প্রবীর মজুমদার
পহেলগামের বৈসরনে ২২ এপ্রিল ২০২৫ দুপুরে অতর্কিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। মৃত্যু হয় ২৬ জনের। এই ঘটনা শুধু সন্ত্রাসবাদের নির্মমতা নয়, বরং প্রশাসনিক গাফিলতি, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার চূড়ান্ত ভাঙনের নগ্ন প্রকাশ। একদিকে যখন এই পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে প্রশাসন ও সরকার, অন্যদিকে তদন্তে নেমেছে এনআইএ। যত দিন এগোচ্ছে বিভিন্ন তথ্য সামনে আসছে। হামলার পরে প্রশাসনের দিক থেকে অনুমতি সংক্রান্ত বিভ্রান্তি এবং পর্যটনকেন্দ্রের সুরক্ষার অভাব এই ঘটনার গভীর ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দায় এড়ানোর প্রয়াস, দেশপ্রেমের নামে জনসাধারণকে দোষারোপ এবং ধর্মভিত্তিক বৈষম্যমূলক প্রতিক্রিয়া জাতীয় নিরাপত্তা ও আইনের শাসনের প্রতি মারাত্মক অবজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়। অতীত অভিজ্ঞতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে শিক্ষা না নিয়ে বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে গভীর প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এই সন্ত্রাসী হামলা প্রশাসনিক অদক্ষতার নির্মম ফল। সরকার স্বীকার করেছে যে পর্যটনকেন্দ্রটি খুলে দেওয়ার আগে পুলিশের অনুমতি নেওয়া হয়নি। অথচ, সরকারি টিকিট ব্যবস্থার মাধ্যমে জনপ্রতি ৩৫ টাকা আদায় চলছিল, যা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না নিয়ে বিপুল সংখ্যক পর্যটককে দুর্গম অঞ্চলে পাঠানো সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। সরকার পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে ন্যূনতম নিরাপত্তা ছাড়াই পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছিল। এ-ধরনের আত্মতুষ্টি সরাসরি সাধারণ মানুষের প্রাণনাশের জন্য দায়ী।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে। এই সিদ্ধান্তের পরে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছিল যে, এর ফলে ‘সন্ত্রাসবাদ কার্যত নির্মূল হবে’, ‘শান্তি ফিরে আসবে’ এবং ‘কাশ্মীরের উন্নয়ন’ দ্রুত ঘটবে। পরবর্তী সময়ে সরকারের তরফে পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছিল যে ২০১৯-২০২১ সময়কালে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা কিছুটা কমেছে এবং বিদেশি জঙ্গিদের অনুপ্রবেশের হার হ্রাস পেয়েছে। একথা ঠিক যে খোলামেলা সংঘর্ষ এবং বড় সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা সাময়িকভাবে কমেছিল। তবে, এই সাফল্যের দাবি বাস্তব পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণকে আড়াল করে রেখেছিল।
সরকারি বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি এবং দীর্ঘমেয়াদি কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, স্থানীয় রাজনীতিকদের আটকের মতো দমনমূলক ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে দৃশ্যত শান্ত রাখলেও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও বঞ্চনার মনস্তত্ত্ব ভেতরে ভেতরে চাপা ছিল। বহু স্বাধীন বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন সরকারকে সতর্ক করেছিল যে এই ‘শান্তি’ আসলে চাপা ক্ষোভের একটি অস্থায়ী আবরণ মাত্র।
পাশাপাশি আছে গোয়েন্দা ব্যর্থতা। এর একটি উদাহরণ হল ২০২৩ সালের রাজৌরিতে একের পর এক হামলা, যেখানে ‘ভুল তথ্য’ এবং ‘ঝুঁকি মূল্যায়নের অভাব’-এর কারণে নিরাপত্তা বাহিনী সাধারণ জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সন্ত্রাসের ধরন পাল্টে যাওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এখন বড় আকারের সংঘর্ষ বা উচ্চ পর্যায়ের আত্মঘাতী হামলার বদলে ছোট ছোট টার্গেটেড হামলা, গেরিলা আক্রমণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিস্তারের দিকে জোর দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদীরা। এই ধরনের সন্ত্রাসকে খুঁজে বের করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন এবং এটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলির জন্য নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আর একটি বাস্তব ঘটনা হলো প্রকৃত নিয়ন্ত্রন রেখার ওপারে অবস্থিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলি সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায়নি। ভারতীয় সেনা এবং গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের শুরু পর্যন্ত অন্তত ২৫-৩০টি সক্রিয় লঞ্চপ্যাড পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সক্রিয় রয়েছে, যেখান থেকে সন্ত্রাসীরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল, সরকার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বদলে কেবল রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন পর্যটন কেন্দ্রের উদ্বোধনের মতো বাহ্যিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প দিয়ে কৃত্রিম স্বাভাবিকতার চিত্র তুলে ধরতে ব্যস্ত থেকেছে। কিন্তু স্থানীয় জনগণের রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আস্থা গড়ে তোলা এবং ন্যায়বিচারের পরিবেশ তৈরি করার মতো গভীর সমস্যাগুলি উপেক্ষিত থেকেছে। এর ফলেই সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ জমেছে, যা আত্মগোপনকারী সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলির শক্তিবৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সরকার নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়াতে দুটি পথ নিয়েছে— প্রথমত, জনগণের দেশপ্রেমের অভাবকে দায়ী করা এবং দ্বিতীয়ত, কাশ্মিরি জনগণের বিরুদ্ধে ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ প্রয়োগ করা।
সুতরাং, সরকার যেভাবে ‘সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ’ এবং ‘উন্নয়ন’-কে প্রচার করেছে, বাস্তবে তা ছিল একটি অসম্পূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর চিত্র। গোয়েন্দা ব্যর্থতা, মাটির নিচে সক্রিয় ক্ষোভের বিস্তার এবং সন্ত্রাসী সংগঠনের কৌশলগত অভিযোজন মিলে জম্মু ও কাশ্মীরকে আবারও মারাত্মক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আত্মতুষ্টি এবং শুধুমাত্র বাহ্যিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ‘স্বাভাবিকতার’ ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করার সরকারি কৌশল সাধারণ নাগরিকদের জীবনকে আরও বেশি বিপন্ন করে তুলেছে। প্রকৃত শান্তি অর্জনের জন্য চাই রাজনৈতিক সমাধান, জনগণের আস্থা ফেরানো এবং গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক সংস্কার।