তরুণ গোস্বামী, সাংবাদিক
উনিশশো তিরানব্বই সালের একুশে জুলাই থেকে দু’হাজার পঁচিশের একুশে জুলাই— মাঝে তিন দশক পার হয়ে গেছে। মাঝে রাজনীতির জগতে নানা পরিবর্তন ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামফ্রন্টের রাজত্ব শেষ হয়েছে; দিল্লিতে বিজেপির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ২১ জুলাই আন্দোলনের যিনি নেত্রী, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১লা জানুয়ারি ১৯৯৮ তৃণমূল কংগ্রেস স্থাপিত করেছেন। কিন্তু এত পরিবর্তনের মধ্যেও ২১ জুলাই ১৯৯৩ কোনওদিন ভোলা যাবে না। এই প্রতিবেদক তখন তরুণ রিপোর্টার। সেদিন যা ঘটেছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী।
Advertisement
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। চোদ্দ দফা দাবি নিয়ে সেদিন মহাকরণ অভিযানের কর্মসূচি তিনি ঘোষণা করেন, যার মধ্যে অন্যতম সচিত্র পরিচয় পত্রের দাবি। সেদিনের স্লোগান ছিল সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়া ভোট হবে না— ‘No Card No Vote.’
Advertisement
মমতা বুঝেছিলেন সচিত্র পরিচয়পত্র, যা দেবে ভারতের নির্বাচন কমিশন, সেটি না হলে ভোটে যে ব্যাপক কারচুপি হয়, সেটি রোখা যাবে না। মমতার এই দাবি পরে নির্বাচন কমিশন মেনে নেয় এবং সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র চালু করে। সে কাহিনি স্বতন্ত্র। আজকের বিষয় ২১ জুলাই, ১৯৯৩। আমি তখন একটি ইংরেজি দৈনিকের রিপোর্টার। আমাদের যাঁরা বস ছিলেন, মমতার আন্দোলন স্পটে গিয়ে নজর রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই মতো বেলা ১০টা নাগাদ যখন প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের অফিসের দিকে যাচ্ছি, তখন চিত্তরঞ্জন এভিনিউ মানুষের মহাসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। চারদিকে যুব কংগ্রেসের সমর্থকরা, হাতে পতাকা এবং মুখে স্লোগান ‘No Card No Vote।’ চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের পাশে সবকটি গলি মানুষে মানুষে ভরা। তাঁদের ডিঙিয়ে হাঁটাই কঠিন। সবাই বলাবলি করছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্র্যাবোর্ন রোডে আসবেন এবং সেই মতো সেদিকেই হাঁটা শুরু করলাম।
ব্র্যাবোর্ন রোডে যখন পৌঁছলাম, ঠিক টি-বোর্ডের অফিসের সামনে তখন দুপুর। চারদিকে শুধুই মানুষ। সবাই নেত্রীর কথা শুনতে চায়। মঞ্চের ওপর সৌগত রায় বারবার অনুরোধ করছিলেন যেন দলের সমর্থকরা মঞ্চ থেকে নেমে যান। তখন ওখানকার মতো লোহার ফ্রেম দিয়ে মঞ্চ বাঁধা হত না। বাঁশ আর চৌকির মঞ্চ, যার ওজন ধারণের ক্ষমতা অনেক কম। চারদিকে এত জনসমাগম যে সৌগতবাাবুর অনুরোধ মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল।
মমতা এসে পৌঁছনোর উৎসাহী সমর্থকদের উন্মাদনা বেড়ে গেল। সকলেই মমতাকে শুনতে চায়। এমন ভাব যেন এখনই গিয়ে সবাই মহাকরণে ঢুকে যাবে। ব্র্যাবোর্ন রোডের পিছন দিয়ে হাওড়া থেকে জটু লাহিড়ী এক বিশাল মিছিল নিয়ে টি-বোর্ডের সামনে এসে পৌঁছলেন। সারা কলকাতা সেদিন মিছিলে মিছিলে স্তব্ধ। রামলীলা ময়দান থেকে একটা বড় মিছিল সুরেন ব্যানার্জি রোড দিয়ে ধর্মতলায় এসে পৌঁছলো। শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মিছিল কার্জন পার্কের সামনে এসে জমা হল। কলকাতার চেহারা সেদিন যে দেখেনি, সে বুঝতে পারবে না যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের চেহারা কেমন হতে পারে। সকলেই ব্র্যাবোর্ন রোডে গিয়ে নেত্রীর কথা শুনতে চায়। তাঁকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়।
বেলা ১টা নাগাদ ব্র্যাবোর্ন রোডের মঞ্চ আর মানুষের চাপ সহ্য করতে পারল না। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। মমতা অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং দলের সমর্থকরা এদিক ওদিক দৌড়তে লাগল। গোটা মধ্য কলকাতা জুড়ে ভয়াবহ অবস্থা। পুলিশের আধিকারিকরা বিপদ বুঝে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে লাগল। কাঁদানে গ্যাসের যে ধোয়া হয় তাতে চোখে দেখা যায় না, চোখ দিয়ে অবিরাম জল পড়তে থাকে। তখন রুমাল বা কোনও কাপড় জলে ভিজিয়ে চোখ মুছলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় জল পাওয়া যাবে তাই আন্দোলনকারীরা যে যেদিকে পারল দৌড়তে লাগল।
এমন পরিস্থিতি যে হতে পারে, তা যুব কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বা পুলিশ কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেনি। তাই প্রথমে পুলিশের সংখ্যা ছিল নগণ্য। যদিও বেলা বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে বিভিন্ন ব্যাপাক থেকে প্রচুর পুলিশ নিয়ে আসা হয়। বেগতিক দেখে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। কোনটা কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটার শব্দ আর কোনটা গুলি, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না।
আমরা সাংবাদিকরাও দৌড়চ্ছি। জানি না কোনদিকে গেলে অফিসে পৌঁছতে পারব। যখন ভিক্টোরিা হাউসের সামনে এসে পৌঁছলাম, তখন পুলিশের গুলিতে দু’টি ছেলে লুটিয়ে পড়ল। একটু থেমে তাঁদের দিকে যে কেউ দেখবে, সেটি সম্ভব হল না। কারণ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ একসাথে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস এবং গুলি চালাতে লাগল। পুলিশের গুলিতে সেদিন তরতাজা তেরোটি যুবক প্রাণ দিলেন। এঁরা হলেন—শ্রীকান্ত শর্মা, বাঁধন দাস, দিলীপ দাস, অসীম দাস, কেশব ব্যানার্জি, বিশ্বনাথ রায়, কল্যাণ ব্যানার্জি, প্রদীপ রায়, রতন মণ্ডল, মুরারী চক্রবর্তী, রঞ্জিত দাস, আব্দুল খালেক আর ইনু।
মেডিকেল কলেজে যখন গেলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি খবর পৌঁছেছে তাঁদের ছেলেরা হয় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে অথবা আহত হয়েছে। মেডিকেল কলেজ চত্বর লোকে লোকারণ্য। তখনকার হাসপাতালের চেহারা এখনকার আলোয় আলোকিত নয়; টিমটিম করে আলো জ্বলছে। ইমার্জেন্সি ভিাগের পাশে নিহতদের তালিকা টাঙানো হয়েছে। চারদিকে স্বজন হারানোর আর্তনাদ আর কান্নার রোল। অন্তত পঞ্চাশ জন আহত হয়েছেন তাঁরাই বা কোথায় ভর্তি হয়েছেন, সে নিয়ে আত্মীয়দের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। মমতা অসুস্থ; অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। যুব কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারা একদিকে নিহতদের আত্মীয়দের সান্ত্বনা দিচ্ছেন, অন্যদিকে আহতরা কোথায় ভর্তি হয়েছেন তা জানার চেষ্টা করছেন।
যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তাই সেদিন আর মৃতদের ময়নাতদন্ত করা গেল না। পরের দিন অর্থাৎ ২২ জুলাই মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে আত্মীয়দের হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়া হল। পরপর ম্যাটাডোর দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের ঘিরে শোকস্তব্ধ আত্মীয় আর বন্ধুরা আর ফুলে ঢাকা তাজা প্রাণ তোলা হল ম্যাটাডোরে। কড়া পুলিশ পাহাড়াতে শববাহী গাড়িগুলি একের পর এক মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ছাড়ল।
অসুস্থ মমতা বার্তা দিলেন সবাইকে শান্ত থাকতে। কোনওভাবেই তাঁরা যেন আইন হাতে তুলে না নেন। কোনও হাসপাতালে যেন ভাঙচুর করা না হয়। ডাক্তার বা নার্সদের যেন নিগ্রহ করা না হয়। সেকথা শুনেছিল যুব কংগ্রেসের সমর্থকরা। কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মৃতের আত্মীয়রা ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেছে কিন্তু পাশে পুলিশকর্মী দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে মারধর করেনি। ২০২৫-এর ২১ জুলাইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। ২০২৬-এ বিধানসভা নির্বাচন। সবাই নেত্রীর কথা শুনতে চায়। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হয় শহিদ বেদীতে মাল্যদানের মধ্যে দিয়ে। তৃণমূল কংগ্রেসের বহু সমর্থক আছেন, যাঁরা ১৯৯৩ জন্মাননি কিন্তু লোকমুখে চলে আসছে ১৩ জন শহিদের কথা, যাঁদের প্রাণের বিনিময়ে এখন ভারতবর্ষের যে কোনও নির্বাচনে সচিত্র পরিচয়পত্র লাগে আর তখনই জীবন্ত হয়ে ওঠেন ১৩ জন মৃত্যুঞ্জয়ী যুবক।
Advertisement



