• facebook
  • twitter
Friday, 23 May, 2025

সপ্তাহে ৭০ থেকে ৯০ ঘন্টা কাজের সওয়ালে দেশপ্রেম নেই

আছে নগ্ন ব্যবসায়িক স্বার্থপরতা

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

জীবনের জন্য কাজ জরুরি হলেও কাজের জন্য জীবনকে দেখায় গড়মিল স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কাজকে কেন্দ্র করে যখন জীবনের অস্তিত্ব আবর্তিত হয়, তখন তা অস্বাভাবিকতায় দুর্ভার মনে হয়। সেখানে সাধ, সাধ্য ও সক্ষমতার সম্পর্কটি আমরা কোনওভাবেই উপেক্ষা করতে পারি না। সেক্ষেত্রে যত বেশি সময়, তত বেশি কাজের প্রত্যাশায় কাজের সময় অতি বৃদ্ধিও অস্বাভাবিকতায় অমানবিক মনে হতে পারে। সম্প্রতি কাজের সময় নিয়ে এরকম অপ্রত্যাশিত চাহিদা অস্বাস্থ্যকর বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এমনিতেই শ্রমিকের দিনে আট ঘন্টার কাজের সময় থেকে আরও অতিরিক্ত সময় কাজ করার ক্ষেত্রে ওভারটাইমের কথা আমাদের শোনা। অবশ্য সেই ওভারটাইম শ্রমিকের সদিচ্ছার উপরে নির্ভর করায় অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদের মধ্যে বেশি কাজ করে বেশি আয় করার সদিচ্ছা জেগে ওঠে। সেই সদিচ্ছা বা চাহিদাকে বাধ্যতামূলক করে দেখা কখনওই সমীচীন হতে পারে না। অতিরিক্ত আয়ের প্রয়োজনেই লোকে অমানুষিক পরিশ্রম করে থাকে। তা স্বাভাবিক জীবনের পক্ষে কোনওভাবেই প্রত্যাশিত নয়। সেখানে কয়েক মাস আগে ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণমূর্তি দেশের তরুণদের কাছে সপ্তাহে সত্তর ঘন্টার কাজের আহ্বান করে যে বিতর্কের সূচনা করেছিলেন, তার রেশ না কাটতেই অচিরেই তা আরও বিস্ফোরক হয়ে ওঠে। এন আর নারায়ণমূর্তির দিনকয়েক পরে লার্সেন এন্ড টুব্রোর চেয়ারম্যান এস এন সুব্রহ্মণ্যন সপ্তাহে নব্বই ঘন্টা কাজের সওয়াল করে বিষয়টিকে আরও অস্বাভাবিক প্রত্যাশার অশনি সংকেত করে তোলেন। এমনিতেই তীব্র গতিময় আধুনিক জীবনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন আজ বিপন্ন। সেখানে কর্মজীবনের ভারে নতজানু মানুষের মানসিক চাপ কমানোর কথা তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে বেশি কাজের চাপে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে উৎপাদক শ্রমিকের কার্যক্ষমতা হ্রাসের সম্ভাবনাই শুধু নয়, তার জীবনের চাহিদাতেও বেসামাল হওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কাজের সময় বৃদ্ধির চেয়েও কর্মীর সময় দেওয়ার সক্ষমতার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জীবনের জন্য কাজকে কাজের জন্য জীবন করে নেওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, সেখানে আরও একটি জরুরি বিষয় উপেক্ষিত হয়। তা হল, কাজের সময়কে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে সময়ের কাজকেই অস্বীকার করা।

আসলে শারীরিক কাজ বা কায়িক শ্রম দেখা যায়,বোঝা যায়। বাঁধাধরা সময়ের পরিসরেই তার মূল্যায়নও চলে, প্রত্যাশাও শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। সেখানে মানসিক শ্রম অদৃশ্য, লক্ষ্যাভিমুখী চলে অবিরত। সময়ের সীমায় তা অধরা মাধুরী। সেখানে সবার অলক্ষ্যে থাকে গভীর অধ্যবসায়, কঠোর সাধনা ও অনুশীলন এবং সনিষ্ঠ আত্মত্যাগ। সেক্ষেত্রে কাজের সময়ের বাড়বাড়ন্তের লক্ষ্যেই সেই সময়ের কাজ উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে যন্ত্রনির্ভর আধুনিক সভ্যতায় যন্ত্রপাতির যতই উন্নতি ঘটুক, বণিকতন্ত্রে এখনও মানুষের শ্রমের কোনও বিকল্প নেই। সেখানে কাজের সময় বাড়িয়ে আরও বেশি কাজ,আরও বেশি উৎপাদন, আরও বেশি মুনাফার হাতছানি স্বাভাবিকভাবেই শ্রমের বাজারেও তীব্র প্রতিযোগিতা নেমে আসে। কাজের সময় বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি থেকে সময়ের মধ্যে কাজ হাসিল করার তৎপরতা সর্বত্রই ব্যবসায়ী মনোভাব অতি সক্রিয়তায় শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন সাপ্তাহিক ছুটি বাড়িয়ে সরকারি কর্মচারীদের মানসিক চাপ কমানোর কথা শোনা যায়, অন্যদিকে তেমনই তার উল্টো পথে বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজের সময় বাড়ানো বা ওভারটাইমে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা জারি থাকে। তারই পরিসরে কাজের সময় বাড়ানো নিয়ে সম্প্রতি বিতর্কটি আপনাতেই হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। তা নিয়ে রীতিমতো গণমাধ্যমে শোরগোল পড়েছে। সপ্তাহে সত্তর ঘন্টা থেকে নব্বই ঘন্টা কাজের সময় করার সওয়াল স্বনামধন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানদের মুখে উঠে আসায় স্বাভাবিক ভাবেই তা নিয়ে অপ্রত্যাশিত শ্রমিক বিরোধী মানসিকতা সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রথমত, কাজের সময় বাড়ালেই উৎপাদন বাড়বে বা সাফল্যের পরিমাণ বেড়ে যাবে এ রকম ধারণা যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও শ্রমিক বা কর্মীর উপরে স্বাভাবিক নয়। রক্তমাংসের মানুষ শরীর, মন ও মানসিকতার সঙ্গে সাধ সাধ্য ও সক্ষমতার যোগ অত্যন্ত নিবিড়। সেখানে কাজের সময় বাড়াতে চাইলেই বাড়ানো যায় না, তার সঙ্গে বাড়তি সময়ে শ্রমিকের কাজ করার সক্ষমতার প্রশ্নটিও জড়িত। সেই সক্ষমতা শারীরিক ও মানসিক ভাবেই জড়িত নয়, শ্রমিকের জীবনের সঙ্গেও বিজড়িত। কাজের সময় বাড়াতে গিয়ে তার জীবনযাপনের স্বাভাবিক সময় কমে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, কাজের চাপে বিপন্নতাবোধে জীবনকেই অভিশপ্ত মনে হওয়া স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে সদিচ্ছা থাকলে সময়ের মধ্যেই অনেক বেশি কাজ করা যায়। এজন্য কাজের সময় বাড়িয়ে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মধ্যে ব্যবসায়ী দৃষ্টি যত বিস্তার লাভ করে, কাজের চাপে শ্রমিকের স্বাভাবিক জীবন ততই আহত ও ব্যাহত হয়। যেখানে কর্মীর কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতার শ্রীবৃদ্ধি ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির স্বার্থেই তার স্বাস্থ্যকর অবকাশ ও ছুটি অত্যন্ত জরুরি, সেখানে কাজের সময় বাড়িয়ে তা লঘু করার আয়োজন শুধু কর্মীর জীবনকেই অমানবিক করে তোলে না,ব্যবসায়িক স্বার্থে কতটা সাফল্য পাবে,তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

অন্যদিকে সময়ের কাজ সময়ে করার পাঠ আমাদের ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়ে যায়। সেখানে অস্থির ও ক্ষণস্থায়ী সময়কে কাজে লাগানো নিয়ে সদা সতর্ক দৃষ্টি অভ্যাসের ফেরে পড়ে বলে বাবে বারেই সময়ের তর্জনী আমাদের জাগিয়ে তুলতে চায়, চাগিয়ে রাখতে সদা সক্রিয় থাকে। নদীর স্রোতের মতোই তার নিরন্তর চলনে মানুষের দৈনন্দিন কাজে তার সূর্যের দিকে তাকিয়ে বেলা দেখার জীবন যে কখন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে চলতে শুরু করে,আধুনিক বিশ্বের দ্রুতগামী যন্ত্র সভ্যতায় আঙুলের ডগায় অনলাইনে মগ্ন জীবনে তা ফিরে দেখারও আর ফুরসত নেই আমাদের। সময়ের মূল্যবোধ দ্রুততার সঙ্গে বদলে যায়। একসময় মনে করা হত ‘Time is precious’। পুরনো মূল্যবোধে সময়ের অমূল্য পরিসর নানাভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। রামপ্রসাদী গানে তার পরিচয় আমাদের ভাবিয়ে তোলে, ‘এমন মানব-জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত শোনা।’ শুধু তাই নয়, আধ্যাত্মিক চেতনাতেও তার বিস্তার, ‘মরণের ফুল বড় হয়ে ওঠে জীবনের উদ্যানে’। শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদীদের চোখে সময়ের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তখন সময়ই অর্থমূল্য লাভ করে। বিশ শতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে সময় আরও মহার্ঘ হয়ে ওঠে। অর্থের গরিমায় সময়ের মূল্য দ্রুত গতিতে আরও বেশি গতি লাভে মুখর হয়ে ওঠে। আধুনিক ভোগবাদী জীবনে টাকা যেভাবে মধুকেও হার মানিয়ে চলে ‘Money is sweeter than honey’, সেভাবে সময়ও অর্থে একাত্ম হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জাভাযাত্রীর পত্র’-এ বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে পণ্যায়িত বিশ্বে সময়ের অর্থমূল্য প্রাপ্তির কথা মনে করিয়ে উদ্ধৃত করেছেন, ‘Time is money’। সেক্ষেত্রে শুধু ঘড়ির কাটায় কাজের সঙ্গে সময়ের যোগই আধুনিক সময়ে মহার্ঘ হয়ে ওঠেনি,কীভাবে সময়কে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি উদ্ভাবনী শক্তিতে বা সাধনায় নিমগ্ন হওয়া যায়,তার সদর্থক ভূমিকাও বর্তমান। সেখানে সময়ের সীমায় কর্মীকে বেঁধে রেখে তার শারীরিক ও মানসিক অস্তিত্বকে বিপন্ন করে আখেরে তার কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতার প্রতি অবিচার করা হবে। সময়ের পরিসরে যা স্বাভাবিক, অতিরিক্ত সময়ে অতিরিক্ত আদায় করতে গিয়ে ক্লান্তি ও অবসাদের মধ্যে তা কখনওই সম্ভব নয়। বরং সময়ের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে গিয়ে তার চাপ কাটিয়ে ওঠার জন্য যেমন কাজের গতি কমে আসবে,তেমনই তার সাধনায় উদ্ভাবনী শক্তি অকেজো হয়ে পড়বে। কেন না ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে অদৃশ্য সাধনা কেজো মূল্য লাভ করে না। অন্যদিকে কাজে বেশি সময় দিতে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনের সময়ই কমে যায় না, কর্মক্ষেত্রের চাপে পারিবারিক জীবনেও বিপর্যয়ের প্রবল সম্ভাবনা।

এমনিতেই আধুনিক বিশ্বে সময়ের গতিতে পিছিয়ে পড়ার হীনমন্যতাবোধে মানসিক চাপে বিপর্যস্ত জীবনে হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ায় আকস্মিক মৃত্যুর পরিসর ক্রমশ বিস্তার লাভ করে চলেছে। তার মধ্যে কাজের সময় বাড়ানোর সওয়াল স্বাভাবিক ভাবেই মানবিক মূল্যবোধকেই অস্বীকার করে না,সেইসঙ্গে দাসত্বের জীবনকে স্মরণ করিয়ে অশনি সংকেত জাগিয়ে তোলে। একদা গৃহবাসী মানুষ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের জন্যই কর্মক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেছিল। সেই কর্মক্ষেত্রই যদি তার পারিবারিক গৃহবাসকে আত্মসাৎ করতে চায়, তখন তার আগ্রাসী ক্ষুধায় তার ছিন্নমূল জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে দাসত্বের আত্মগ্লানি জেগে ওঠাটাই দস্তুর। সেক্ষেত্রে কাজের সময় বাড়ানোর সওয়ালের মধ্যে প্রকারান্তরে দেশে প্রচলিত কাজের সময় ও কাজের অধিকারকে অস্বীকার করার মধ্যে দেশপ্রেম নেই, আছে নগ্ন ব্যবসায়িক স্বার্থপরতা। দেশের স্বার্থ দেশের মানুষের ভালো থাকা। কেননা মানুষই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সেদিক থেকে সেই শ্রমজীবী মানুষকে বিপদে ফেলে কাজের সময় বাড়ানোর সওয়াল শুধু অমানবিক নয়,দেশবিরোধীও।