• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ভাবেন না প্রধানমন্ত্রী

পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিটি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। সাধারণের তা কেনা নাগালের বাইরে। অথচ রাজ্য সরকার মনে করে কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এবং পাচার বন্ধে বিএসএফ’কে সক্রিয় হতে না বললে, দ্রব্যমূল্য পড়তেই থাকবে।

ফাইল চিত্র

নারায়ণ দাস

তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী ১৪০ কোটি ভারতবাসীর জীবনযাত্রা নিয়ে অনেক কথাই বলেন, কিন্তু বলেন না দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা হল আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর বেকারিত্ব। তিনি প্রথমবার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আনন্দের আতিশয্যে দেশবাসীকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার এই পদে আসীন হয়ে তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি। তবে দেশের উন্নয়নজনিত অনেক কথাই তাঁর মুখে শোনা যায়। কিন্তু দেশের সিংহভাগ মানুষ ব্যাপক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে কঠিন জীবনযাপন করছেন। তাঁদের নাগালের বাইরে এই মূল্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা দেশের যাঁরা গরিব, যাঁদের রোজগারের পথ প্রায় বন্ধ, যাঁরা দলিত এবং পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষের দুর্বিষহ জীবনযাপনের কথা প্রধানমন্ত্রী ভাবেন কিনা, তা বোঝার উপায় নেই। তিনি দেশবিদেশের অনেক কথাই ভাবেন। কিন্তু নিজের দেশের গরিব অসহায় মানুষের জীবনযাত্রা যে গভীর সঙ্কটের মধ্যে পড়ে আছে, সেকথা তাঁর মুখে শোনা যায় না। দেশের লোকসংখ্যা বেড়েই চলেছে— পাল্লা দিয়ে চলেছে মূল্যবৃদ্ধি। অথচ কর্মসংস্থানের তীব্র অভাব। দেশের অঙ্গ রাজ্যগুলির প্রশাসনও এই মূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে পারছে না। যারা শাসনভার হাতে নিয়ে আছেন এই রাজ্যগুলির, তাঁদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন ‘কেন্দ্রকে বলুন’। প্রধানমন্ত্রী কি একটি বারের জন্যও ভাবেন ওই অসাধারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা, যা মানুষকে চরম কষ্টের জীবনযাত্রা চালাতে বাধ্য করছে।

Advertisement

এ পর্যন্ত কি শুনেছেন পেঁয়াজের মূল্য প্রতি কেজি ৮০ টাকা, শুনেছেন কি আলুর দাম ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা! তেমনই অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। রাজ্যগুলির প্রশাসন যাঁরা চালান, তাঁরা বলেন, কেন্দ্রের অক্ষমতার জন্যই এই মূল্যবৃদ্ধি। কী করে এই মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যায়, সে কথা একবারের তরেও শোনা যায়নি প্রধানমন্ত্রীর মুখে—অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুনামের অধিকারী। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবার অনেকটাই দুর্বল। সুতরাং সরকারের অস্তিত্ব নিয়েও চিন্তা করতে হয়। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি এবং লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক এবং যুবতীরা যে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, তাদের কথা ভাবার বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কোনও চেষ্টার কথা শোনা যায় না প্রধানমন্ত্রীর মুখে। সাধারণ মানুষের যে দুর্গতি, তা দেখবে কে?

Advertisement

এই সরকারকে সর্বদাই একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে— কখন কী হয়। মণিপুর গত কয়েকমাস হল অগ্নিগর্ভ। সেখানে খুন জখম ও রক্তপাত চলছে। তা কীভাবে বন্ধ করা যায়, এবং সেখানে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, তার চেষ্টাও প্রধানমন্ত্রীকে করতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বিজেপি এই রাজ্যের নির্বাচনে বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। সাম্প্রতিক যে খুনোখুনি হচ্ছে এবং মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, তা বন্ধ করার সেরকম কোনও কার্যকরী উদ্যোগ বিজেপি সরকারকে করতে দেখা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বর্তমানে মণিপুরে যে অশান্তি চলছে, তা দমনে ৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় ফোর্স পাঠিয়েই দায়িত্ব সারছে।

বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র নেতারা মণিপুর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধি অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়ে এই ছোট রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছেন। তিনি চান প্রধানমন্ত্রী এখনই মণিপুরে গিয়ে সেখানকার সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তা না হলে মণিপুর জ্বলতেই থাকবে। সেখানে শান্তি ফিরে আসবে না।

বলছিলাম, এই সরকার তার স্থায়িত্ব নিয়ে সর্বদাই চিন্তিত। এবার বিজেপি গত লোকসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়নি বলে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি, আগের দু’বারের মতো। বিজেপিকে সরকার গড়তে নির্ভর করতে হয়েছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এবং অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর দলের উপর। এই দুই দলের সাংসদদের সমর্থনপুষ্ট এবারের কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তবে নীতিশ কুমার কখন কী করে বসেন, তা নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা সবসময়ই দুর্ভবনায় থাকেন। তিনি একসময় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনাও প্রকাশ করেছিলেন। আর এক দল থেকে আরেক দলে যাওয়া, আবার অনেক সময় যে মন্তব্য করেন, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে তা ফিরিয়ে নেওয়া তাঁর অভ্যাস। সুতরাং এই দুই দলের সমর্থন হারালে মোদী সরকার যে ফের বিপদে পড়বে, সেই চিন্তায় নেতারা আকুল। তাই বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার নেতারা বলেন, এবারের কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পাঁচ বছর টিকবে না।

দ্বিতীয় বিষয় বেকারিত্ব। শিক্ষিত বেকারে দেশ ভরে গেছে। এই মুহূর্তে দেশে বেকারের সংখ্যা কত তার সঠিক কোনও হিসেব কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার দিতে পারছে না। অথচ উচ্চ ডিগ্রিধারী যুবক-যুবতীরা উপযুক্ত চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরে তা না পেয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন, সেকথা প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু এই ‘ট্রেন্ড’ বাইরে যাওয়া কীভাবে বন্ধ করা যায়, তার কোনও উপায় খোঁজেন না। তিনি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন কিন্তু বেকারিত্ব দূর করার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ বেকারের চাকরি হবে। প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। ফলে দেশে বেকারিত্ব থাকবে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল বেকারদের কপালে চাকরি মিলছে না। তাঁর তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রিত্ব কালেও সেই একই অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ঘরে ঘরে বেকার। অসহায় হয়ে তাঁরা চাকরির জন্য জীবনপাত করছেন। কিন্তু কোথায় চাকরি? উপযুক্ত চাকরি যদি শিক্ষিত বেকারদের জন্য থাকত, তাহলে একটি ঝাড়ুদারের পদের জন্য পিএইচডি ডিগ্রিধারী, ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী যুবক-যুবতীরা দরখাস্ত করতেন না। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘সরকারি চাকরি তো, তাই ঝাড়ুদারের পদই তাঁদের পছন্দ। তাঁদের বাঁচার পথ। কিন্তু যাঁরা এই পদের জন্য দরখাস্ত করছেন, তাঁরা উচ্চ ডিগ্রিধারী বলে প্রথম বিচারেই বাদ পড়ে যাচ্ছেন। সুতরাং ঝাড়ুদারের চাকরিও মিলছে না।

রাজ্যগুলিতে কোনও বড় শিল্প গড়ে উঠছে না। প্রতি বছর ঘটা করে শিল্প সম্মেলন হয়। দেশবিদেশের শিল্পপতিরা এই সম্মেলনে যোগ দেন। প্রতিশ্রুতি দেন অনেকেই এখানে লগ্নি করার। কিন্তু তারপর নানা কারণে তাঁরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। দেশে বড় বড় শিল্প গড়ে না উঠলে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে না। বেকারদেরও চাকরি মিলবে না। তাঁরা সুযোগ পেলেই বিদেশে পাড়ি দেবেন। এটা তো দেশের পক্ষে বড় বিপর্যয়। তাছাড়া যাঁরা অশিক্ষিত কর্মী, তাঁদের জন্যও কাজের কোনও সংস্থান নেই। সুতরাং বেকারদের সামনে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাঁদের কথা প্রধানমন্ত্রী কতটা ভাবেন, জানার উপায় নেই। রোজগার মেলায় কিন্তু লোকের চাকরি মেলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে। কিন্তু বিরোধীরা সমালোচনা করে বলে, এগুলি নতুন চাকরি নয়, শূন্যপদে নিয়োগ। সুতরাং বেকার সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর কর্মসংস্থান দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাঁরা বলেন, মোদী তো আর অটলবিহারী বাজপেয়ী নন, যিনি ছয়টি দলের সাহায্যে সরকার গঠন করে পাঁচ বছর নির্বিঘ্নে কাজ করে গেছেন। এই প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর শরিকদলকে নিয়ে কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি।

রাজনৈতিক মহল মনে করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিই হোক অথবা বেকারদের জ্বালাযন্ত্রণা, যতই থাকুক, মোদী সরকারের সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নেই। এবং নির্বাচন এলেই, তা যে রাজ্যেই হোক বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষমতা দখল করার জন্য। একবার ক্ষমতা হাতে পেলে, আর কিছু করার নেই। হরিয়ানার সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপির অপ্রত্যাশিতভাবে জয়, এই দলকে উজ্জীবিত করেছে। তাই মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে যেনতেন প্রকারে জয়ী হয়ে সরকার গড়তে উদ্যত এই দল। আর একবার সরকার গড়ার পর, সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির উন্নয়ন নিয়ে তেমন মাথাব্যথা থাকে না এই দলের।
এখন অস্বাভাবিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বেড়েই চলেছে। দেশের মানুষ যে দুর্বিষহ যাতনা ভোগ করছে, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই কেন্দ্রীয় সরকারের। সম্প্রতি বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ প্রচুর ডিম কিনেছে ভারত থেকে। তাই এখানে ডিমের মূল্য ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য পাচার রোধ করা বিএসএফের কাজ। কিন্তু এ ব্যাপারে বিএসএফকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলেছে বলে আমাদের জানা নেই। এই পাচার রোধ করতে না পারলে, এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়তেই থাকবে। সাধারণ মানুষকেও এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে পড়েই জীবনধারণ করতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিটি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। সাধারণের তা কেনা নাগালের বাইরে। অথচ রাজ্য সরকার মনে করে কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এবং পাচার বন্ধে বিএসএফ’কে সক্রিয় হতে না বললে, দ্রব্যমূল্য পড়তেই থাকবে। আর কেন্দ্রীয় সরকার নীরব ভূমিকা পালন করে চলবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে দেশের মানুষের পাহারাদার বলে মনে করেন, কিন্তু তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভাবেন না।

Advertisement