• facebook
  • twitter
Thursday, 13 February, 2025

তেজহীন বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে চায়

বামেরা অনেকটাই হারানো শক্তি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে

প্রতীকী চিত্র

নারায়ণ দাস

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে গদিচ্যুত করে তার দখল করার স্বপ্ন দেখে আসছে সে অনেকদিন। গত লোকসভা এবং রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল করারও কথা বলেছিল। তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতাদের ছটফটানি দেখার মতো ছিল। কিন্তু ফল যখন বের হয়, তখন নেতারাই শুধু নিরাশ হল না, এই দলের সমর্থক-কর্মীরা দম হারিয়ে ফেলে। কিন্তু নির্বাচনে জিততে গেলে যে কৌশল, যে ঝাঁঝ দরকার, তা এ রাজ্যের বিজেপি নেতাদের মধ্যে নেই। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে গেলে প্রয়োজনে দলের ক্ষিপ্রতা এবং সাংগঠনিক শক্তি— তার কোনওটাই নেই। ফলে নেতারাও হতাশ, বিজেপি কর্মীরাও হতাশ। তখন নেতারা ভোটে কারচুপি এবং শাসক দলের অসুবোপায়ের অভিযোগ হলে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করে। সুতরাং শূন্য কলসী।

আরজি করের মতো ভয়াবহ ঘটনা এবং বিষাক্ত স্যালাইন কাণ্ডে প্রসূতির মৃত্যু অপর তিনজনের মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ের মতো একাধিক বিষয় এই দলের সামনে থাকলেও তা নিয়ে দল তেমনভাবে আন্দোলনমুখী হতে পারল না। পারলে শাসক দলকে চিন্তায় ফেলতে পারত। কিন্তু দল সে কাজে ব্যর্থই বলা চলে। আন্দোলন কোন পথে নিয়ে যাওয়া হবে, ক্ষমতা লাভের জন্য সেই প্রকৃত পথ খুঁজে পাচ্ছে না এই দল। ফলে বিজেপির নেতাদের মধ্যে একাংশ এই বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ নেতাদের দোষারোপ দিচ্ছে। বিজেপি রাজ্যের বড় বিরোধী দল— কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দিতে অক্ষম। যা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে নানা কথা উঠছে। কারণ দল সুযোগ থাকলেও সেভাবে আন্দোলনমুখী হতে পারছে না।

যদিও কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব রাজ্য নেতাদের ওপর চাপ দিচ্ছে রাজ্য বিজেপিকে চাঙা করে তোলার জন্য। রাজ্য বিজেপি উত্তরবঙ্গের যেসব জেলায় আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল, সেই আধিপত্য এখন আর নেই। যেসব কেন্দ্রে গত বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের মুখ দেখেছিল, এখন শাসক দল সেখানে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানার ফলে, সেই সব আসন দলের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কারণ দলের নেতা-কর্মীরা একতাবদ্ধ হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ত্রুটিবিচ্যুতি মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারছে না। তার প্রধান কারণ রাজ্য বিজেপি নেতাদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তো রয়েছেই, তাছাড়া নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। তার মানে রাজ্য বিজেপি দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে দলাদলি ভুলে, দলের শক্তিবৃদ্ধি করতে অসমর্থ।

আর তা হবেই না কেন? রাজ্য বিজেপি দলের সর্বক্ষণের জন্য কোনও সভাপতি নেই। যিনি এখন সভাপতির সাময়িক দায়িত্ব পালন করছেন, সেই সুকান্ত মজুমদার আবার সাংসদ। সুতরাং সাংসদ হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে রাজ্য বিজেপির উত্থানের জন্য বেশি দিতে পারছেন না। পুরো সময়ের জন্য দলের সভাপতি না থাকার ফলে দলকে সঠিক পথে পরিচালনা করার কাজে বিস্তর অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। একজন পূর্ণ সময়ের জন্য সভাপতি নির্বাচনে গড়িমসি দলের ক্ষতি করছে। আগামী বিধাসভা নির্বাচনে (২০২৬) নিয়েও রাজ্য বিজেপির নেতারা বড় বড় কথা বলছেন, কিন্তু শাসক দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে দরকার তা করতে পারছে না এই দল। এই দলের বড় বিপর্যয় হল বলে বিধানসভা নির্বাচনে যে ৭৭টি আসন পেয়েছিল, তাও ধরে রাখতে পারল না। বেশ কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দিলেন। শাসক দলে গেলে যে সুবিধা ভোগ করা যায়, তার জন্য। কেন্দ্র বা রাজ্য বিজেপি নেতারা তাঁদের ধরে রাখতে পারলেন না, তা দলের নেতৃত্বেরই ব্যর্থতা। এখন সম্ভবত ৭৭-এর জায়গায় ৬১ জন বিজেপি বিধায়ক রয়েছেন।

আরজি কর কাণ্ড নিয়ে বিরোধী দল হিসেবে যে ভূমিকা বা আন্দোলন এই দল করতে পারত, তা পারল না নিজেদের মধ্যে দলাদলির কারণেই। যদিও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, যিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে এসেছেন, শাসক দলের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। স্যালাইন কাণ্ডের প্রতিবাদে এই বিরোধী নেতা কয়েকজন বিজেপি বিধায়ককে নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন। তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিবের এবং মেদিনীপুর হাসপাতালের সুপারের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু জনা পনের বিজেপি বিধায়ক তাঁর সঙ্গে গেলেন। কেন বর্তমানে যাঁরা এই দলের বিধায়ক আছেন, তাঁরা সবাই বিরোধী নেতার সঙ্গে গেলেন না। শুভেন্দু অধিকারী দাবি জানিয়েছেন, এই বিষাক্ত সেলাইন কোন কোন রোগীর শরীরে দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা প্রকাশ করতে হবে। কারণ তিনি মনে করেন এর প্রভাব সরাসরি কিডনির ওপর পড়বে। বিজেপি নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, সেলাইন কাণ্ড নিয়ে দল আরও বড় ধরনের আন্দোলনে সামিল হতে পারত। যদি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সঠিক নেতা থাকত।

তাঁরা বলেন, আরজি করের মর্মান্তিক ঘআ এবং সেলাইন কাণ্ড নিয়ে দল যেভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারল না। এটা দলের একটি বড় ব্যর্থতা। দলের প্রাক্তন সভাপতি তথাগত রায় বলেছেন, বিজেপির পূর্ণ সময়ের জন্য কোনও সভাপতি না থাকার ফলে দল সেভাবে জেগে উঠতে পারছে না। তা না হলে শাসক দলের দুর্নীতি এবং অন্যান্য ঘটনা নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন সংঘটিত করতে পারত বিজেপি। তা করতে পারল না সঠিক নেতৃত্বের অভাবের জন্য। দলের অপর প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষকে মাঝেমধ্যে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আর কোনও ভূমিকা করতে দেখা যায় না। বিজেপি নেতাদের মধ্যে একজন সরাসরি বললেন, দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা যদি থাকত, তাহলে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘরবন্দি দলের কর্মী-সমর্থকরা। আন্দোলনে সামিল হতে পারত। কিন্তু তা সম্ভব হল না।

যদিও রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলার মানুষকে আগে ভয়মুক্ত করতে হবে। সদস্য সংগ্রহ এবং সাংগঠনিক কাজে সারা রাজ্যব্যাপী কাজ করছে তাদের দল। এই কাজে অত্যন্ত জরুরি। তারপর বড় আন্দোলনের কথা ভাবা হবে। অথচ কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব সবসময়ই রাজ্য বিজেপির নেতাদের বলছেন, মানুষের পাশে থাকতে এবং তাদের দুঃখদুর্দশার শরিক হবে। আর এক বছর পরেই রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন, সুতরাং অধিক শক্তিসম্পন্ন শাসক তৃণমূলের সঙ্গে লড়তে গেলে এখনই প্রস্তুতির কাজ শুরু করতে হবে। এবার আর কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন না, বিজেপি আগামী নির্বাচনে রাজ্যে ক্ষমতায় আসবে— যেমনটা ২০২১-এর নির্বাচনে জোর গলায় বলেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপ থাকলেও, সেভাবে রাজ্য বিজেপি নেতারা এই নির্বাচনের কাজে মন দিতে পারছে না। এই দলের সবচাইতে ত্রুটি হল রাজ্য নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ যখন যা মনে হচ্ছে বলে যাচ্ছেন। আগে তো ঘর গোছাতে হবে, তারপর শাসক দলের সঙ্গে লড়ার কথা ভাবতে হবে। তৃণমূল ভালো করেই জানে, রাজ্যে বিজেপির নেতারা কখনও সংঘবদ্ধ দল হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ তাদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব। তাই বিজেপি তৃণমূলকে সরিয়ে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করবে সে শক্তি এই দলের নেই।

গত ছয়টি উপনির্বাচনেও বিজেপি কোনও কেন্দ্রে জয়ী হতে পারল না। উত্তরবঙ্গ নিয়ে গর্ব করে এই দল। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, তত শক্তি হারাচ্ছে এ বঙ্গেও— সুতরাং বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হলেও, তাকে সমীহকরার প্রয়োজন মনে করছে না শাসক দল। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তার জন্যই তৃণমূলকে রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত করা অত্যন্ত কঠিন। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে যে ছয়টি কেন্দ্র উপনির্বাচন হল, তা আরজি কর কাণ্ডের পর। অনেকেই ভেবেছিল আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনার প্রভাব পড়বে এই উপনির্বাচনে এবং শাসক দল বেকায়দায় পড়তে পারে। কিন্তু ফল বের হলে দেখা গেল সবকটি কেন্দ্রেই ঘাসফুল প্রতীক প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয়। উত্তরবঙ্গের একটি আসনে, যেখানে শাসক দল আগে জেতেনি, তাও হাতছাড়া হয়ে গেল বিজেপি সহ অন্যান্য বিরোধী দলের।

কারণ মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনহিতকর কাজে উপকৃত, তাই মমতার নেতৃত্বে যে দল, সেই দলের প্রার্থীদের জেতানো নিয়েই ভোটারদের আগ্রহ বেশি। বরং দু-একটি কেন্দ্রে বিজেপির চেয়ে ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে এগিয়ে রইল সিপিএম। বরং সিপিএম বিরোধী দল হিসেবে আন্দোলনমুখী হতে বেশি দেখা যাচ্ছে। এটা সিপিএমের কিছুটা উত্থান বললে অত্যুক্তি হবে না। বিজেপি যখন শক্তি হারাচ্ছে, তখন সিপিএম যুব নেতাদের মাঠে নামিয়ে দিল আরজি কর এবং সেলাইন কাণ্ডে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে। এটা অবশ্যই বলতে দ্বিধা নেই, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর সিপিএম যেভাবে ভেঙে পড়েছিল, দলের সেই দুর্দিন থেকে আস্তে জনমুখী হয়ে উঠছে এই দল। স্যালাইন কাণ্ডে সিপিএম শাসক দলের তীব্র সমালোচনা করে পথে নামল এবং মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুপারের ঘরে তালা লাগিয়ে স্থানীয় জনগণের বাহবা লাভ করল। বিষাক্ত সেলাইন নিয়ে সিপিএমের আন্দোলন মানুষের সমর্থন লাভ করেছে— এটা অস্বীকার করা যাবে না। রাজ্যজুড়ে তারা পথ অবরোধ করেছে— স্বাস্থ্য ভবন অভিযানেও সামিল হয়েছে। গ্রামেগঞ্জের স্কুলে ছাত্র সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবকরাই তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছে না নানা কারণে— তার মধ্যে অন্যতম দারিদ্র্য। তাঁরা পড়ুয়াদের অন্য কাজে নামাচ্ছে কিছু উপার্জনের স্বার্থে। এভাবে স্কুলছুট চললে, গ্রামের অনেক স্কুলেই পড়ুয়াদের অভাবে তালা ঝোলাতে হবে। সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এই স্কুলছুট থামানোর দাবি জানিয়ে জেলায় ডিআই দপ্তর অভিযান চলছে। সিপিএম যে জাব কাটিয়ে মানুষের হয়ে কাজ করছে তার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। দলের পক্ষে এটা শুভ লক্ষণ এবং এভাবে যদি সিপিএম দলকে মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজে লাগাতে পারে, তা দলের শক্তি জোগাবে।

অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস দিন দিন শক্তি হারালেও, সীমিত শক্তি নিয়েই স্বাস্থ্য ভবন অভিযান করেছে। মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে, শাসক দলের কোনও না কোনও ইস্যুতে ব্যর্থতা দিয়ে কংগ্রেস পথে নামছে। জনসমর্থনও পাচ্ছে। যেটা প্রধান বিরোধী দল বিজেপি করতে পারছে না। বিজেপিকে জাগিয়ে রেখেছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিরোধী দলনেতা হিসেবে তার ভূমিকা প্রশংসনীয়।

সুতরাং বামেরা অনেকটাই হারানো শক্তি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। বাম জমানায় বাম দলগুলি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল, আবার তারা একতাবদ্ধ হওয়ার কাজে ব্রতী হয়েছে। বিরোধী দল না থাকলে শাসক দলের কর্মকাণ্ডের বিচার করা, গণতন্ত্রের বিকাশও সেক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হবে।