ময়ূরী মিত্র
উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া আমার বাল্যস্থান বা খেলুভূমি৷ জন্ম দিল্লিতে হলেও বালক থেকে কৈশোর কাটিয়েছি বেলগাছিয়ায়৷ একতলার তিন ঘরের একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে আমরা থাকতাম৷ সে বাড়িতে লম্বা প্যাসেজ ছিল, কলতলা ছিল, গুলকয়লা রাখার বাঁধানো জায়গা ছিল৷ বারান্দা ছিল না৷ তবে বারান্দার অভাব পূরণ করত পাম্প৷ মেশিনঘর৷ অনেকটা অংশ নিয়ে এই মেশিনঘর৷ পাশে খোলা চাতাল, আবার একটা কলতলা এবং মেশিনঘরের ছাদ৷ সে ছাদ থেকে আবার একটা সামান্য উঁচু ছাদ … সামান্য উঁচু থেকে আরো একটু উঁচু অংশ এবং অবশেষে সীমানা জুড়ে কয়েকটি সুপুরি গাছ৷ আমার খোকাচোখের সর্বাধিক উচ্চতায় রোদ খেত গাছগুলো৷ গাছের রোদ আসত বাবা মায়ের শোবার বিছানায়৷ কার্তিক পড়লেই গা ভর্তি নিভিয়া মেখে বিছানায় বসে রোদ মাখতাম৷ হাঁ করে দেখতাম মেশিনঘরের ছাদ ও তার বিভিন্ন আনাচ৷ সে ছিল শিশুমনের অগাধ রহস্যের কেন্দ্রস্থল৷ এদিক লুকোতাম ও ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বাথরুমের ছাদে উঠে যাওয়া! হিজিবিজি টপকে যাওয়া শুধু৷ কালীপুজো আসলে তারাবাজি, রংমশাল আর সাপবাজি বিছিয়ে রাখতাম মেশিনঘরের ছাদে৷ রোদ খেয়ে কালীর রাতে তারাফুল অজস্র হয়ে ঝরবে—রঙমশালের রঙ গোলাপফুল হয়ে যাবে ….আর সাপবড়িতে দেশলাই ঠুকলে নাগগুষ্টি হিস হিস করে বেরোতে লাগবে! এইরকম সব আশা জমত ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরে৷
তিনতলায় আগরওয়ালরা থাকতেন৷ আমার বয়সী অনেকগুলো ছেলেমেয়ে৷ খেলা এবং খেলা নিয়ে দলাদলি সব হত৷ তবে দল গঠনের সময় বাঙালি-অবাঙালির ভাগটা কোনোদিন মাথায়ই আসেনি৷ বয়সও ছিল না, বিভেদের সংস্কৃতিও ছিল না৷ বরং মাড়ওয়ারি ছেলেদের ভজনা করতাম৷ আমার ফর্সা চেহারাটাকে এমনিতেই তারা, তাদের মায়েরা খুব পছন্দ করত৷ তাদের এই পছন্দের সবথেকে ফায়দা তুলতাম কালীপুজোয়৷ পুজোর পরের দিন দেওয়ালি মূলত মাড়ওয়ারি ও অন্যান্য অবাঙালিদের উৎসব৷ আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির মাড়ওয়ারিরাও এ দিন নানারকম মিষ্টি বানাতেন৷ আমি তাদের দুরকম মিষ্টি খুব ভালোবাসতাম৷ হাতে ঘি মাখিয়ে মুগের লাড্ডু বানাতেন এঁরা৷ আর বাদাম, কাজু, কিসমিসের মণ্ড। খেতাম গণ্ডায় গণ্ডায়৷ মনে হত, এরা আমার বন্ধুও হয়েও থাক আবার খাদ্যাভ্যাসে আমার থেকে পুরো স্বতন্ত্রই থাক৷ ওদের বাচ্চাদেরও হয়ত তাই মনে হত৷ কারণ দীপাবলির সন্ধেতে ছাদের ওপর এক বাঙালি মুটকি তার মাড়ওয়ার প্রদেশের বন্ধুদের অনর্গল নাড়ু আর মুড়কি বিলিয়ে যেত৷ আমাদের কালীপুজোয় তো অলক্ষ্মী বিদায় হত৷ ফলে এনতার মুড়ি মোয়া লুকিয়ে রেখে দিতাম ওদের জন্য৷ রেগে জিভ বার করলেও একচুয়ালি কালী যে ভারি বিউটিফুল মেয়ে, এ বুঝতাম দীপাবলীর মিষ্টান্ন বিনিময়ে৷
আকাশ ভরত শব্দ আর আলোবাজিতে৷ এখানেও ভাগ৷ আবার মিলও এখানে৷ বাঙালিনী বাছত আলো বাজি আর তার অবাঙালি বন্ধুরা চকলেট, দোদোমা, দড়িতে টানটান করে বাঁধা এক ঝাঁক কালিপটকা৷ যখন অনেকখানি ছোট ছিলাম, মনে হত, একটা একটা করে কালি ফাটছে আর সেই শব্দে একটা করে পাখি মরে যাচ্ছে গো! হায় হায়!
এইসব যুক্তিতেও যখন ছেলেগুলো শুনত না, তখন শুরু হত গালাগাল—মর শালারা মর৷ যা নিজের পেটের ওপর পটকা ফাটা৷ আসিস নাড়ু চাইতে! লাত্থি দেব অনেকগুলো৷
পটকাবাজির দলের কেউ হয়ত নিজের আঙুল দুটো ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার কানে৷ আমার কানে যার আঙুল ঢোকানো তার সঙ্গেই ঝগড়া করে যাচ্ছি৷ খেয়াল হতেই ধাওয়া করেছি তারাবাজি ঘোরাতে ঘোরাতে৷ রাউন্ড রাউন্ড শেপে দৌড়৷ সে দৌড়ে মারামারি আছে৷ কিন্তু বন্ধু ফেলে এগিয়ে যাওয়া নেই৷ কোনো বন্ধুর পিছিয়ে পড়াও নেই৷
পরদিন সেই মেশিনঘর৷ কী আশ্চর্য শিশুর মন! দুদলই মেশিনঘরের ছাদে গিয়েছি মরা পাখি খুঁজতে৷ কোনোবার পেতাম না৷ হয়ত আমাদের মিলেমিশে পাখি খোঁজার আকুলতা প্রতিবার পাখিগুলোকে বাঁচিয়ে দিত৷
বেলগাছিয়ার মোড়ে আরজি করের হস্টেল৷ ভূত চতুর্দশীতে ছাত্ররা জানলা বারান্দায় আলো জ্বালাতেন৷ উল্টোদিকে আলী সাহেবের বাড়ি৷ আমরা শুধু জানতাম এ বাড়িতে বড় আলী ও ছোট আলী থাকে৷ বাড়িটি আজ থেকে চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর আগেও প্রাচীনই ছিল৷ স্থাপত্য অন্যরকম, দোতলা হলেও রঙহীন, লাল ইট বার হয়ে থাকত৷ শুধু দরজার ওপর নানা রঙ, আর কিছু আরবী শব্দ৷ তখন তো আরবী কি উর্দু বুঝতাম না৷ শুধু মনে হত, এঁরা বাংলা ভাষা হয়ত বলেন না৷ তাই তাঁদের বাড়ির দেওয়ালের লেখাগুলো বাংলা নয়৷ যাতায়াতের পথে দেখতাম, একমাত্র এ বাড়িতে দীপাবলীর আলো জ্বলে না৷ জ্বলে না তো জ্বলে না—এটুকুই ছিল আমাদের বোধবুদ্ধি৷ তবে এই দীপাবলি পালন না করার ব্যাপারটা জানার পর আলী সাহেবের বাড়িটায় ঢুকতে খুব ইচ্ছে জেগেছিল গো৷ আমার ও আমার বন্ধুদের৷ খালি আলোচনা করতাম—চ, ঢুকে জিজ্ঞেস করে আসি ওঁরা কবে বাড়ি ভর্তি আলো জ্বালাবেন! সিঁড়িটা কেমন! সিঁড়ি শেষে থাম আছে তো! নাহলে ওখানে বেশি করে মোম জ্বালাবেন কী করে! কবে মিষ্টি বানাবেন! ওঁরা কি গুড় নারকেলের মিষ্টি বানাবেন না ঘিয়ের লাড্ডু গড়বেন! বাচ্চাগুলোকে তো রাস্তায় ছেড়ে দিতে পারে! মিষ্টি গড়ার মতো নতুন বন্ধু গড়তাম!
কৌতূহল আর কৌতূহল৷
আজ অনেকদিন বাদে বেলগাছিয়া গিয়েছিলাম৷ ট্রাম লাইনের গা দিয়ে অনেকটা জমি নিয়ে একটা দৈত্যাকার প্রাসাদ চোখে পড়ল৷ ঝকঝক করছে সাদা রঙ, মার্বেল পাথরের কাজ৷ প্রতিবেশীর উন্নতি খারাপ লাগবে কেন! তবে কেন জানি, নতুন প্রাসাদে উঁকি দেওয়ার ইচ্ছে হল না৷ সব যার স্পষ্ট তাতে আর কীসের কৌতূহল৷
পাশে পুরোনো বাড়ি একই চেহারায় আছে৷
সে বাড়ির বাচ্চারা আলোর খেলা খেলে কিনা জানা হয়নি আজো৷
না জানা কিছু তো থাক৷
Advertisement
Advertisement
Advertisement



