যাজকত্বের আধিপত্য এবং পুরোহিতের প্রয়োজনীয়তার বিরোধিতা করেছেন। আমৃত্যু তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

ফাইল চিত্র

ড. বিমলকুমার শীট

অস্পৃশ্যতা হিন্দু সমাজের এক অভিশাপ। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই অমানবিক জঘন্য প্রথার শিকার হতে হয়েছে হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের। পেশোয়া শাসনের সময়ে মহারাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়জয়কার। সামাজিক আচরণ তথা নীতি নিয়মের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব ছিল বিতর্কাতীত। পেশোয়াদের সময়ে উচ্চবর্ণের হিন্দু আসা-যাওয়া করার সময় দলিত লোককে রাজপথ দিয়ে আসা-যাওয়া করতে দেওয়া হত না। কারণ, তাঁদের ছায়াটাও উচ্চবর্ণের ‘পবিত্রতা’ নষ্ট করতে পারে, তাঁর জন্য তাঁদের হাতে বা গলায় একটা কালো সুতো পরতে হত। তাই সমাজ সংস্কারকেরা অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। যদিও জ্যোতিরাও ফুলে মহারাষ্ট্রে অস্পৃশ্যদের জন্য স্কুল স্থাপন করেন এবং তাঁদের সর্বতোভাবে উন্নতির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে বি আর আম্বেদকরের আগে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে তেমন কাউকে দেখা যায় নি। তবে অন্যতম সমাজসংস্কারক বিঠল রামজি শিণ্ডে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তখন অস্পৃশ্যতা আর আঞ্চলিক বিষয় হয়ে রইল না। সর্বভারতীয় বিষয় হয়ে উঠল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে বি আর শিণ্ডে তার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একে এক বিরাট পরিবর্তন বলা যেতে পারে।

বিঠল রামজি শিণ্ডে (১৮৭৩-১৯৪৪) ২৩ এপ্রিল কর্ণাটকের এক ঐতিহ্যবাহী উদার মারাঠা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জামখান্দির ইংরেজি ভাষা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করে ফার্গুসন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বরোদার মহারাজা তৃতীয় সায়াজিরাও গায়কয়াড় এর বৃত্তি নিয়ে তিনি ইংল্যাণ্ডে পাড়ি দেন। অক্সফোর্ডে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, পালিভাষা, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান অধ্যয়ন করার পর তিনি দেশে ফেরেন। মারাঠী সন্ত তুকারাম, সন্ত একনাথ, রামদাস পাঠের মাধ্যমে শিণ্ডের আধ্যাত্মিক জাগরণ শুরু হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বাট স্পেনসার, ম্যাক্সমুলার, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, আর জি ভাণ্ডারকর দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। ১৯০৩ সালে শিণ্ডে ভারতে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত ত্রিবার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। এখানে তিনি ‘ভারতে লিবারেলিজম’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন। ভারতে ফিরে আসার পর তিনি মুম্বাইয়ে প্রার্থনা সমাজের ধর্ম প্রচারক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯১০ সালে প্রার্থনা সমাজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ইতি ঘটে। পরে ম্যাঙ্গালোরে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক হিসাবে কাজ শুরু করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একজন ব্রাহ্ম ভক্ত ছিলেন।

বিঠল রামজি শিণ্ডে জাতীয় কংগ্রেসের প্রায় সম্মেলন গুলোতে যুক্ত থাকতেন এবং অস্পৃশ্যতা বিরোধী ধ্যান ধারণাকে তুলে ধরতেন। জাতীয় কংগ্রেস কিন্তু প্রথম থেকে সামাজিক সমস্যাসমূহকে এড়িয়ে চলত। তবে তা বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। ১৯০১ সালে আদম শুমারির উপর ভিত্তি করে শিণ্ডে বলেছিলেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অস্পৃশ্যদের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক ষষ্ঠাংশ (মোট জন সংখ্যা ২৯,৪৩,৬১,০৫৬ এর মধ্যে মাত্র পাঁচ কোটি অস্পৃশ্য)। এদের উন্নতির জন্য একটি জাতীয় মিশন প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাই তিনি নারায়ণরাও চন্দ্রওয়াকারের নির্দেশে ১৯০৬ সালে মুম্বাইয়ে ডিপ্রেসড ক্লাস মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের সম্পাদক হন শিণ্ডে নিজে। এর উদ্দেশ্য ছিল অস্পৃশ্য হতাশাগ্রস্ত জাতিগুলির শতাব্দী প্রাচীণ হীনমন্যতা দূর করে তাঁদের স্বাধীন করে তোলা এবং উচ্চবর্ণের মধ্যে বিরাজমান নৃশংস বর্ণবাদী ধারনাকে ধ্বংস করা। তাই শিণ্ডের উদ্যোগে ১৯০৭ সাল থেকে All India Anti- Untouchability Conference অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ভারতের নানা প্রান্তে বিশিষ্ট জনদের সভাপতিত্বে নিম্নলিখিত এই সম্মেলন সমূহ অনুষ্ঠিত হতে থাকে- ১৯০৭ সালে সুরাটে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০৮ সালে বাঁকিপুরে রায় বাহাদুর মুদলোকার, ১৯১০ সালে মাদ্রাজে গোপালকৃষ্ণ গোখলে, ১৯১২ সালে করাচিতে লালা লাজপৎ রায়, ১৯১৮ সালে সায়াজিরাও গাইকোয়াড়, ১৯২০ সালে নাগপুরে মহাত্মা গান্ধী, ১৯২৩ সালে পুণেতে বি চক্রনারায়ণ, ১৯২৪ সালে বেলগাঁওতে সি রামলিঙ্গ রেড্ডি, ১৯২৫ সালে অমরাবতীতে বি ভি যাদব, ১৯২৭ সালে ব্যাঙ্গালোরে যমুনালাল বাজাজের নেতৃত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৩১ সালে পুণেতে বিঠল রামজি শিণ্ডের সভাপতিত্বে All India Anti- Untouchability Conference অনুষ্ঠিত হয়। মুম্বাই প্রদেশেও শিণ্ডের উদ্যোগে পুণেতে (১৯১২), বিজাপুরে (১৯১৮), শোলাপুরে (১৯১৯), পুণেতে (১৯২৩) ও (১৯২৬), রত্নগিরি (১৯৩১)-তে Anti- Untouchabitity Conference অনুষ্ঠিত হয়। বরোদার মহারাজা সিয়াজিরাও গাইকোয়াড়ের সভাপতিত্বে ১৯১৮ সালে মুম্বাইতে অনুষ্ঠিত সারা ভারত অস্পৃশ্যতা বিরোধী সম্মেলনে এক প্রস্তাব পাশ হয়। যা ভারতে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয়। অবিলম্বে এই সম্মেলন অস্পৃশ্যতার বিলোপ ঘটাবে এবং অস্পৃশ্যতা বিরোধী মানসিকতা সম্পন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা প্রতিটি প্রদেশে ইস্তাহার প্রকাশ করে যাতে পাবলিক প্রতিষ্ঠান যেমন স্কুল, বিচারালয়, বিভিন্ন সংস্থা কূপ, স্নানঘাট এবং শ্মশানঘাট, বাণিজ্যিক স্থান, ধর্মীয় স্থান, প্রস্রবণ, পৌরসভাকৃত জলসরবরাহ কেন্দ্র, বিনোদন স্থান প্রভৃতি স্থানসমূহে অস্পৃশ্য মানুষেরা বিণা বাধায় ব্যবহার করতে পারে তা নিশ্চিত করা। উপরিউক্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন মুম্বাইর এম আর জয়াকার। সমর্থন করেন বরদার পণ্ডিত বালকৃষ্ণ শর্মা এবং পুণের জি সি ভাট। সম্মেলন স্থলে সারা ভারত থেকে আগত এক হাজার জন লোক অস্পৃশ্যতা বিরোধী ইস্তাহারে স্বাক্ষর দান করেন। এই সমস্ত কিছু শিণ্ডের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়ে ছিল।

বিঠল রামজি শিণ্ডে কেবল Depressed Mission এবং All India Anti- Untouchability Conference এর কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি উপলব্ধি করে ছিলেন জাতীয় কংগ্রেস হল এক সর্বভারতীয় মঞ্চ। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এর সদস্য। এবং তাঁর প্রচার সারা দেশ জুড়ে। তাই এই মঞ্চকে ব্যবহার করলে অস্পৃশ্যতা বিরোধী প্রচার আরও বেশি শক্তিশালী হবে ও গুরুত্ব পাবে। দশ বছর ধরে শিণ্ডের অদম্য প্রচেষ্টার ফলে সভাপতি অ্যানি বেসান্ত এর সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (১৯১৭) অস্পৃশ্যদের পক্ষে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। “ This Congress urges upon the people of India the necessity, justice, and righteousness of removing all disabilities imposed upon the Depressed classes, the disabilities being of a most vexatious and oppressive character, subjecting these people to considerable hardship and inconvenience.” ১৯২০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে শিণ্ডে অস্পৃশ্যতার সমস্যাটি গান্ধীজির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তী আমেদাবাদ অধিবেশনে গান্ধীজি অস্পৃশ্যতা বিষয়টিকে দূরকরার জন্য তা আবশ্যক হিসাবে ঘোষণা করেন। শিল্ডের অনুগামীরা তাঁকে মারাঠাদের জন্য সংরক্ষিত মুম্বাই ল-কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, বরং তিনি পশ্চাতপদ শ্রেণীর বহুজন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন এবং তাঁদের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তিনি এই নির্বাচনে পরাজিত হন। ১৯১৮ সালে পুনেতে তিনি বালক বালিকাদের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলেন। ১৯২০ সালের পরবর্তী সময় শিণ্ডে আদর্শগত ভাবে সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন।

বিঠল রামজি শিণ্ডে কৃষক দরদীও ছিলেন। ১৯২৭ সালে মহারাষ্ট্রে স্মল হোল্ডিংস বিলের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয় তাতে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। তিনি বিভিন্ন জেলায় সভা সমাবেশ করে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। পুণের সভাতে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের হাজার হাজার কৃষক জড়ো হয়ে সরকারের কৃষিনীতির বিরোধীতা করেন। গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনে শিণ্ডের অংশ গ্রহণের কারনে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ছ-মাস কারাদণ্ড প্রদান করে।

সমাজ সংস্কারক, গবেষক এবং লেখক বিঠল রামজি শিল্ডে ছিলেন ধর্মীয় ঐক্যের প্রবক্তা। তাঁর লেখায় তিনি জাতিভেদ প্রথা, মূর্তিপূজা এবং নারী ও অবদমিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে অসাম্যের বিরোধিতা করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান, বংশগত যাজকত্বের আধিপত্য এবং পুরোহিতের প্রয়োজনীয়তার বিরোধিতা করেছেন। আমৃত্যু তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।