বিমলকুমার শীট
রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে ভারতমাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্মে রূপ পেয়েছে ভারতবর্ষের হৃদয় দ্বন্দ্ব, সুখ, দুঃখ, বেদনা, সংঘাত, রাজনৈতিক উত্থান পতন, বিচিত্র অনুভবে ও প্রকাশে যার ঘটেছে জীবন্ত প্রতিফলন। রবীন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন সারা পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ এমন ঘটনা কমই ঘটেছে যা তাঁর সৃষ্টিশীল অনুভবকে দোলা দেয়নি। তাঁর পঞ্চাশতম জন্মদিন পালন ছিল বেশ আনন্দের, সেই সঙ্গে বিষদেরও।
নবজাগরণের প্রাণভূমি ভারতবর্ষের কলকাতা শহরে জোড়াসাঁকোর ভদ্রাসন বাড়িতে ১২৬৮ সালে ২৫ বৈশাখ (১৮৬১ খ্রিঃ, ৭ মে) পৌত্তলিকতা বিরোধী এক পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। রবীন্দ্র-জন্মক্ষণটি নেহাতই সাদামাটা ছিল। জন্মক্ষণটি ছিল রাত্রি দুটো আটত্রিশ মিনিট। পিতা দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪৪ বৎসর, মা সারদা দেবীর বয়স আনুমানিক ৩৫ বৎসর। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এ বৎসর জন্মগ্রহণ করেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। যাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে কবির কর্মসূত্রে কমবেশি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মদিনকে জীবনের একটি বিশেষ দিন বলে অনুভব করতেন। তাঁর জীবনের পঞ্চাশ বৎসর হতে শেষ জন্মদিন পর্যন্ত প্রায় প্রতি বৎসরেই ‘পঁচিশে বৈশাখ’ সম্বন্ধে কিছু না কিছু বলেছেন বা লিখেছেন। পৃথিবীতে নিজের আবির্ভাবকে এমন বিচিত্ররসে অভিষিক্ত করে আর কোনো কবি বা লেখক এত রচনা প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায় না।
মাঘোৎসবের তিন দিন পরেই (১৪ মাঘ ১৩১৮) কলকাতার টাউন হলে কবির পঞ্চাশৎ জন্মোৎব হল। মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রমুখদের নিয়ে বাংলার মনীষীদের একটি সমিতি গঠিত হয়। দেশের মধ্যে এক আবেদন প্রচার করে তাঁরা কবির জন্মোৎসব সম্বন্ধে দেশবাসীর সহায়তা প্রার্থনা করেন। আবেদনে লেখা হয়, ‘ইতিপূর্বে আমরা দেশের সাহিত্যিকগণকে যথোচিত সম্মান দেখাই নাই, তাহাতে আমাদের জাতীয় ত্রুটি হইয়াছে। রবীন্দ্রবাবুর আগামী জন্মতিথি উপলক্ষে যেন আমরা ঐ ত্রুটির সংশোধন করিতে পারি। রবীন্দ্রবাবুর প্রতি সম্মান দান যাহাতে দেশব্যাপী হয়, তজন্য সমিতি দেশের প্রতিভূস্বরূপ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে এই কাজের ভার গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিবেন। এবং পরিষদের সহিত পরামর্শ করিয়া উৎসবের দিন ধার্য করিবেন।’ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি তখন কলকাতা হাইকোর্টের অন্যতম বিচারপতি ও বিদ্যানুরাগী সারদাচরণ মিত্র (১৮৪৮-১৯১৭) এবং সম্পাদক রিপন কলেজের অধ্যাপক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯)।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদই এই জন্মোৎসবের সকল ব্যবস্থাভার গ্রহণ করল। ১৪ মাঘ ১৩১৮ (২৮ জানুয়ারি, ১৯১২) কলকাতা টাউন হলে সম্বর্ধনা সভা আহূত হল। সাহিত্য পরিষদের সভাপতি সারদাচরণ মিত্র বললেন, ‘কবিকে সম্মান করিয়া আমরা আপনাদিগকে সম্মান করিতেছি’। অধ্যাপক পণ্ডিত ঠাকুরপ্রসাদ আচার্য উপনিষদ হতে মন্ত্রাদি পাঠ করলেন। যতীন্দ্রমোহন বাগচী রচিত সময়োপযোগী গান গাওয়া হল। নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় একটি সুলিখিত ভাষণ পাঠ করে কবিকে রৌপ্যাধারে অর্ঘ্যদান করলেন। তারপর সভাপতি কবিকে মালাচন্দন দিয়ে একটি স্বর্ণকমল উপহার দিলেন। সম্পাদক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী পরিষদের পক্ষ থেকে অভিনন্দনপত্র পাঠ করলেন।
বাঙালি শিক্ষাবিদ স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৪-১৯১৮) সভায় বলেন যে, ত্রিশ বৎসর পূর্বে তরুণ রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্যের অভিনয় দেখে তখন তাঁর যে ভাবোদয় হয়েছিল, তা তিনি সেই সময়েই একটি কবিতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন, এই সভায় তিনি সেই কবিতাটি পাঠ করে বলেন যে, তাঁর ভবিষ্যৎবাণী কিভাবে সফল হয়েছে তা দেখে তিনি আজ অহংকৃত হচ্ছেন। টাউন হলের সভা সম্বন্ধে প্রবাসী পত্রিকা লেখে যে যাঁরা দেরি করে সভায় গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রবেশ করতে না পেরে বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন, নয়ত ফিরে এসেছিলেন। কবিগুরুর নোবেল পুরস্কারের (১৯১৩) আগে এই জন্মদিন পালন বিশেষ গর্বের। টাউন হলে সভা ছাড়া আরও একদিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ছাত্র সভ্যগণ এবং একদিন সম্বর্ধনা সমিতির সভ্যগণ সন্ধ্যা সম্মিলনে কবিকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন (২০ মাঘ ১৩১৮)।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে আনন্দ-মিলনে কবি যে অভিভাষণ দেন, তার একস্থানে বলেন যে, ‘সাহিত্য আজ পর্যন্ত আমি যাহা দিবার যোগ্য মনে করিয়াছি তাহাই দিয়াছি, লোকে যাহা দাবি করিয়াছে তাহাই জোগাইতে চেষ্টা করি নাই। আমি আমার রচনা পাঠকদের মনের মতো করিয়া তুলিবার দিকে চোখ না রাখিয়া আমার মনের মতো করিয়াই সভায় উপস্থিত করিয়াছি। সভার প্রতি ইহাই যথার্থ সম্মান।’ ২৩ মাঘ ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশৎ জন্মদিন উপলক্ষে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ যে অভিনীত হয় তা রবীন্দ্রনাথ দেখতে যান । সে দিনের অভিনয়ে জনপ্রিয় ও অ্যাকটিভ সদস্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী (১৮৮৯-১৯৫৯) কেদারের ভূমিকায় নেমেছিলেন। এই অভিনয় কবিকে মুগ্ধ করে। কিন্তু কবির পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্রবিরোধী দল মুখর হয়ে উঠল। এই সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে এমন কুৎসিত মন্তব্য করা হল ও অবাঞ্ছিত পরিবেশ সৃষ্টি হল যে, সেই কারণে সকলকে লজ্জায় অধোবদন হতে হয়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই আনন্দঘন জন্মোৎসব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কবি যখন শান্তিনিকেতনে ফিরলেন তখন বিদ্যালয়ের উপর দিয়ে একটা অশান্তির ঝড় বইছিল। সময়টা রবীন্দ্রনাথের সুখের ছিল না। পূর্ববঙ্গে আসাম সরকার এক গোপন ইস্তাহার প্রচার করে সরকারি কর্মচারীদের জানিয়ে দেয় যে, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার সম্পূর্ণ অনুপযোগী। মাঘোৎসবের দিন (২৬ জানুয়ারি ১৯১২) দৈনিক Bengalee সংবাদপত্র এই গোপন ইস্তহার প্রকাশ করে দেয়। সার্কুলারের শেষে ছিল – any connection with the institution in question is likely to prejudice the future of the boys who remain pupils of it after the present warning। অর্থাৎ এই সতর্কবাণী ঘোষিত হবার পর যদি কোন ছাত্র তথায় থাকে, তবে তাঁর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এর কারণ পূর্ববঙ্গ-আসাম সরকারের শান্তিনিকেতনে কয়েকজন অধ্যাপকের অবস্থান সম্পর্কে ঘোর আপত্তি ছিল। এরা হলেন ত্রিপুরার কালীমোহন ঘোষ ও খুলনা জেলার হীরালাল সেন এবং ছাত্র প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়— এরা ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অপরাধ তিনি এঁদের আশ্রমে আশ্রয় দিয়েছিলেন। যাই হোক এঁরা একে একে আশ্রম ত্যাগ করলেন। ছোট ছোট ছেলেরাও চোখের জল ফলে আশ্রম ত্যাগ করলেন। কিন্তু কবির হৃদয় থেকে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি দূরীভূত হল না।