• facebook
  • twitter
Thursday, 22 May, 2025

রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ঈশ্বর প্রেমের প্রকাশ

১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর পৌষ উৎসবে শান্তিনিকেতনে যিশুখ্রিস্টের জীবনাদর্শন নিয়ে উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে আজও নিয়মিত ভাবে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পথের সঞ্চয় প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন খ্রিস্টের জীবনবৃক্ষ হতে ইউরোপে যে ধর্মবীজ পড়িয়াছে সেটা হল দুঃখকে পরম ধন হিসাবে গ্রহণ করা।

ফাইল চিত্র

শিবশঙ্কর দাস

রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে একটা কথাই মনে হয়। এ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাটা তিনি এক গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন। বহুমুখী ও বিচিত্রমুখী রবীন্দ্র প্রতিভার তুলনা নেই। সাহিত্যের এমন কোনও শাখা নেই আধুনিক জীবনের এমন কোনও অঙ্গ নেই যা নব নব উন্মেষশালিনী রবীন্দ্র প্রতিভার স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেনি।

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়। তাঁর মাতার নাম সারদাদেবী, গতানুগতিক বিদ্যালয় পড়াশুনা না করলেও গৃহ-শিক্ষক ও গৃহের পরিচর্যা তাঁকে পরবর্তী জীবনে বিশেষভাবে সমৃদ্ধশালী করে তোলে।

কবি সাহিত্যিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অখন্ড মানবতার সাধক। কত ভাবেই না তাঁর পরিচয় দেওয়া যায়৷ তিনি নোবেল জয়ী বিশ্বকবি, তিনি উপন্যাসিক, তিনি গদ্যকার, তিনি নাট্যকার, তিনিই আবার চিত্রকর। যথার্থই এক বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠপুত্র রবি থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে ওঠার প্রাথমিক পর্বটুকু বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথ সকল মানুষকেই পরম মানব রূপে চিহ্নিত করেছেন। কবির মতে বাইরে রয়েছে নানা দেশে পোশাকে পরিচ্ছদে ধর্মে আচারে ব্যবহারে নানা ধরণের মানুষ। কিন্তু ভিতরে সবাই একই মানুষ। মানুষের কোন রং নেই, মানবতার দিক থেকে এই বিশিষ্ট চিন্তাধারা থেকে রবীন্দ্র সাহিত্য বিশ্বজনীনতার সুর ফুটে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর প্রেমের প্রকাশ পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংযমী জীবন ও আধ্যাত্মবাদ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে । পরবর্তী গীতাখ্যপর্বে ‘আমির খোলস থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রয়াস বা ক্রমান্বয়ের সার্থকতা লাভ করে গীতাঞ্জলির শেষ কবিতায় সেখানে তিনি বলেন ‘আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম’। সকলে সাথে আমিকে মিশিয়ে ফেলার যে তীব্র প্রয়াস তা গীতাঞ্জলি থেকে গীতালি এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমণ করে অবশেষে সার্থকতা লাভ করল।

তিনি তাঁর ঈশ্বর চিন্তা বা ভাবধারকে কোন সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে প্রকাশ করেননি। ধুলার ওপর খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতি গভীর ভালবাসা ও তাঁদের সেবাই ঈশ্বর সেবার প্রধান ধর্ম বলে তিনি মনে করেছেন। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির কাব্য সম্বন্ধে তিনি ভূয়াসী প্রশংসা করেছেন এবং বৈষ্ণব সাহিত্যের পদকর্তাদের ঈশ্বর প্রকাশ তত্বকে যথাযথ মর্যাদা দান করেছেন। এছাড়া তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ে যে সকল মহা মানবগণ পৃথিবীতে এসেছিলেন তার প্রতি ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর পৌষ উৎসবে শান্তিনিকেতনে যিশুখ্রিস্টের জীবনাদর্শন নিয়ে উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে আজও নিয়মিত ভাবে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পথের সঞ্চয় প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন খ্রিস্টের জীবন বৃক্ষ হতে ইউরোপে যে ধর্মবীজ পড়িয়াছে সেটা হল দুঃখকে পরম ধন হিসাবে গ্রহণ করা। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিনিকেতন গ্রন্থের ‘নমস্তে স্ত’ প্রবন্ধে ঈশ্বরকে পিতারূপে সম্বোধন করে মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ককে মধুরতম করে তোলার জন্য আহ্বান করেছেন। সব সম্বন্ধের মধ্যে প্রথম সম্বন্ধ হচ্ছে পিতা পুত্রের সম্বন্ধ। পিতা যত বড়ো হন। আর পুত্র যত ছোট হোক উভয়ের মধ্যে শক্তির যতই বৈষম্য থাক তবু উভয়ের মধ্যে একটি গভীরতম ঐক্য আছে। সেই ঐক্যটির থেকেই এতটুকু ছেলে তার এত বড় বাপকে লাভ করে।

পরবর্তীকালে আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্ম মানে মানবধর্ম । রবীন্দ্রনাথ মানবতা বা যাকে তিনি নিজে বলতেন মানবধর্ম তাকে সমস্ত ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিয়েছিলেন।