প্রমথরঞ্জন ভট্টাচার্য
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় (১৮ জুন, ২০২৪) বিজ্ঞানীরা আশাতীত সাফল্যের সঙ্গে সৃজনশীল বা ক্রিয়েটিভিটির মূলে মস্তিত্বের স্নায়বিক কর্মজালের (নিউরাল নেটওয়ার্ক অব ব্রেন) যে অংশ জড়িত নিপুনভাবে তা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষের দীর্ঘদিনের অদম্য আগ্রহ এবং তীব্র কৌতুহলের নিরসন ঘটিয়েছে বিজ্ঞানীদের এই প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। বিজ্ঞানীদের এই অসামান্য সাফল্যের ফলে ভবিষ্যতে নানাবিধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের সৃজনশীলতার উন্নতিসাধন করা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। এখন প্রশ্ন জাগে সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি বলতে কি বোঝায়?
Advertisement
সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি হল নিজস্ব কল্পনা ও চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে নতুন এবং মূল্যবান কোন ধারণা, কাজ, জিনিস বা পদ্ধতির উদ্ভাবন বা সৃষ্টি করার ক্ষমতা। এটি নতুন কিছু তৈরি করার ক্ষমতা আগে যার অস্তিত্ব ছিল না। এটি যে শুধুমাত্র শিল্প বা স্হিত্যের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ তাই নয়, বরং জীবনের সকলেক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যেখানে নতুন কিছু তৈরি বা উন্নয়নের প্রয়োজন হয়।
সৃজনশীলতার সংজ্ঞা হিসাবে বলা যায় এটি মূল্যবান এবং অভিনব কোন বস্তু বা ধারণা তৈরি করা, পুরানো জিনিসকে নতুন রূপে উপস্থাপিত করার ক্ষমতা।
Advertisement
সৃজনশীলতার বৈশিষ্ট্যগুলো হল: মৌলিকতা অর্থাৎ নতুন এবং অভিনব কিছু তৈরি করা; সাবলীলতা অর্থাৎ, দ্রুত, সহজে, সচ্ছন্দে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনও ধারণা তৈরি করতে পারা; উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী হওয়া অর্থাৎ, নতুন কিছু তৈরি করার জন্য আগ্রহী হওয়া; নমনীয়তা অর্থাৎ, একাধিক ধারণা বা সমস্যার সমাধান করতে পারার ক্ষমতা এবং অভিনবত্ব অর্থাৎ চিন্তা, ধারণার নতুনত্ব; বিশদকরণ অর্থাৎ চিন্তা বা ধারণাগুলোকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা ও বিকশিত করার ক্ষমতা; আত্মবিশ্বাস: নিজের ধারণার উপর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা এবং তা প্রকাশ করার ক্ষমতা; কল্পনাশক্তি: কল্পনার প্রয়োগ ও ব্যবহারে নতুন ধারণা তৈরি করা; কৌতূহল: নতুন কিছু জানার আগ্রহ এবং সেই সম্বন্ধে মনে অগণিত প্রশ্ন জাগা; সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা: সমস্যাগুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার সাহায্যে সমাধান করা; ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা: নতুন কিছু করার ক্ষমতা এবং ব্যর্থতাকে প্রয়োজনে মেনে নেওয়ার ও ব্যর্থতার ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা। সৃজনশীলতা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে: জীবনের প্রায় সর্ব ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার প্রয়োজন। যেমন— শিল্পকলা: সঙ্গীত রচনা ছবি আঁকা, সাহিত্য রচনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: নতুন আবিষ্কার, নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, নতুন কিছু উদ্ভাবন;
শিক্ষা: নতুন পাঠক্রম ও শিক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করা;
ব্যবসা, বাণিজ্য: নতুন পণ্য তৈরি করা, বিপণন কৌশল তৈরি করা;
দৈনন্দিন জীবন: রোজকার জীবনের নানা সার সমাধানের নতুন উপায় খুঁজে বের করা; ইত্যাদি। সৃজনশীলতা একটি সহজাত প্রবৃত্তি হলেও, একে অনুশীলন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত করা সম্ভব।
সৃজনশীলতার প্রকার, প্রকৃতি ও গুণ: সৃজনশীলতাকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়, যেমন— ব্যক্তিগত সৃজনশীলতা: ব্যক্তিবিশেষের নিজের নতুন চিন্তা, ভাবনা বা ধারণা তৈরি করার ক্ষমতা; কলা বিষয়ক সৃজনশীলতা: শিল্প, সাহিত্য, ললিত কলা প্রভৃতি বিষয়ে নতুন কিছু করা; প্রযুক্তিগত সৃজনশীলতা: নতুন প্রযুক্তি তৈরি করার ক্ষমতা; সামাজিক সৃজনশীলতা: সমাজ বদলের বা সমাজের জন্য কিছু করা।
সৃজনশীলতার প্রকৃতি: সৃজনশীলতা একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের উপর নির্ভরশীল। এটি ব্যক্তি, পণ্য, পরিবেশ এবং পরিবেশের উপর নির্ভরশীল একটি বহুমূখী প্রক্রিয়া। এবং এইসবের পারস্পারিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ মিথস্ক্রিয়ার ফল। সৃজনশীলতা একটি বিকাশমান ক্রমবিকাশ প্রক্রিয়া যা সময়ের সঙ্গে ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে। ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার স্ফূরণ বা প্রকাশ অল্প বয়সেই হতে দেখা যায়, আবার অনেকের ক্ষেত্রে বয়সকালে তার প্রকাশ দেখা যায়। সৃজনশীলতা অনুশীলন, প্রচেষ্টা এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে বিকশিত হতে পারে।
সৃজনশীলতার বিভিন্ন গুণ:
ব্যক্তিগত বিকাশ: সৃজনশীলতা আত্মানুসন্ধান, নিজেকে আবিষ্কার এবং ব্যক্তিগত বিকাশে সহায়তা করে। চিন্তার প্রসার: নতুন ধ্যান, ধারণা, চিন্তা ভাবনা তৈরিতে সাহায্য করে এবং কোনও বিষয়কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী ও দৃষ্টিকোন থেকে বিচার, বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করে। উদ্ভাবন: নতুন ধারণা এবং পণ্য তৈরি করতে সহায়তা করে। সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি: সৃজনশীলতা নতুন শিল্পকর্ম, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটায় এবং সমৃদ্ধি ঘটায়।
সৃজনশীলতার বিভিন্ন রূপ: সৃজনশীলতার বিভিন্ন রূপ রয়েছে যা প্রকাশিত হয় নতুন কোনও চিন্তা, ধারণা, উদ্ভাবন বা নতুন কোনও শিল্পকলা তৈরি করার ক্ষেত্রে। এর মধ্যে বিশেষ রূপগুলি হল: জ্ঞানীয় সৃজনশীলতা, সংবেদনশীল সৃজনশীলতা, ইচ্ছাকৃত সৃজনশীলতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনশীলতা।
জ্ঞানীয় সৃজনশীলতা: এটি নতুনভাবে চিন্তা করা, নতুন ধারণা তৈরি করা, এবং সমস্যার সমাধান করার মতো ক্ষমতাকে বোঝায়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে নতুন কিছু আবিষ্কার করা, নতুন কোনও পদ্ধতি তৈরি করা অথবা বিদ্যমান কোনও জিনিষকে নতুনভাবে উপস্থাপিত করা।
সংবেদনশীল সৃজনশীলতা: এটি কোনও আবেগ, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এটি সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত এবং অন্যান্য আবেগজনিত অভিব্যক্তির উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়।
ইচ্ছাকৃত সৃজনশীলতা: এটি কোনও সৃজনশীল কাজ যা কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পাদিত করা হয়, যেখানে
কোনও ব্যক্তি সচেতনভাবে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে।
স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনশীলতা: এটি হঠাৎ করে আসা কোনও ধারণা বা অনুপ্রেরণার মাধ্যমে ঘটে থাকে। এটি কোনও পূর্বপরিকল্পনা
ছাড়াই আকস্মিক ভাবে হঠাৎ করে ঘটে থাকে।
সৃজনশীলতার এই চারটি প্রধান রূপ ছাড়াও, সৃজনশীলতাকে আর বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়, যেমন: সঙ্গীত: গান লেখা, গানে সুর দেওয়া প্রভৃতি।
চারুকলা: ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি করা, মূর্তি তৈরি করা প্রভৃতি।
সৃজনশীল লেখা: গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক ইত্যাদি লেখা।
অভিনয়: যাত্রা, নাটক বা সিনেমায় অভনয় করা, তাছাড়াও মূকাভিনয়, একক অভিনয় প্রভৃতি করা।
উদ্ভাবন: নতুন কোনও কিছু আবিষ্কার করা বা নতুন কোনও কিছু তৈরি করা।
সৃজনশীলতা কেবলমাত্র শিল্পকলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটির ব্যাপ্তি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা প্রভৃতি ছাড়াও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিদ্যমান।
সৃজনশীলতার প্রকারভেদ:
সৃজনশীলতার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে যা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। সাধারণভাবে, সৃজনশীলতাকে চারটে প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, ব্যক্তি, পণ্য, প্রক্রিয়া এবং পরিবেশ।
ব্যক্তি বা পারসন। এটি যখন সৃজনশীল ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়। সৃজনশীল ব্যক্তিরা সাধারনত কৌতূহলী, অনুসন্ধিৎসু, সাহসী, এবং সমস্যা সমাধানে গভীরভাবে আগ্রহী হন । সৃজনশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অন্তর্মুখিতা, যা তাদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণা প্রভৃতির উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে।
প্রক্রিয়া বা প্রসেস: সৃজনশীল প্রক্রিয়া বলতে বোঝায় কোন নতুন ধারণা বা পণ্য তৈরি করার পদ্ধতি বা ধাপ। এবং এর অন্তর্গত হতে পারে কোনও নতুন ধারণা তৈরি করা, পরিকল্পনা করা, সমস্যার সমাধান করা এবং উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে বের করা। সৃজনশীল প্রক্রিয়াটি প্রায়শই স্বতঃস্ফূর্ত অথবা ইচ্ছাকৃত এই দুই ভাবেই ঘটতে পারে।
পণ্য বা প্রোডাক্ট: সৃজনশীল পণ্য বলতে কোনও নতুন বা মৌলিক চিন্তা বা ধারণা, নতুন কোন কিছুর উদ্ভাবন, নতুন কোনও শিল্পকর্ম বা অন্য নতুন কোন সৃষ্টিকে বোঝায়। এটি নতুন কোন গান, ছবি, গল্প, উপন্যাস বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও হতে পারে। সৃজনশীল পণ্যগুলো অবশ্যই অভিনব, উচ্চমানের এবং মূল্যবান হতে হবে।
পরিবেশ বা প্রেস বা পেরিফেরি: সৃজনশীল পরিবেশ বলতে বোঝায় কোন স্থান বা পরিস্থিতি যা সৃজনশীলতাকে বা সৃজনশীল কোনও উদ্যমকে উৎসাহিত করে বা প্রেণা যোগায়। এটি কোনও সৃজনশীল কর্মক্ষেত্র, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কোনও পরিবারও হতে পারে। একটি সহায়ক বা অণুকুল পরিবেশ সৃজনশীলতার বিকাশ বিস্তারে সাহায্য করে।
সৃজনশীলতাকে উপরিউক্তভাবে প্রকারভেদ করা ছাড়াও ইচ্ছাকৃত এবং স্বতঃস্ফূর্ত, তাছাড়া জ্ঞানীয় এবং আবেগগত এবং ডোমেইন-নির্দিষ্ট এবং ডোমেইন-নিরপেক্ষ এই চারটি উপাদানের সংমিশ্রণ হিসাবেও ভাগ করা যায়।
ইচ্ছাকৃত বনাম স্বতঃস্ফূর্ত:
ইচ্ছাকৃত সৃজনশীলতা: এটি একটি সচেতন এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রক্রিয়া, যেখানে কোন ব্যক্তি তার ইচ্ছামত কোনও নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করে।
স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনশীলতা: এটি একটি অচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, যেখানে নতুন কোন ধারণা বা সমস্যার সমাধান আপনা থেকেই হঠাৎ করে মনে আসে।
জ্ঞানীয় বনাম আবেগগত:
জ্ঞানীয়: এই ধরনের সৃজনশীলতা নতুন কোনও সমস্যা সমাধানের জন্য বা নতুন কোনও চিন্তা ভাবনা বা ধ্যান ধারণার জন্য স্রষ্টার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যবহার করে।
আবেগগত: এই ধরনের সৃজনশীলতা স্রষ্টার আবেগ, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়। ডোমেইন-নির্দিষ্ট বনাম ডোমেইন-নিরপেক্ষ:
ডোমেইন-নির্দিষ্ট: এই ধরনের সৃজনশীলতা একটি নির্দিষ্ট ডোমেইন বা ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যেমন সঙ্গীত, কলা, সাহিত্য বা বিজ্ঞান।
ডোমেইন-নিরপেক্ষ: এই ধরনের সৃজনশীলতার ব্যাপ্তি এবং বিস্তার এবং প্রসার অনেক এবং যে কোনও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।
সৃজনশীলতার লক্ষণ:
সৃজনশীল ব্যক্তিদের মধ্যে সৃজনশীলতার কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যেমন: নতুনত্ব অর্থাৎ নতুন
ধারণা তৈরি করা: সৃজনশীল ব্যক্তিরা নতুন এবং মৌলিক চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হন। তারা গতানুগতিকতার গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে এসে নতুন আলো, নতুন দিশা দেখান এবং নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করেন। সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা: সমস্যা সমাধানের জন্য সৃজনশীল ব্যক্তিরা নতুন কোন উপায় উদ্ভাবন করেন বা নতুন কোন কার্যকরী উপায় খুঁজে বার করেন। তারা প্রচলিত ধ্যান ধারণা পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন উপায়ে, নতুন কোনও উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার বা পদ্ধতির সাহায্যে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন।
অভিনবত্ব: অন্যদের থেকে পৃথক এবং নতুন ভাবে চিন্তা করা এবং সমস্যাগুলো নতুন দৃষ্টিকোন থেকে দেখে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে সমাধান করার চেষ্টা ।
নতুন জিনিসে প্রবল আগ্রহ এবং নূতনত্বে নির্ভয়তা: নতুন জিনিস করতে প্রবল আগ্রহ এবং নতুন জিনিস করতে ভয় না পাওয়।
কাজের প্রতি আবেগ: সৃজনশীল ব্যক্তিরা তাদের কাজের প্রতি গভীর আবেগ এবং আগ্রহ দেখান। তারা প্রবল উৎসাহের সঙ্গে নতুন কাজে আগ্রহী হন এবং প্রবল উৎসাহের সঙ্গে তারা তাদের কাজ সম্পন্ন করেন।
উচ্চ শক্তি: সৃজনশীল ব্যক্তিরা তাদের কাজে উচ্চ শক্তির অধিকারী হন। তারা তাদের আবেগ, আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতাকে তাদের কাজের দিকে চালিত করেন এবং কাজটি সুসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তার পিছনে লেগে থাকেন।
নান্দনিকতা: সৃজনশীল ব্যক্তিরা তাদের কাজের নান্দনিক মান সম্বন্ধে খুবই সচেষ্ট থাকেন এবং ভীষণভাবে সেই মান বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করেন। এবং তারা তাদের কাজের এই নান্দনিক মানের সঙ্গে কোনও রকম আপোস বা সমঝোতা করেন না। এর ফলে তাদের তৈরি জিনিস সবসময় আকর্ষনীয় এবং অভিনব হয়। স্বজ্ঞা বা ইনট্যুইশন: সৃজনশীল ব্যক্তিদের স্বজ্ঞা বা বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি থাকে এবং তারা তাদের কাজে এই অন্তর্দৃষ্টিকে প্রয়োগ করেন এবং এর উপর তাদের কাজ নির্ভর করে।
উন্মুক্ততা: সৃজনশীল ব্যক্তিরা মুক্ত মনের এবং মুক্ত চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণার অধিকারী হন। তাদের মন সব সময় নতুনকে গ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে এবং তারা সহজেই নতুনকে বরণ করে নেন। তাদের মন সব সময় উদার এবং খোলামেলা থাকে এবং তারা সব সময় নতুন কিছু করার চেষ্টা করে থাকেন।
অধ্যবসায়: সৃজনশীল ব্যক্তির তাদের কাজের প্রতি খুব নিষ্ঠাবান এবং অধ্যবসায়ী হন। এবং কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা কাজের পিছনে লেগে থাকেন।
সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি সাতটি ‘সি’র উপর ভিত্তি করে বা উপাদানের উপর ভিত্তি করে গঠিত। ক্রিয়েটরস (ক্যারাক্টারিস্টিকস অব ক্রিয়েটিভ পিপুল, সৃজনশীল ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য): ক্রিয়েটিং (দ্য প্রসেস অব ক্রিয়েটিং, সৃষ্টির প্রক্রিয়া); কোলাবোরেশনস (ক্রিয়েটিভিটি ইন গ্রুপ্স, টিমস, অরগানাইজেশনস, দল, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানে সৃজনশীলতা); কনটেক্সট (সৃজনশীলতার পরিবেশ; দ্য এনভায়রনমেন্ট অব ক্রিয়েটিভিটি); ক্রিয়েশনস (দ্য নেচার অব ক্রিয়েটিভ প্রোডাকশনস, সৃষ্টি করা জিনিসের প্রকৃতি); কঞ্জাম্পশনস (দ্য আপ্টেক অব ক্রিয়েটিভ প্রোডাকশনস, আডপশন অব ক্রিয়েটিভ আইডিয়াজ বাই দ্য পাব্লিক, সৃষ্টি করা জিনিসের জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা); ক্যারিক্যুলা (দ্য ডেভেল্যাপমেন্ট এন্ড টিচিং অব ক্রিয়েটিভিটি, সৃজনশীলতার সিক্ষা এবং উন্নয়ন)। এই সাতটি ‘সি’ এর সমন্বয়ে সৃজনশীলতার বিকাশ এবং পরিপূর্ণতা।
সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য:
বাংলায় আবিষ্কার শব্দের দুটি ইংরাজি মানে আছে: ইনভেনশন ও ডিসকভারি; আবার বাংলায় ক্রিয়েটিভিটির দুটি বাংলা মানে আছে, যথা সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা। এই দুটি শব্দের মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য আছে। সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা যদিও দুটি ভিন্ন ধারণা, তবুও তাদের মধ্যে কিছু মিল আছে আবার পার্থক্যও আছে। সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি বলতে বোঝায়: ১. নতুন চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণা, সমস্যার সমাধান, নতুন কোনও উদ্ভাবন বা নতুন কিছু তৈরি করার ক্ষমতা; ২. এটি একটি মানসিক প্রক্রিয়া যা মননশীলতা, কল্পনা এবং নতুন কোন কিছু তৈরি করার ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, ৩. একটি ধারণাগত প্রক্রিয়া যার সাহায্যে এবং মাধ্যমে নতুন কিছু তৈরি করার সম্ভাবনা গড়ে ওঠে, ৪. নতুন ধারণা, উদ্ভাবন বা সমাধানের ক্ষমতা।
সৃষ্টিশীলতা বা ক্রিয়েশন বলতে বোঝায়: ১. সেই ধারণার বাস্তব রূপ দেওয়া বা সেই ধারণার উপর নির্ভর করে বা ভিত্তি করে নতুন কিছু করা, ২. সৃজনশীল ধারণার ফলস্বরূপ কোনও বস্তু, কাজ বা পদ্ধতির উদ্ভাবন, ৩. নতুন কিছু তৈরি করার প্রক্রিয়া যার মূলে বা ভিত্তি হল সৃজনশীলতা, ৪. সৃজনশীল চিন্তা, ধারণা বা ভাবনার বাস্তব রূপ।
সাদৃশ্য: ১. সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা উভয়ই নতুন কিছু তৈরি করার চিন্তা, ভাবা বা ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। ২. উভয় প্রক্রিয়াতেই কল্পনা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা, ভাবনা জড়িত। ৩. সৃজনশীলতা ছাড়া সৃষ্টিশীলতা সম্ভব নয় আবার বিপরীতটাও সত্যি এবং সৃষ্টিশীলতা ছাড়া সৃজনশীলতা অসম্পূর্ণ।
পার্থক্য: ১. সৃজনশীলতা একটি মানসিক প্রক্রিয়া আর সৃষ্টিশীলতা হল সেই প্রক্রিয়ার বাস্তব রূপ, ২. সৃজনশীলতা নতুন ধারণা তৈরি করে আর সৃষ্টিশীলতা সেই ধারণার উপর নির্ভর বা ভিত্তি করে নতুন কিছু তৈরি করে, ৩. সৃজনশীলতা একটি ধারণাগত প্রক্রিয়া আর সৃষ্টিশীলতা একটি কর্ম প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, একটি নতুন গান লেখার ধারণা বা ছবি আঁকার কল্পনা হল সৃজনশীলতা আর সেই গানটি গেয়ে বা বাড়িয়ে অথবা ছবিটি এঁকে উপস্থাপিত করা বা পরিবেশন করা হল সৃষ্টিশীলতা।
সৃজনশীলতার পর্যায় মডেল বা ফেজ মডেল:
অনেক মনোবিজ্ঞানী সৃজনশীলতাকে বিভিন্ন পর্যায় বা ফেজ-এর সমন্বয়ে গঠিত বা সম্পূর্ণ একটি প্রক্রিয়া যা সমস্যা সমাধানের দিকে নেওয়া পদক্ষেপের একটি প্রক্রিয়া বা সৃজনশীলভাবে নতুন পণ্য উদ্ভাবন হিসাবে দেখেন।
আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী মার্ক রানকোর মতে সৃজনশীল প্রক্রিয়া ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় বা ফেজ নিয়ে গঠিত। প্রথম পর্যায়ে, ‘অভিমুখীকরণ’ (তীব্র আগ্রহ বা কৌতূহলের সময়), সৃজনশীল ব্যক্তি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, ‘ইনকিউবেশন’ তা দেওয়া বা অনুকূলতা তৈরির প্রক্রিয়া, সমস্যাটির সংজ্ঞা নিরূপণ করে বা সমস্যাটি সংজ্ঞায়িত করে, সমাধান অনুসন্ধান করে এবং প্রচুর পরিমাণে তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রক্রিয়াকরণ করে; এটি সচেতন বা অচেতন স্তরে ঘটতে পারে। ‘আলোকসজ্জা’ বা ইলিউমিনেসন, এটি তৃতীয় পর্যায়, ভিন্ন চিন্তাভাবনা, মুক্ত মনে উন্মুক্ততা এবং উত্তেজনা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। চতুর্থ পর্যায়ে, ‘যাচাইকরণ’, ডিটারমিনেশন বা এসটিমেশন বা ইভালুয়েশন, ব্যক্তি তার নিজের কাজের মূল্যায়ন করে এবং বিষয়ের বা উৎপাদিত জিনিসের সঙ্গে ক্ষেত্রের পরিচিত বিষয়গুলির সঙ্গে তুলনা করে। এরপর, পঞ্চম পর্যায়ে, অর্থাৎ ‘যোগাযোগ’ পর্যায়ে, ব্যক্তি তাঁর কাজ ক্ষেত্রে জমা দেয়, এটি বিশেষজ্ঞদের সমীপে পেশ করে, তাদের কাছে উপলব্ধ করে যারা এর গুণমান এবং উপযোগিতা বিচার করবে। ষষ্ঠ পর্যায়ে, ‘বৈধকরণ’ ঘটে, যেখানে কাজটি সমাজের সামনে উপস্থাপিত বা উপলব্ধ করা হয় এবং গুণমান অনুযায়ী ফলস্বরূপ সমর্থিত, সাদরে গৃহীত হয় বা প্রত্যাখ্যাত হয়।
মস্তিষ্কে সৃজনশীলতার উৎস: আমাদের মস্তিষ্ক সৃজনশীলতার আঁতুড়ঘর। মস্তিষ্কের স্নায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন অংশর (নিউরাল রিজিয়নস অব দ্য ব্রেন) পারস্পরিক মিলিত প্রচেষ্টার (মিথস্ক্রিয়া) ফলে আমাদের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করছি তখন আমাদের মনে হঠাৎ, করে দুরূহ কোন সমস্যার সমাধান উদয় হয়। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা মানবতার শ্রেষ্ঠ গুণ ও উৎকর্ষের বৈশিষ্ট্য সূচক। কিন্তু সৃজনশীলতা ক্ষণস্থায়ী, প্রহেলিকার মতো দুর্বোদ্ধ একটি ক্ষমতা যা হঠাৎ করে উদয় হয় যখন সেটা একেবারেই আশা করা যায়নি। সৃজনশীলতা আকস্মিকভাবে আবির্ভূত একটি আশ্চর্য এবং বলতে গেলে অলৌকিক একটি ঘটনা। যা বিস্ময়াভিভূত ও আশ্চর্যান্বিত করে সকলকেই। এবং এর পিছনে সৃজনশীলতার যে স্নায়বিক উৎস যা আমাদের মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয় তাও একইরকমের বিস্ময়কর এবং আশ্চর্য ঘটনা।
সম্প্রতি ইউনিভর্সিটি অব উটা হেলথ রিসার্চ এবং বেয়লর কলেজ অব মেডিসিন-এর গবেষকরা যৌথভাবে মস্তিষ্কের প্রতিচ্ছবি তোলার এক নিপুণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে আবিষ্কার করেছেন কিভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ মিলিতভাবে কাজ করে যৌথভাবে সৃজনশীলতার উদ্ভাবন করে। তাদের এই আবিষ্কারের কথা জুন মাসের ১৮ তারিখ ২০২৪ বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘ব্রেন’-এ প্রকাশিত হয়।
সৃজনশীলতা মস্তিষ্কের কোনও একটি বিশেষ অংশ বা অবস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ বা নির্ভরশীল নয়। মোটর ফাংশন (শরীরের চলাফেরার জন্য বা সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা) বা দৃষ্টিশক্তির ক্ষমতার মতো মস্তিষ্কের সৃজনশীলতার কোনও নির্দিষ্ট অংশ বা অবস্থান নেই, বিজ্ঞানের ভাষায়, ‘দেয়ার ইজ নট অ্যা ক্রিয়েটিভিটি কর্টেক্স’। কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে যে সৃজনশীলতা মস্তিষ্কের একটি ক্রিয়াকলাপ। মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোনও অংশ আঘাতের ফলে সৃজনশীলতার সামর্থ্য বা ক্ষমতার পরিবর্তন-হ্রাস বা বৃদ্ধি, ঘটে। দেখা গিয়েছে সৃজনশীল চিন্তা মস্তিষ্কের সেইসব অংশের উপর ভীষণভাবে নির্ভর করে যে সব অংশ ধ্যান, দিবাস্বপ্ন অথবা অন্য কোনও অন্তর্মুখী চিন্তাভাবনার সঙ্গে জড়িত। মস্তিষ্কের কোষেদের এই কর্মজালটির (নেট ওয়ার্ক) নাম ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক (ডিএমএন) এই কারণে বলা হয় যেহেতু এই অংশটি চিন্তাভাবনার ‘ডিফল্ট’ ধরন বা বিন্যাসের সঙ্গে জড়িত এবং এটি ঘটে মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট কোনও ক্রিয়াকর্মের যখন অভাব ঘটে। মস্তিষ্কে অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের মতো এর নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য নেই। বিজ্ঞানীদের মতে এই ক্রিয়াকর্মটি মস্তিষ্কে অবিরাম কার্যকরী থাকে এবং আমাদের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখে। ডিএমএন কর্মজালটি মস্তিষ্কের ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে থাকা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিস্তৃত আছে। গবেষকরা মস্তিষ্কের ছবি তোলার একটি অত্যুন্নত প্রক্রিয়ার সাহায্যে নির্ণয় করার চেষ্টা করেন যে সৃজনশীল চিন্তার প্রতিটি মুহূর্তের এই কর্মজালটির ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া। মারাত্মক মৃগী রোগে (সিভিয়ার এপিলেপ্সি) আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রোডস ঢুকিয়ে বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্টভাবে পরীক্ষা করেন মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের তড়িৎ সক্রিয়তা।
গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে যখন গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের দৈনন্দিন জীবনের কোন কিছু নিয়ে, যেমন, চায়ের কাপ বা বসার চেয়ার প্রভৃতি তাদের ব্যবহার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলতে বলা হয় তখন তাদের ডিএমএন প্রথমে সক্রিয়তার সঙ্গে আলোকিত হয়ে ওঠে। তারপর সেই সক্রিয়তা মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সমলয় (সিঙ্কোনাইজড) হয়ে যায়। এবং সেই অংশগুলোর মধ্যে আছে সমস্যা-সমাধানের এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মস্তিষ্কের অংশগুলোও। সুতরাং বিজ্ঞানীদের মতে সৃজনশীল ধারণার উদ্ভব জিএমএন-এর মধ্যে এবং পরে তার মূল্যায়ন করা হয় মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের দ্বারা।
গবেষকদের মতে সৃজনশীলতা শুধুমাত্র মস্তিষ্কের এই অংশের সঙ্গে জড়িত নয় বরং মৌলিকভাবে এই অংশের উপর নির্ভরশীল।
সৃজনশীলতার স্নায়ুমণ্ডল (নিউরাল রিজিয়নস অব ক্রিয়েটিভিটি):
‘সৃজনশীলতার স্নায়ুমণ্ডল’ বলতে মস্তিষ্কের সেইসব অংশগুলোকে বোঝায় যারা সৃজনশীলতা বা উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার সঙ্গে জড়িত। এটি একক কোনও অংশ নয়,, বরং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে একটি জটিল কর্মজাল যা একসঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করে।
মস্তিষ্কের সৃজনশীলতার স্নায়বিক কর্মজাল (নিউরাল নেটওয়ার্ক অব ক্রিয়েটিভিটি), মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জটিল ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়ার ফল। মস্তিষ্কের এই অংশগুলো হল ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক (ডিএমএন), এক্সিকিউটিভ কন্ট্রোল নেটওয়ার্ক এবং স্যালিএন্স নেটওয়ার্ক। এই কর্মজালগুলো একত্রে কাজ করার ফলে বিভিন্ন নতুন চিন্তাভাবনার উদয় হয় এবং তাদের মূল্যায়ন হয় এবং অবশেষে সৃজনশীল জিনিসের উৎপাদন হয়।
১. ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক (ডিএমএন): এই কর্মজালটি সক্রিয় থাকে মস্তিষ্ক যখন বিশ্রামে থাকে এবং বিভিন্ন স্বতস্ফূর্ত চিন্তাভাবনা এবং স্মৃতিচারণা করা হয় এবং তার ফলে উপযোগী প্রেরণার উদয় হয়।
২. এক্সিকিউটিভ কন্ট্রোল নেটওয়ার্ক: এই কর্মজালটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি মনোযোগ, লক্ষ্যনীয় এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ চিন্তাভাবনা এবং ডিএমএন-এর দ্বারা উৎপাদিত সৃজনশীল চিন্তাভাবনার মূল্যায়ন প্রভৃতি কাজে অংশগ্রহণ করে।
৩. স্যালিয়েন্স নেটওয়ার্ক: এই কর্মজালটি ডিএমএন এবং এক্সিকিউটিভ কন্ট্রোল নেটওয়ার্কের মধ্যে সেতুর মতো কাজ করে, এবং চমকপ্রদ এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলোকে চিহ্নিতকরণ এবং অগ্রাধিকার হিসাবে মূল্যায়ন করা এবং আরও প্রক্রিয়াকরণ (ফারদার প্রসেসিং) প্রভৃিতি কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
৪. ডোপামিন: এটি স্নায়ু সংবাদ পরিবাহক (নিউরোট্রান্সমিটার, যার সাহায্যে মস্তিষ্ক বিভিন্ন স্নায়ুর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে সংবাদ আদান প্রদান করে, কোন কাজে পুরস্কৃতকরণ প্রভৃতি কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। এবং এটি সৃজনশীলতার কাজে অংশ গ্রহণ করে এবং অভিনব চিন্তাভাবনার অন্বেষণ বা অনুসন্ধান করে তাদের অনুপ্রাণিত করে। এবং এইভাবে সৃজনশীলতাকে সহায়তা করে এবং উদ্বুদ্ধ করে।
৫. প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স: মস্তিস্কের এই অংশটি, বিশেষ করে ভেন্ট্রোমেডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশটি আবেগ নিয়ন্ত্রণের কাজে এবং নিজেকে প্রতিফলনের কাজে অংশগ্রহণ করে। এই দুটি প্রক্রিয়া উভয়ই সৃজনশীল প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়।
৬. নিউরোপ্লাস্টিসিটি: কোনও নতুন অভিজ্ঞতা বা শিক্ষণের ফলে মস্তিষ্কে যে নতুন স্নায়ুকোষ উৎপন্ন হয় তাদের চিহ্নিত করা বা স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মস্তিষ্কের সেই ক্ষমতা সৃজনশীলতার পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয় এবং জরুরী।
মোটকথা, মস্তিষ্কের এইসব অংশের মধ্যে চলমান বা গতিশীল পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃজনশীলতার উদ্ভব, বিকাশ এবং প্রকাশ এবং তার ফলে নতুন চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, তাদের মূল্যায়ন এবং পরিশেষে নতুন জিনিসের বা পণ্যের বা আবিষ্কারের উদ্ভাবন সম্ভব হয়।
Advertisement



