মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনদিনের উত্তরবঙ্গ সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত তিনি উত্তরবঙ্গকে ভালোবাসেন। তাই সুযোগ পেলেই তিনি সেখানে যান। উত্তরবঙ্গের উন্নতির জন্য তিনি এবারও নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন— তার বাস্তবীকরণ হলে উত্তরবঙ্গবাসী উপকৃত হবেন। উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক দৃশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে মুগ্ধ করে। এর আগের এক সফরে চা-বাগানের কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি চা-পাতা তোলেন। তৃণমূল জমানায় উত্তরবঙ্গের যে উন্নয়ন হয়েছে, তার জন্য এই বঙ্গ অবহেলিত, সেই অভিযোগ অনেকটাই দূর হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার উত্তরবঙ্গের প্রতি বঞ্চনা চালিয়েই যাচ্ছে। এবারের তাঁর সফরে মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করেছেন বিভিন্ন প্রকল্পে, তা কার্যকরী হলে এ বঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার হয়ে যাবে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল থাকবে না জেলাগুলি।
রাজনৈতিক দিক থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর এবারের সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গত বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় পার্টি (বিজেপি) উত্তরবঙ্গে সন্তোষজনক ফল পেয়েছিল। তা নিয়ে বিজেপির গর্ব ছিল। বলা হত উত্তরবঙ্গ বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। কিন্তু সেই শক্ত ঘাঁটি আর নেই— শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস সেখানে থাবা বসিয়েছে। গত উপনির্বাচনে মাদারিহাট আসনটি, যা তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল, দখল করতে পারেন, ওই নির্বাচনে সেই আসনটি তৃণমূলের ঝুলিতে চলে এসেছে— সেটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সম্প্রতি জন বার্লা, যিনি বিজেপির প্রাক্তন রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, শাসকদল তৃণমূলে যোগ দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে প্রশাসন চালান অতি দক্ষতার সঙ্গে এবং তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর পুরনো দল ছাড়লেন। জন বার্লার তৃণমূলে যোগ দেওয়াতে চা-বাগানের কর্মীদের মধ্যে তৃণমূলের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে। জন বার্লা মন্ত্রিত্ব খুইয়ে অনেক দিন আগে থেকেই বিজেপির প্রতি তাঁর মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। এতদ্বারা, বিজেপি উত্তরবঙ্গে আরও দুর্বল হয়ে পড়ল বার্লাকে হারিয়ে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই দল ৭৭ আসন পেয়েছিল— কিন্তু রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের জন্য সবাইকে ধরে রাখতে পারল না। শাসক দলে যোগদানের মজাই আলাদা এই কথা ভেবে অনেকেই এই দলে চলে এসেছেন। সবারই একই সুরে কথা দল বদলের—তা হল মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসন চালানোর দক্ষতায় তাঁরা খুশি। তাই তাঁর নেতৃত্বাধীন যে দল সেখানে যোগ দিয়ে জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করা। যতবারই মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে যান, তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস নতুন উদ্দমে জেগে ওঠে—শক্তিশালী হয়। সুতরাং বিজেপি উত্তরবঙ্গের মাটি হারাচ্ছে। আর শাসক দল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্যে পরিণত করার একটি সুপ্ত দাবি কিছু মানুষের মনে আছে। তার কারণ উত্তরবঙ্গ অবহেলিত যে সরকারই ক্ষমতাসীন হোক না কেন। কিন্তু তৃণমূলের শাসনে সে দাবি আর উঠতে দেখা যাচ্ছে না।
বাম জমানাতেই উত্তরবঙ্গ অবহেলিত ছিল। মূলত কৃষিনির্ভর উত্তরবঙ্গে কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি। কয়েকটি জেলায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গঠিত হয়েছিল বাম শাসনে। কিন্তু সেখানে কোনও শিল্প গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। এবং দীর্ঘ বাম জমানায় উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে নানা অভিযোগ শোনা যায়। অথচ বামেদের সুযোগ ছিল উত্তরবঙ্গকে শিল্পসমৃদ্ধ করার। পরে দেখা গেল সেই শিল্প পার্কে গরু চড়ছে।
মুখ্যমন্ত্রী আটটি উত্তরবঙ্গের জেলায় শিল্পপতিদের নিয়ে সম্মেলন করলেন। তাতে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের অনেক শিল্পপতি যোগ দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি খুশি হবেন, তার চাইতেও এই বঙ্গের মানুষ বেশি খুশি হবেন, যদি তাঁরা উত্তরবঙ্গে বিনিয়োগ করেন। এখানে ছোট, মাঝারি এবং ভারী শিল্প স্থাপনের সবরকম সুযোগসুবিধা রয়েছে। জমির অভাব নেই, ঢালাও বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলবে সাগরদিঘির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কল্যাণে। প্রকৃতপক্ষে সাগরদিঘিই পশ্চিমবঙ্গের বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। তাছাড়া জলের অভাব নেই— যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত। সরকারের সাহায্য-সহযোগিতাও মিলবে প্রয়োজনে। তদুপরি আইনশৃঙ্খলাও সন্তোষজনক। শিল্পপতিরা তাই উৎসাহিত বোধ করলেন উত্তরবঙ্গে বিনিয়োগ করতে। এখানে মাঝারি ও ভারী শিল্প হলে, অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
ডাবগ্রামে সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং নতুন শিল্প স্থাপনের যে অনুষ্ঠান হয়, তার সভাপতিত্বে—সেখানে মুখ্যমন্ত্রী একগুচ্ছ প্রকল্পের শিলান্যাস এবং একগুচ্ছ প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়োর পর তার উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, ‘তিনি জাদুকর নন, চাইলেই আকাশ থেকে টাকা পড়বে না।’ এই দিন ৩৬৫ প্রকল্পের জন্য তিনি ২৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থের কথা ঘোষণা করেন। এই প্রকল্পগুলির কাজ যাতে যথাসময়ে শুরু এবং শেষ হয়, তার জন্য তিনি নিজে নজর রাখবেন। কেন্দ্রের তীব্র সমালোচনা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা এবং গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পে গত চার বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যের কোষাগার তেকেই প্রকল্পগুলি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে রাজ্যের। তিনি শিল্প সম্মেলনে ঘোষণা করেন, দক্ষিণবঙ্গে যেভাবে প্রতিবছর শিল্প সম্মেলন হয়, সেইরূপ উত্তরবঙ্গেও শিল্প সম্মেলন হবে প্রতিবছরই। জিএসটি বাবদ রাজ্য থেকে টাকা তোলে কেন্দ্র—কিন্তু তাতে যে রাজ্যের ভাগ রয়েছে তা থেকে রাজ্যকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই— সুতরাং মুখ্যমন্ত্রীর এই সফরে উত্তরবঙ্গবাসীদের তৃণমূলের প্রতি সমর্থন বাড়বে সন্দেহ নেই।