মহম্মদ শাহাবুদ্দিন
দেশ ভাগের মধ্যে দিয়ে এসেছিল আমাদের স্বাধীনতা। হাজার বছর ধরে একই জাতীয়তায় লালিত, একই ভাষা, একই সংস্কৃতির মাঝখানে বাঁধা হয়েছিল বিভাজনের কাঁটাতার। উপমহাদেশের ইতিহাসে এ এক মর্মান্তিক অধ্যায়। আমাজেদর মধ্যে ছিল একই আলাপন, হৃদয়ের একই গভীর গুঞ্জন। একই নদীর জল, একই বাতাসে আমাদের বেড়ে ওঠা। এই বিভাজন আকাশ থেকে পড়েনি। এই কাজ সম্পন্ন করেছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ আর আমাদের কিছু রাজনীতিবিদগণ। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের উপমহাদেশের সীমান্তরেখার আড়ালে পুঞ্জীভূত হয়েছিল এক বেদনার ইতিহাস। দেশ ভাগের আলাদা কোনও ভাষা নেই। বিভাজিত দু দেশের সাহিত্যেই আছে এই বিভাজনের বেদনা। আর আছে আমাদের বদলে যাওয়া জীবনের পরিচয়। এ সাহিত্যে শুধু সাতপুরুষের ভিটে ছাড়া মানুষের জীবনের দলিল নয়, এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে অর্ধশতাব্দীর বেশী সময় ধরে মানুষের স্মৃতি ও সংগ্রামের আখ্যান। যেখানে খুঁজে পেয়েছি অসহায় মানুষের পথ চলার শেষে নতুন করে সমাজপত্তনের লড়াই।
Advertisement
দেশ ছাড়া মানুষের স্রোত ছিল এক উত্তাল উদ্বাস্তু প্রবাহ। প্রাক্তন একজন ইংরেজ বিচারক স্যার সেরিল র্যাডক্লিফ, তাকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বিভাজনের ভৌগলিক সীমারেখা টানার। এ দেশের মানুষের আনন্দ বেদনার আবেগ মাখানো জন্মভিটের বাউন্ডারী রেখা তার হাতেই টানা হল। স্বাধীনতার পর দেশ বিভাজন, সমাজ মানসে প্রভাব ফেলেছিল। এর প্রভাব পড়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের সাহিত্যেও। বিভাজন রেখা টানা হয়েছিল উত্তর পশ্চিম ভারত ও বাংলা প্রদেশে। বাংলা অন্যদিকে উত্তর পশ্চিমের পাঞ্জাবী, উর্দ্দু, হিন্দি, সিন্ধী ভাষাতে দেশভাগের কাহিনি বেশি লেখা হয়েছে। বেশির ভাগ গল্প উপন্যসের বিষয় শহর গ্রামের দাঙ্গা, আতঙ্ক, শরণার্থী সংকটের ভয়াবহতা নিয়ে। এই সব সাহিত্যে পেয়েছি মানুষের অস্তিত্বের সংকট, মানবিক অধিকারের লাঞ্ছনা—আবার পেয়েছি সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরে যা আজও থামেনি।
Advertisement
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঊর্দু লেখক সাদাত হোসেন মন্টো নাগরিক ছিলেন পাকিস্তানের। বিভাজন পরবর্তীকালের হিংসা, সংকটে ভরা মানবজীবন ও অনিশ্চয়তাকে উপজীব্য করেছিলেন তার সাহিত্যে। একই ভূখণ্ডের মানচিত্রকে শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। ‘ঠান্ডা গোশত’, ‘টোবাটেক, সিং’, ‘খোল দো’ প্রভৃতি রচনায় বিভাজনের আঘাত কিভাবে সমাজে গভীর দাগ কেটেছিল, এ সাহিত্য তার প্রমাণ দেয়। সাদাত হোসেন মন্টো, কৃষণ চন্দর খাজা আহমেদ আব্বাস, ভীষ্ম সাহানীর মতো বলিষ্ঠ লেখকরা দেশভাগের বিপর্যয়ের ঘটনাকে নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে রূপ দিয়েছিলেন। ভীষ্ম সাহানীর ‘তমস’ উপন্যাসে ১৯৪৬-৪৭ এর হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার রক্তাক্ত প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে। উপন্যাসের মধ্যে দেখা যায় দেশ ভাগকে কেন্দ্র করে একটা হিংস্রতা সমাজের মধ্যে ছেয়ে আছে। আজানের সুর আর স্তোত্র দ্বন্দ্ব বাধিয়ে চলেছে মানুষের মধ্যে। মানবতার সব মূল্য শেষ করে মানুষের মধ্যে আছড়ে পড়ছে দাঙ্গা। ভীষ্ম সাহানী তমস উপন্যাসে যেন মানবাত্মার ক্রন্দনকেই শব্দে বেঁধেছেন। ধর্মবেদ্বেষের যে রক্তাক্ত দাঙ্গা দেশের প্রান্তে প্রান্তে আগুন জ্বালিয়েছিল তারই চেহারা ফুটেছে কষণচেন্দর ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ গল্পে। ট্রেনের জবানীতে লেখা এ কাহিনিতে ধর্মের ঊর্দ্ধে মানুষের ঐক্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে। যে ঐক্যকে লেখক স্থাপন করেছেন শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দিয়ে। খুশবন্দ সিং দাঙ্গার বিভৎসতা তুলে ধরতে যাত্রীবাহী ট্রেনকে শববাহী ট্রেনে রূপান্তরিত হতে দেখিয়েছেন। দেশ বিভাজন, সমাজে যে নৈরাজ্যের চেহারা, জীবনের হাহাকার ও পারস্পরিক আবিশ্বাস তৈরি করেছিলেন তারই প্রমাণ পাওয়া যায় মহিন্দর সারনার ছোটগল্পে।
মানুষের ছিন্নমূল হওয়ার প্রতিফলন পড়ল দুপার বাংলার সাহিত্যে। দেশভাগ, সময়ের বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খেঁাজে, মানুষের ঘরবাড়ি উপন্যাসে দেশ বিভাজনের প্রস্তুতি, দাঙ্গার বৃত্তান্ত ও সামাজিক বিপর্যয় বিধৃত হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাস দেশভাগের গভীর অনুভূতির বাহক। উপন্যাসে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালের সামাজিক ইতিহাস, দূর্বিষহ শরণার্থী জীবন এবং নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন। সত্তরের দশকে লেখা ‘অর্জুন’ উপন্যস শরণার্থী অধিকার নিয়ে নতুন প্রজন্মের প্রামাণ্য দলিল। দেশভাগের বেদনাময় কাহিনি হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’।
এক নারীর আপন বাস্তুভিটের প্রতি মমত্ববোধের কাহিনি এই উপন্যাস। শ্বশুরবাড়ির গ্রাম, আত্মীয় পরিজন ঘেরা পাড়া, তার দেশ কিভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তারই হৃদয়স্পর্শী আখ্যান আগুনপাখী। সেলিনা হোসেনের যাপিত জীবন ও তিন খণ্ডের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে দেশ বিভাজনের প্রত্যক্ষ অভিঘাতের ছায়া পড়েছে। গায়ত্রী সন্ধ্যা সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি ছিন্নমূল পরিবারের আখ্যান। জ্যোর্তিময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে লেখা। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে দেশভাগের দাঙ্গায় নারীদের সঙ্কট। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য, জীবন উপলব্ধির সততা ও গ্রাম মানুষের জীবন চেতনায় সমৃদ্ধ। ঔপনিবেশিক বাংলার পটভূমিতে রচিত তার ‘খোয়াবনামা’ ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। লেখনীতে লৌকিক জীবনাচরণ, লোকবিশ্বাস ও জনবিদ্রোহের পটভূমিতে ধরা দিয়েছে বাংলার আবহমান জীবন। আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ ৪৭ এর দেশভাগ, গ্রাম বাংলার দূর্ভিক্ষ ও মানুষের ভেঙে পড়া আশাস্বপ্নের আলেখ্য। সেই সঙ্গে নারীর জীবন সংগ্রাম ও প্রতিবাদী চেতনা উপন্যাসটিকে একটা অন্যমাত্রা দিয়েছে। সর্দার জয়েনউদ্দীনের ‘অনক সূর্যের আলো’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পটভূমিতে লেখা উপন্যাস। দেশ বিভাগের আঘাতে মানুষের স্বপ্ন আবেগের বিচ্যুতিকে তিনি ব্যাক্ত করেছেন আন্তরিক বেদনায়।
এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলিয়ে যে শরণার্থী স্রোতধারা তার পরিণাম হয়েছে সুদূর প্রসারী। পিতা পিতামহের বাস্তুভিটা ছেড়ে লাখো মানুষ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে হাঁটা শুরু করেছিল। নতুন করে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে এসেছিলেন তাঁরা। এ ঘটনা কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয় বিশ্বের ইতিহাসে বোধ হয় এটা সর্ববৃহৎ অভিগমন। জীবনের অনিশ্চয়তা আর যন্ত্রণা নিয়ে এ শুধু এক দীর্ঘ পদযাত্রা ছিল না কেবল শরণার্থী সমস্যা ছিল না, এই ঘটনা ঐতিহাসিক বিতর্কের সঙ্গে তৈরি করেছিল এক আর্থ সামাজিক ঐতিহাসিক সমস্যা৷ এপার বাংলায় যাঁদের পদযাত্রা থেমেছিল, অনেক দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে এ ছিল জীবনের জন্য নতুন করে যাত্রা। যে যাত্রা পথে মিশেছিল স্বদেশ ও সম্মান হারানোর কান্না। যার প্রভাব পড়েছে এপার বাংলার সাহিত্যে।
অসীম রায়ের ‘দেশদ্রোহী’ ও কৃষ্ণ চক্রবর্তীর ‘সীমান্ত পেরিয়ে’ উপন্যাস দুটিতে পূর্ববঙ্গের বাস্তুচ্যুত মানুষের কথাই প্রধান হয়ে উঠেছে। ‘সীমান্ত পেরিয়ে’ উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন কাঁটা তারের সীমানা মানুষের কাছে এক দুঃস্বপ্ন। তিনি দেখিয়েছেন চিরকালের মতো জন্মভূমি ছেড়ে আসা মানুষগুলি যেন চলেছে অপরাধীর মতো। অসহায় দৃষ্টিতে ট্রেনের জানলা দিয়ে তারা খুঁজছে ক্রমশ পিছনে চলে যাওয়া জন্মভূমির মাটির গন্ধ, নদীর প্রান্তরেখা। এ যেন সব হারানোর অভিবাসন। নারায়ণ সান্যালের ‘বকুলতলা পি এল ক্যাম্প’, সমরেশ বসুর সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা, শক্তিপদ রাজগুরুর মেঘে ঢাকা তারা উপন্যাস ভাগ হয়ে যাওয়া মানুষের হৃদয় ভেঙে যাওয়ার উপাখ্যান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শান্তিলতা’ জীবন সংগ্রামের কাহিনি। শান্তিলতা পূর্ববাংলা থেকে কলকাতায় চলে আসা এক শিক্ষক মানুষের জীবিকা খোঁজার কাহিনি। মেয়ে শান্তিলতাকে নিয়ে শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশে ঠাঁই খুঁজে পান তিনি। যেখানে প্রতিদিনের লড়াইয়ের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, সেখানে বিপর্যস্ত মানুষগুলি মুক্তির স্বাদ পেতে বার বার মরিয়া হয়ে উঠেছে।
দেশভাগ তো শুধু সিরিল র্যাডক্লিফের এঁকে দেওয়া ভৌগলিক সীমারেখা নয়, এ রেখা মনেরও এক দীর্ণ বিভাজন। দেশ ভাগের একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকে। তার ধারাবাহিক ইতিহাসও খুঁজে পাওয়া যাবে। সেখানে লুকিয়ে থাকে প্রকৃত বাস্তব। এদেশে ধর্মরেখার ভিত্তিতে টানা হয়েছে ভৌগলিক কাঁটাতার। দেশভাগ না হিন্দু চেয়েছে, না মুসলমান চেয়েছে, চেয়েছে শুধু রাজনীতির ফেরিওয়ালারা। দেশভাগে শোনা গেছে জীবনের হাহাকার, ফেলে আসা ভিটেমাটির জন্য মানুষের কান্না। কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় আমরা শুনেছি— ‘তুমি মাটি? কিংবা তুমি আমারই স্মৃতির/ ধূপে ধূপে/ কেবল ছড়াও মৃদুগন্ধ আর কিছু নও?/ রেখায় রেখায় লুপ্ত মানচিত্র খণ্ডে/ চুপি চুপি-/ তোমার সত্তাই শুধু অতীতের উদ্দাম উধাও/ বাল্য সহচর।/ তুমি মাটি নও দেশ নও।/ তুমি।/
দেশ হারাবার বেদনা মাপা যায় না। পৃথিবীর আকাশের তলায় তারা মর্যাদার জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছে বার বার। দাবি করেছে মানবাধিকারের। প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান, ইরান, বাংলাদেশ সিরিয়া, মায়ানমার, সুদান সব দেশের শরণার্থীর ইতিহাস একই। দেশ ছাড়ার যন্ত্রণা মানুষ ভুলতে পারে না। নিজ দেশের সঙ্গে সম্পর্কের এই শিকড় উপড়ে ফেলা যায় না, তা থেকে যায় সমাজ, সংস্কৃতি আর ভাষার গভীরে। এই সম্পর্ক থেকেই সাহিত্যের পাতায় জায়গা করে নেয় ছিন্নমূল শরণার্থী মানুষের কথা। যে কথা টুকরো হয়ে যাওয়া স্বদেশ ভূমিরই ইতিহাস।
Advertisement



