বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার ছন্দ বদলে দিতে পারে এক শক্তিশালী লা নিনা—এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাইমেট প্রেডিকশান সেন্টার ও ভারতের আবহাওয়া দফতর। ফলে দিল্লি, গুরগাঁও, নয়ডা, ফরিদাবাদ ও গাজিয়াবাদ প্রভৃতি অঞ্চলও সবচেয়ে কাঁপানো শীতের মুখে পড়তে চলেছে। এ মাসের শেষ থেকেই পড়ে যাবে শীত। চলবে সেই ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত।
অবহাওয়ার সর্বশেষ পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, এ বছর তৈরি হচ্ছে এক শক্তিশালী ‘লা নিনা’ পরিস্থিতি— যার ফলে আগামী শীত হতে পারে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলে সমুদ্রের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেলে ‘লা নিনা’ তৈরি হয়। এর ফলে গ্লোবাল বায়ু প্রবাহ ও মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যার প্রভাব সরাসরি পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়ায়।
‘লা নিনা’ হলো ‘এল নিনো’র ঠিক বিপরীত অবস্থা। এল নিনোতে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাংশ উষ্ণ হয়ে ওঠে, আর লা নিনায় তা ঠান্ডা হয়। এই পরিবর্তন বিশ্ব জলবায়ুকে প্রভাবিত করে— কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও খরা, আবার কোথাও তীব্র শীত ডেকে আনে।
Advertisement
‘লা নিনা’ হলো প্রশান্ত মহাসাগরের বিষুবীয় অঞ্চলের সমুদ্রজলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া—যা বিশ্বজুড়ে আবওয়ার ধরন বদলে দেয়। এটি এল নিনো সাউদার্ন অসিলেশন (এনজো) চক্রের শীতল পর্ব। এই সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জেট স্ট্রিম বা বায়ুমণ্ডলীয় প্রবাহের ধরন পাল্টে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে মৌসুমী বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও ঝড়-বৃষ্টির তীব্রতায়।
Advertisement
ভারতের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন মনে হতে পারে, গড়ের তুলনায় বেশি শীত পড়া, দীর্ঘস্থায়ী ঠান্ডা হাওয়া ও তুষারপাত, যা নদী ও জলাধারের জন্য উপকারী হলেও চলাচল ও জনজীবনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
২০২৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, মার্কিন ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস ক্লাইমেট প্রেডিকশান সেন্টার (সিপিসি) আনুষ্ঠানিকভাবে ‘লা নিনা ওয়াচ’ জারি করেছে। তাদের অনুমান, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৭১ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে লা নিনা তৈরি হওয়ার, যা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে।
ভারতের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগরে নিরপেক্ষ পরিস্থিতি চলছে— অর্থাৎ এন নিনো বা লা নিনা কিছুই সক্রিয় নয়। তবে মনসুন মিশন ক্লাইমেট ফোরকাস্ট সিস্টেম (এমএসএসএস) এবং অন্যান্য বিশ্বব্যাপী জলবায়ু মডেল ইঙ্গিত দিচ্ছে, বর্ষার পর লা নিনা দেখা দিতে পারে।
আবহাওয়া দপ্তরের এক প্রবীন বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, ‘আমাদের মডেল অনুযায়ী অক্টোবর-ডিসেম্বরের মধ্যে লা নিনা গঠনের সম্ভাবনা ৫০ শতাংশের বেশি। সাধারণত লা নিনা বছরে ভারতের শীত জাঁকিয়ে বসে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কিছুটা প্রশমিত হলেও, সামগ্রিকভাবে শীত বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল।’ এর অর্থ, ২০২৫ সালের সার্বিক গড় তাপমাত্রা হয়তো কিছুটা কম থাকবে, কিন্তু শীতের মাসগুলি হবে অস্বাভাবিক ঠান্ডা ও দীর্ঘস্থায়ী।
লা নিনা তৈরি হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের ঠান্ডা জলের প্রবাহ আবহাওয়া পরিবর্তন করে। এর ফলে উত্তর ভারতের দিকে ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত আরও শক্তিশালী হয়। শৈত্যপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে। হিমালয়ে তুষারপাত বেড়ে যায়। বর্ষার সময় যদিও লা নিনা স্বস্তিদায়ক হতে পারে, কিন্তু বর্ষার পরে তা এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কঠোর শীতের ইঙ্গিত দেয়।
যদি ২০২৫ সালের শেষের দিকে লা নিনা পুরোপুরি গড়ে ওঠে, তাহলে উত্তর ও মধ্য ভারতে প্রবল শীত পড়বে, দীর্ঘস্থায়ী তুষারপাত ও শৈত্যপ্রবাহ চলবে, হিমালয়ে ভারী তুষারপাত হবে, শস্য উৎপাদনে প্রভাব পড়বে (বিশেষ করে সরষে, গম, সবজি), স্বভাবতই জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে এবং স্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও জনজীবনে বিঘ্ন তৈরি হবে
বিশেষজ্ঞদের সর্বশেষ পরামর্শ হলো, এবারের শীত হতে পারে দীর্ঘ, কঠোর ও বেশি ঠান্ডা। কৃষি, দৈনন্দিন জীবন, স্বাস্থ্য ও শক্তি ব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়বে নিশ্চিতভাবে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
Advertisement



