• facebook
  • twitter
Wednesday, 10 December, 2025

বিপ্লবী সত্যরঞ্জন বক্সী— ‘অগ্নিআখরে আকাশে লেখা’ একটি নাম

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সেই অগণিত বিপ্লবীদের অতুলনীয় শৌর্য-বীর্য আর অসাধারণ আত্মত্যাগ আত্মোৎসর্গের সে ইতিহাস আজ আর তেমন চর্চিত হয় না আত্মবিস্মৃত জনমানসে, বাঙালিয়ানার নব্যদস্তুরে— বিশেষ উপলক্ষ ব্যতীত এবং ঘনিষ্ঠ গণ্ডীর বাইরে।

ফাইল চিত্র

শান্তনু রায়

১৬ জুলাই স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্রের সহযোদ্ধা ও অন্তরঙ্গ সুহৃদ বিপ্লবী তাপস সত্যরঞ্জন বক্সীর ১২৮তম জন্মবার্ষিকী। ইতিহাস পুরুষ সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সদ্য স্বাধীন দেশের আবহে ১৯৪৮-এ একান্নবর্ষীয় বিপ্লবী সাধকের উপলব্ধি উৎসারিত হয়েছিল চরম দার্ঢ্য উচ্চারণে অমোঘ লেখনীতে রচিত ‘অ্যান অ্যাডভেঞ্চার ইন লাইফ’ প্রবন্ধে—
Subhas Chandra Bose has created his own myth.He has become a legend, a legend and an allegory, a poem of thought, feeling and action –an interpretation of life…The splendour that is Subhas Chandra Bose, the glory that is Netaji, the spell, the hypnotism that is the I.N.A.- are all blending.

Advertisement

সুভাষবাদের একনিষ্ঠ অনুগামী সত্যরঞ্জন ১৯৪৯ এ ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় সুভাষ-ইজম শিরোনামে বিবিধ প্রবন্ধে বারংবার সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও তার প্রয়োগের বিষয়টি আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছিলেন।

Advertisement

এও এক সমাপতন যে, অধুনা বাংলা দেশের বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার বার্থী গ্রামের বাসিন্দা ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালের ডা. বসন্ত কুমার বক্সী ও বরিশালের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান মোক্ষদাসুন্দরীর জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং হেমচন্দ্র ঘোষের ভাগিনেয় সত্যরঞ্জনও ভূমিষ্ট হয়েছিলেন সেই ১৮৯৭ সালেই মাস ছয়েকের ব্যবধানে। বিপ্লবী সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ এই অনুগামী ও সহযোদ্ধা মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই ১৯১১ সালে মাতুল হেমচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ঢাকার বিপ্লবী সংগঠন মুক্তি সঙ্ঘ (পরবর্তীতে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামে পরচিত) এর সংস্পর্শে আসেন। শিক্ষারম্ভ যথারীতি গ্রামের স্কুলে হলেও পরে ঢাকায়। ১৯১৯-এ তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এমএ পাশ করেন। পরের বছর ১৯২০-তে আইনের স্নাতক হন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। ইতিমধ্যে মুক্তি সংঘের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হেমচন্দ্রের অনুগামী হিসেবে তিনি বিপ্লবী কাজকর্মও সংগঠিত করে যাচ্ছিলেন। বিভি’র সদর দপ্তর কলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার আগেই কলকাতায় চলে আসেন ১৯২১-এ। মাতুল হেমচন্দ্রের মাধ্যমে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সংস্পর্শে আসার এক দূর্লভ সুযোগ আসে ১৯২৩-এ এবং সেই সম্পর্কের শুরুতেই গয়া কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মতবিরোধে সভাপতিপদ-ত্যাগী ও ইতিমধ্যে গঠিত স্বরাজ্য দলের সভাপতি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবনা ও পরিকল্পনা বিধৃত সত্যরঞ্জনের সুলিখিত ‘এশিয়াটিক ফেডারেশন’ শীর্ষক ইংরাজিতে লেখা একটি প্রবন্ধ দেশবন্ধুকে অতীব মুগ্ধ ও চমৎকৃত করে। দেশবন্ধুর সাগ্রহে প্রবন্ধটি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইংরাজি পত্রিকা ‘ফরোয়ার্ড’-এ প্রকাশিতও হয় সে বছরের নভেম্বরে। সে সময় রাজনৈতিক পরিসরে গুরুত্ববহনকারী প্রবন্ধটি শিক্ষিত মহলেও খুব সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। ফলতঃ, দেশবন্ধুর আগ্রহেই অনতিবিলম্বে ‘ফরোয়ার্ড’-এ সহ-সম্পাদকের পদে যোগ দিলে তাঁর কর্মজীবনের আরম্ভ সাংবাদিক হিসেবে। ক্রমে তাঁর স্নেহ ও আস্থাভাজনও হয়ে ওঠেন। দেশবন্ধুর কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই একদা পরিচিতি ঘটে দেশবন্ধুর রাজনৈতিক শিষ্য ও প্রধান সেনাপতি সুভাষন্দ্রের সঙ্গে যা ক্রমে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণতি লাভ করেছিল।

ঘটনাপ্রবাহে একজন দক্ষ ও দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক হিসেবে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্রের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তাত্ত্বিক প্রচার ও সফল রূপায়ণের তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্ভরযোগ্য ও কুশলী এক সেনাপতি এবং সে ন্যস্ত দায়িত্ব তিনি পালন করে গেছেন নিষ্ঠাভরে। ১৯২৫-এ দেশবন্ধু প্রয়াত হলে তাঁকেই ওই পত্রিকা-সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়— মতিলাল নেহরু স্বরাজ্য দলের সভাপতি হবার পরও। কিন্তু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আপোষহীন মনোভাবে ফরোয়ার্ড-এ প্রথমে ‘অ্যানার্কি ইন পাবনা’, তারপর ‘দি ইউনিফর্মড’ ও সবশেষে ‘স্টেট টেরর’ এবং ১৯২৮-এ তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গলার কথায় ‘যাত্রা কর যাত্রীদল’ শীর্ষক একের পর এক চেতনা-উদ্দীপক তাঁর লিখিত প্রবন্ধ ব্রিটিশ সরকারকে রুষ্ট করে তোলে। অবশেষে ‘ফরোয়ার্ড’-এ প্রকাশিত ‘স্টেট টেরর’ এরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেবার ‘অপরাধে’ তিন বছরের জেল ও দেড় লক্ষ টাকা জরিমানা হয়। বিপুল অঙ্কের জরিমানা দিতে অসমর্থ হওয়ায় ফরোয়ার্ড পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ১৯৩০-এ মুক্তি পেয়ে প্রকাশ করলেন লিবার্টি পত্রিকা। কিন্তু লিবার্টিতেও ডিসেম্বর মাসে ‘ফেয়ারওয়েল এ্যাণ্ড বিওয়ার’ ‘বেঙ্গলিজ ডিউটি’ ও ‘বেঙ্গল ডিউটি’ শীর্ষক তিনটি প্রবন্ধে হিজলি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ঘটনার সমর্থনে প্রতিস্পর্ধী লেখার জন্য ১৯৩১-এ আবার প্রায় দেড় বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয় আপোষহীন ও অনমনীয় সত্যরঞ্জনকে; ছ’মাসের কারাদণ্ড হয় প্রকাশক পুলিনবিহারী ধরের। লিবার্টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি যোগ দেন অ্যাডভান্স পত্রিকায়। ১৯৩৯-এ স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনে মত ও পথের প্রশ্নে উত্তাল ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সদ্য কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত সহযোগী বন্ধু সুভাষন্দ্রের রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মপরিকল্পনা নিজের সুলেখনীতে নিয়মিত বিশ্লেষণ করেছেন সত্যরঞ্জন অ্যাডভান্স পত্রিকায়।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর বিপ্লবীত্রয় বিনয়-বাদল-দীনেশকে স্মরণ করে একদা তিনি লিখেছিলেন— আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে। এই ডাক শুনেছি জীবনের প্রথম ঊষায়, জগতের প্রাণ সঞ্চারে। জননী জাগুক নয়ন খুলে করুক নূতন জীবন লাভ। মনেপ্রাণে, শারীরিক উৎকর্ষে, অন্তরের সাধনায়, মন্দিরের দ্বারে এই প্রত্যাশা আজ উজ্জ্বল হউক— এই প্রত্যাশায় এ ধূলায় রাখিনু প্রণতি’। সাংবাদিকতার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর— প্রকাশ্যে নাহলেও, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহায়তা করে গেছেন সুকৌশলে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, মেদিনীপুরে বার্জ, পেডি ডগলাস ঢাকায় লোম্যান, হাডসন, কুমিল্লায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উপর শান্তি-সুনীতির গুলি, বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের রাইটারস বিল্ডিং অভিযান, অ্যাণ্ডারসনের উপর বিপ্লবী ভবানী ভট্টাচার্যের আক্রমণ এমনকী এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ১৯৪১-এর জানুয়ারিতে সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান সব কিছুতেই তাঁর কোনও না কোনওভাবে ভূমিকা ছিল সমস্ত ঘটনার পরিকল্পনায় তাঁর মস্তিষ্কের অবদান অনস্বীকার্য।

১৯৩২-৩৮ তিনি বিনা বিচারে রাজবন্দি হিসাবে আটক ছিলেন বক্সা ও দেউলি বন্দিনিবাসে। ১৯৩৯-এ সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফরোয়ার্ড ব্লকের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির সেক্রেটারি হলেন সত্যরঞ্জন। কিন্তু ১৯৪০-এর প্রথমভাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠায় বাংলার পুলিশ মহলও সচকিত হয়ে উঠল, এক গভীর রাতে বাংলার প্রায় সব জেলা থেকে যে পঁচিশ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্যরঞ্জন বক্সী, সত্য গুপ্ত এবং ভূপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায় প্রমুখ বিভি-র নেতৃবৃন্দ ছিলেন প্রেসিডেন্সী জেলে — যেখানে ছিলেন সুভাষচন্দ্রও। সেই সুযোগে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনার সুযোগ ঘটে যায় এবং কিছু একটা পরিকল্পনাও হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনাবিচারে আটক সুভাষচন্দ্র মুক্তির দাবিতে অনশন শুরু করলে, ব্রিটিশ সরকার চাপে পড়ে সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দেয় ৫ ডিসেম্বর। প্রায় একই সময় অতিরিক্ত অসুস্থতার কারণে সত্যরঞ্জনকেও পুলিস কিছুদিন ছেড়ে দেয়। ফলে পরিকল্পনা অনুযায়ী নিঃশব্দে চলতে পরবর্তী অধ্যায়ের প্রস্তুতি বিভি-র নায়ক সত্যবাবুর সক্রিয় নেতৃত্বে লালবাজারের গোয়েন্দা পরেশ রায়ের সাহায্যে লালবাজারের সমস্ত কার্যকলাপ ও পরিকল্পনা অগ্রিম জেনে ও পর্যবেক্ষণ করে।

প্রসঙ্গত, সুভাষচন্দ্রের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সত্যরঞ্জন বক্সী গভীরভাবে জড়িত ছিলেন সুভাষ-অন্তর্ধানের পরিকল্পনা ও তা রূপায়নের সঙ্গেও। তিনি ও মেজর সত্য গুপ্ত নিরলসভাবে ও অতি গোপনে সেই মহানিষ্ক্রমনের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এর রূপায়ণপর্বের অনেক কিছুই তাঁর জ্ঞাতসারে হয়েছিল। আফগানিস্তানের পথে সুভাষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বিভির সদস্যরা সুভাষের অন্তরঙ্গ সুহৃদ সত্যরঞ্জন বক্সীর মাধ্যমে। সুভাষচন্দ্র বিদেশ থেকে গোপনে সর্বপ্রথম প্রচারপত্র পাঠিয়েছিলেন সত্যরঞ্জন বক্সীদের কাছে, বিভির কর্মীরা সেগুলো গোপনে ছাপিয়ে দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রাশিয়া মিত্রপক্ষে যোগদান করলে ভারতের কম্যুনিস্টরা ব্রিটিশের যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ আখ্যা দেওয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলো। সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের ব্যাপারে সক্রিয় সহযোগী দল পঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টি তখন বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্তর্ধান সংক্রান্ত তথ্য যা তাদের জানা ছিল সব পুলিশকে জানিয়ে দেয়। কম্যুনিস্ট ‘বন্ধু’দের সৌজন্যে পুলিশের আইবি বিভাগ অন্তর্ধানের সঙ্গে জড়িত বিভি-র সদস্যদের নাম জানতে পারল। পুলিশ অনতিবিলম্বে সত্যরঞ্জন বক্সী ও যতীশ গুহকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি ফোর্টে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। কিছুদিন পর গ্রেপ্তার হলেন বিভি-র আরেক সদস্য শান্তিময় গঙ্গোপাধ্যায়। এমনকী নেতাজির বার্মা ফ্রন্টে উপস্থিতির কথা জানতে পেরে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সত্যরঞ্জনের ছোট ভাই সুধীর বক্সি, ধীরেন সাহারায় ও সত্যব্রত মজুমদারকে লাহোর কোর্টে। পরে তাঁদেরও সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৯৪২-এর মে মাস হেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিনাবিচারে কারারুদ্ধ হয়ে থাকতে হয় সত্যরঞ্জনকে এবং অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়— প্রথমে লালকেল্লার ভূগর্ভস্থ সেল-এ, পরে নৈনী জেল ও শেষে প্রেসিডেন্সি জেলে। বন্দিদশায় ব্রিটিশের নির্মম অত্যাচারে যতীশ গুহ মারাই যান, সত্যবাবুর শরীরও ভেঙ্গে পড়ে। অনাহারে অর্ধাহারে থেকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দিন কাটিয়ে অবশেষে মুক্তি মেলে ১৯৪৬-এ। তবু তিনি প্রাক্‌স্বাধীনতা পর্বের মত স্বাধীনোত্তর দেশেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৮-এ ইউনাইটেড সোসালিস্ট অর্গানাইজেশনের সম্পাদক এবং একই সঙ্গে শরৎচন্দ্র বসুর ‘দ্য নেশন’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী ও সত্যের পুজারী; দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রামে তাঁর নির্ভীক সাংবাদিকতা শুধু সেকালেই নয়, সর্বযুগে সর্বকালের জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ হওয়ার দাবি রাখে। স্বাধীনোত্তর ভারতে পণ্ডিত নেহরু তাঁকে উপরাষ্ট্রপতি পদে যোগদানের জন্য আহ্বান করেছিলেন কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৫২-য় প্রথম সাধারন নির্বাচনে তিনি দক্ষিণ পূর্ব কোলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে ফরোয়ার্ড ব্লক প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন যদিও জয়লাভ করতে পারেননি। কিন্তু এর পরও তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে রাখলেন। নেতাজী সম্পর্কে তাঁর এক অসামান্য রচনা— অ্যান অ্যাডভেঞ্চার ইন লাইফ। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কথিত বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়নি, তিনি বেঁচে আছেন এবং একদিন আবির্ভূত হবেন।

সেই চিরসখা একদা যাঁর সঙ্গে শপথ করেছিলেন— We shall live togeher and we shall die together ‘তিনি সন্ন্যাসী দেশনায়ক রূপে একদিন না একদিন প্রত্যাবর্তন করবেন এই আশায় কোলকাতার ভবানীপুরের বাসস্থান ত্যাগ না করে স্ত্রী পুত্র কন্যার মৃত্যুশোক সয়েও সত্যরঞ্জন একান্তে অপেক্ষা করে গেছেন আমৃত্যু। ১৯৮৩-র ৮ জানুয়ারিতে চিরঘুমে যাওয়া পর্যন্ত। আর প্রায় প্রতি ২৩ জানুয়ারি ও ২১ অক্টোবর কৃশ শীর্ণ রুগ্ন দেহ নিয়েও উপস্থিত হতেন সেই ইতিহাস পুরুষের স্মৃতিতর্পণে— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অনুষ্ঠিত সভাসমিতিতেও ভাষণ দিয়েছেন। এই নিবন্ধকারেরও সেই সুযোগে এই বিপ্লবী তাপসকে একাধিকবার দর্শন করার ও ঈষৎ খর্বকায় মানুষটির বলিষ্ঠ কন্ঠে আবেগমথিত দার্ঢ্য ভাষণে ঋদ্ধ হবার সৌভাগ্য হয়েছিল।
সংকল্পে দৃঢ় এবং বিশ্বাসে অটল এই মহাপ্রাণত্যাগী বিপ্লবী মানুষটি সারাটা জীবন বিপ্লবের সাধনায় স্বেচ্ছায় কৃচ্ছতাকে বরণ করেছিলেন সানন্দে— শত অসুবিধা ও আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শুভ্র আত্মসম্মানের অধিকারী এই মানুষটি চিরকাল ছিলেন অনুগ্রহ গ্রহণে পরাম্মুখ। রাষ্ট্রীয় সহায়তার প্রস্তাবেও সেকারণে অন্তরের সাড়া মেলেনি। ‘ওয়ান ইনডিভিজুয়াল মে ডাই ফর অ্যান আইডিয়া বাট দ্যাট আইডিয়া উইল আফটার হিজ ডেথ ইনকারনেট ইটসেলফ ইন থাউজেণ্ড লিভস’— সুহৃদ ও সহযোদ্ধা সুভাষচন্দ্রের এ কথায় গভীরভাবে প্রভাবিত সত্যরঞ্জনেরও প্রতীতি ছিল— The Idea remains dearthless, undying and the shinning Idea.। আবার সুভাষচন্দ্র যেমন বলেছিলেন ‘ইণ্ডিয়া ফ্রিড মিনস হিউম্যানিটি সেভড’ তেমনই তাঁর ভাবাদর্শে দীক্ষিত এই অন্তরঙ্গ সুহৃদ এই সর্বত্যাগী বিপ্লবী সাধকেরও বিপ্লব সাধনা ছিল সমগ্র মানব জাতির মুক্তিসাধনার জন্য যা সর্বকালেই চিরন্তন।

পরিশেষে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবীদেরও যে এক বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ইতিহাস তার সাক্ষী। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই দেশের ক্ষমতাসীন দলের এবং সরকারি প্রচারেও প্রাধান্য পেত অহিংস আন্দোলন ও একটি বিশেষ দল ও পরিবারের ভূমিকার। চলেছে বিপ্লবী আন্দোলন— সশস্ত্র সংগ্রামের প্রচেষ্টাকে লঘু করে সে ইতিহাস বিস্মরণ ঘটানোর কৌশল।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সেই অগণিত বিপ্লবীদের অতুলনীয় শৌর্য-বীর্য আর অসাধারণ আত্মত্যাগ আত্মোৎসর্গের সে ইতিহাস আজ আর তেমন চর্চিত হয় না আত্মবিস্মৃত জনমানসে, বাঙালিয়ানার নব্যদস্তুরে— বিশেষ উপলক্ষ ব্যতীত এবং ঘনিষ্ঠ গণ্ডীর বাইরে।

আজ এই পুণ্যদিবসে সেই মহাপ্রাণের চরণে শতকোটি প্রণাম নিবেদনের লগ্নে আর একবার স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার বিপ্লববাদের ইতিহাস স্মরণ ও চর্চায় উদ্যোগী হওয়ার পরিসর উপস্থিত বর্তমান সময়ের কাছে।

Advertisement