সুরঞ্জন মিদ্দে
‘প্যাশন্ প্লে’ হচ্ছে যিশুখ্রিস্টের মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে রচিত নাটক। জার্মান দেশে ‘প্যাশন প্লে’ সর্ব প্রথম অভিনীত হয়। আর কয়েকশো বছরের মধ্যে এই নাটক জগৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এবার আমরা ইতিহাসের পাতার দিকে ফিরে তাকাই। জার্মানির এই বিখ্যাত নাটক বিশ্বকবিকেও প্রভাবিত করেছিল।
জার্মানির একটি সবুজ গ্রাম। জার্মানির দক্ষিণ সীমান্তে ব্যাভোরিয়া অঞ্চলে আল্পস পর্বত শ্রেণির পাদদেশে অবস্থিত এই গ্রাম। সমুদ্রতীর থেকে দু-হাজার ছ’শো ফিট উপরে তুলিতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম। গ্রামের নাম ও বেরামারগাও। গ্রামটিকে ছোটই বলতে হবে কারণ তার জনসংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু ছোট হলেও গ্রামটি একটি বিশেষ কারণে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে শুধু ইউরোপে নয়, সারা বিশ্বে।
প্রতি দশকের প্রথম বছরে এই ছোট্ট গ্রামটি হয়ে ওঠে রাপকথার দেশ। গ্রামের প্রতিটি মানুষ অতীত দিনের একটি অঙ্গীকার পালনে হয়ে ওঠে সক্রিয়। প্রায় পৌনে চারশো বছর আগের কথা। সালটা ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ। প্রায় সমস্ত ইউরোপে তখন প্লেগ মহামারীর কবেলে। প্রাণ হানি ঘটেছে হাজারে-হাজারে। এই মহামারীর কবল থেকে গ্রামকে রক্ষা করার জন্য একটি ব্যবস্থা নিয়েছিল। নিয়মটা ছিল বাইরের কোনও মানুষ মহামারীর প্লেগ রোগের জীবনু নিয়ে গ্রামে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু কঠোর নিরাপত্তা সত্ত্বেও ক্যাসপার সিসলার (Kasper Schislar) নামে এক প্রবাসী গ্রামবাসী গ্রামে ঢুকে ভয়বহ প্লেগ রোগ ছড়িয়ে দিল। আর কিছু দিনের মধ্যেই গ্রামের শতাধিক মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্রাণ হারালো। তখন সমস্ত ধর্মনিষ্ঠ খ্রিস্টান গ্রামবাসীরা গির্জায় এসে প্রার্থনা শুরু করেছিল। সবাই মিলিত কণ্ঠে সেদিন একটি প্রতিজ্ঞা করেছিল। সংকল্পটি ছিল সমস্ত গ্রামবাসী একেত্রে মিলিত হয়ে প্রতি দশ বছর অন্তর পবিত্র মনে যিশু খ্রিস্টের মৃত্যু যন্ত্রণার কৃচ্ছ্ব সাধনা নিয়ে রচিত নাটকের অভিনয় করবে। আশ্চর্য যে, ঐতিহাসিকদের মতে সেই দিন থেকে ওই গ্রামে আর কেউই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়নি। এই নাটকটি হলো ‘প্যাশন্ প্লে’ (passion play)। নাটকটি খ্রিস্টের মৃত্যুর দুঃখ ভোগের নাটক। এটি প্রথম অভিনীত হয় ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে। তারপর ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে স্থির হয় এই নাটকের অভিনয় প্রতি দশকের প্রথম বছরে হবে। সেই ব্যবস্থাই আজও প্রচলিত আছে। নাটকটি জার্মান ভাষায় রচিত এবং জার্মান ভাষাতেই অভিনীত হয়।
জার্মানির এই ‘প্যাশন প্লে’টিতে ১৬টি অঙ্ক, ১৫টি গর্ভাঙ্ক এবং ৬৬টি দৃশ্য। আর আছে খ্রিস্টের মৃত্যুর ঐতিহাসিক ঘটনার বিষয়োপেযোগী ২০টি অপূর্ব মূক অভিনয়ের দৃশ্য। একক, দ্বৈত, সম্মিলিত প্রায় ৪০টি সুমধুর সঙ্গীত ও প্রার্থনামালা।
‘প্যাশন প্লে’র প্রস্তুতি চলে সারা বছর ধরে। কোন অভিনেতা—অভিনেত্রী পরচুলা ব্যবহার করেন না। অভিনয়ের জন্য ছেলে-বুড়ো সবাই এক বছর ধরে দাড়ি, গোঁফ ও চুল রাখেন। মোট অভিনয় করেন প্রায় ১২০০ জন। প্রতিদিন অভিনয় করার আগে সমবেতভাবে গির্জায় প্রার্থনা করে তারপর স্টেজে যান। অভিনয় চলে প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। নাটক হয় খোলা আকাশের নীচে। ঝড় বৃষ্টি এলেও অভিনয় বন্ধ হবে না। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেও ‘প্যাশন প্লে’ চলতে থাকে। কমপক্ষে দর্শক থাকেন হাজার পাঁচেক। এই বিপুল সংখ্যক দর্শক সারাদিন ধরে অভিনয় দেখেন। অভিনয় চলাকালীন কোনও দর্শক ধূমপান করেন না। ‘প্যাশন প্লে’র টিকিটের চাহিদার জন্য অন্তত ছয় মাস আগে থেকে আমন্ত্রণ পত্র সংগ্রহ করতে হয়।
এই নাটকের জন্য কোনওরকম মুনাফা করা যাবে না। তাই টাকার বিনিময়ে এই নাট্যদৃশ্য রেকর্ড করা বা টেলিভিশনে দেখানো নিষিদ্ধ। এই নাটক যেহেতু যিশুর মৃত্যু ভোগের নাটক তাই কেউ হর্ষব্যঞ্জক করতালি দেয় না। নাটক শেষে সকলে নীরবে চলে যায়। নানান ধরনের প্রাকৃতিক রাজনৈতিক ও আর্থিক বাধা বিপত্তি অতিক্রম হয়ে আসছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ‘প্যাশন প্লে’ দেখার সুযোগ হয়েছিল। দিনটা ছিল ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই। এই অসাধারণ নাটকটি দেখে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হন। তিনি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ‘প্যাশন প্লে’টি দেখেন।
যিশু খ্রিস্টের জীবনের দুঃখভোগকে নিয়ে এই নাটক। খ্রিস্টের এই মৃত্যু যন্ত্রণা সমগ্র জগতে অমর সাহিত্য ও চিত্রকলার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও ‘প্যাশন প্লে’ দেখে খ্রিস্টের মহাজীবন সম্পর্কে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটির নাম ‘The Child’। ‘The Child’ ইংরেজিতে লেখা রবীন্দ্রনাথের একমাত্র কবিতা। নিজের কবিতা রবীন্দ্রনাথ নিজে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, কিন্তু ‘The Child’ তিনি সরাসরি ইংরেজিতেই লেখেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে, জার্মানিতে। জার্মানের মিউনিখ শহরের কাছে আবেরামারগাও গ্রামের খ্রিস্টের আত্মৎসর্গ নিয়ে ‘প্যাশন প্লে’র অভিনয় দেখে কবি ‘The Child’ কবিতাটি লেখেন। ইংরেজিতে লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা। জার্মানির উফা চলচ্চিত্র সংস্থা এই সময় রবীন্দ্রনাথকে একটি চিত্রনাট্য— লিখে দেবার জন্য অনুরোধ করেন। এই রচনা সেই উপলক্ষে। চলচিত্রটি নির্মিত হয়নি। তবে ‘The Child’ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক: অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন’
ইংরেজি ‘The Child’ এ সংলিপ্ত হয়েছিল খ্রিস্টজীবনের অনুষঙ্গ। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দেই রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ‘The Child’ এর বাংলা রূপান্তর করেছিলেন। প্রথমে তা প্রকাশিত হয় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় (ভাদ্র, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ); পরে সংকলিত হয় ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে।
একজন কবি প্রথমে বিদেশি ভাষায় একটি মৌলিক কবিতা রচনা করেছেন। পরে নিজেই তার রূপান্তর করেছেন মাতৃভাষায়, এরকম ঘটনা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য বলা যায়। ‘The Child’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ‘শিশুতীর্থ’ নামে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করেন। ‘শিশুতীর্থে’র রবীন্দ্রনাথের হাতে প্রথম গদ্যছন্দ—তাঁর নিজের ভাষায় গদ্যিকা রীতির প্রয়োগ দেখা গেল। ‘শিশুতীর্থে’ তিনি গদ্য পংক্তিগুলি সাজিয়ে দিলেন কবিতার যেন এক নতুন পথে যাত্রা শুরু হলো। আবু সয়ীদ অইযুবের বিচারে ‘শিশুতীর্থ’ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ গদ্য কবিতা।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় ‘শিশুতীর্থে’র দুটি নৃত্যাভিনয় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, এই নৃত্যাভিনয় হয়েছিল ২৮ এবং ২৯ ভাদ্র ১৩৩৮; ম্যাডান থিয়েটার এবং ‘প্যালেস অফ ভ্যারাইটিজ রঙ্গমঞ্চে।
‘The Child’ এর সঙ্গে ‘শিশুতীর্থ’ পাশাপাশি পাঠ করলে একটা প্রশ্ন জাগে। কবি রবীন্দ্রনাথ নিজের কবিতার অনুবাদ— বাংলা থেকে ইংরেজিতে— আগেই করেছেন। এখানে উপলক্ষ স্বতন্ত্র। প্রবাসে বসে ইংরেজিতে ‘The Child’ কবিতাটি সম্পূর্ণ মৌলিক রচনা। আবার ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটিও আর অনুবাদ থাকছে না; হয়ে উঠেছে একটি নতুন কবিতা। তিনি ইংরাজি কবিতাটির ভারতীয়করণের জন্যই কি নতুন ভাষা নির্মাণ করলেন?
মানববোধের আলোকে ‘The Child’ ও ‘শিশুতীর্থ’ কবিতা দুটি এক অনন্যতা লাভ করেছে। দুই কবিতাই নিজ নিজ গুণে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। এখানেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অনন্যতা।
খ্রিস্টের মৃত্যুকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আশ্চর্য এক ব্যতিক্রমী মূল্যায়ন। তিনি লেখেন—
‘আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে, কিন্তু— ক্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন।’
‘আজও তিনি মানুষের ইতিহাসে প্রতি মুহূর্তে ক্রুশে বিদ্ধ হচ্ছেন।’
মৃত্যুই জীবনের নবজন্মের সূচনা করে। রবীন্দ্রনাথ এই চিত্রকল্পটিকে ব্যাপকের আড়ালে খ্রিস্টের ‘প্যাশন প্লে’র মধ্যেই ‘The Child’কে দেখেছেন। দেখেছেন নবজাতক শিশুকে।
‘for in his death he lives in the life of us all, the great victim.
And they all stand up and mingle their
Voices and Sing,
Victory to the Victim.
‘কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের জীবনের
মধ্যে সঞ্জীবিত সেই মহামৃত্যুঞ্জয়।
সকলে দাঁড়িয়ে উঠল; কণ্ঠ মিলিয়ে গান করলে—
জয় মৃত্যুঞ্জয়ের জয়!’
শুধু জন্ম নয় মৃত্যুর জয়ধ্বনি। যিনি মৃত্যুকে জয় করতে পেরেছেন। তাঁর কর্মবাণীর মাধ্যমে। তিনি মারা গিয়েও বেঁচে আছেন আমাদের মধ্যে। তিনি শুধু মৃত্যুঞ্জয় নন তিনি চিরজীবীও। রবীন্দ্র সাহিত্যে মৃত্যু এনেছে নবসৃষ্টির পুরাণ থেকে। যেখানে বাইবেলের মৃত্যু মর্মকথা, উপনিষদের চিরন্তন সত্যের সঙ্গে একান্ত হয়ে গেছে। খ্রিস্টের মৃত্যুও তাই ‘গুড ফ্রাইডে’ নামে চিহ্নিত হয়েছে; ‘স্যাড ফ্রাইডে’ হিসাবে নয়।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত এই ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটি আমাদের ‘তীর্থযাত্রী’ কবিতাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ টি.এস. এলিয়টের ‘The Journey of the Magi’ নামক কবিতার বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন— ‘তীর্থযাত্রী’ নামে। —
‘এর আগে তো জন্মও দেখেছি, মৃত্যুও,
মনে ভাবতাম তারা এক নয়।
কিন্তু এই-যে জন্ম এ বড়ো কঠোর,
দারুন এর যাতনা, মৃত্যুর মতো, আমাদের মৃত্যুর মতোই।’
রবীন্দ্রনাথই খুব সহজেই বলতে পেরেছেন— ‘মরণ রে/ তুঁহুঁ শ্যাম সমান।’ মৃত্যুই অমৃত দান করতে পারে। মৃতুই পৌঁছে দেয় খ্রিস্টরূপী শ্যামের কাছে। তাই মহাকবির কাছে মৃত্যু বিচ্ছেদ নয় মিলনের এক অপরিহার্য বিবর্তনের প্রতিছবি। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ‘তীর্থযাত্র’ কবিতায় প্রশ্ন তুলছেন— ‘সে কি জন্মের সন্ধানে না মৃত্যুর।’
মানুষের ইতিহাসে দুঃখ-আনন্দের নানান বর্ণময় মুহূর্তে খ্রিস্ট যেন তাঁর মহাজীবন দিয়ে প্রতিমান হয়ে উঠেছেন। বর্বর ঘাতকের হাতে খ্রিস্টের শারীরিক মৃত্যু হয় কিন্তু তিনি আবার অন্যধর্মের আড়ালে নবজাতক হয়ে ফিরে ফিরে আসেন। খ্রিস্টরাই প্রমণ করেন তাঁরাই আসলে ‘চিরজীবিত’। তাঁদেরকে ধ্বংস করার ক্ষমতা কোনও ঘাতকের কেন, কারোরই নেই। আমরা বারবারই আমাদের মহামানবদের হত্যা করছি, আর বারবারই সেই ‘শিশুতীর্থের দিকে চলেছি, যেখানে জন্ম নিচ্ছে নবজাতক। সেই ঈশ্বরপুত্র খ্রিস্ট মানবপুত্র হিসেবে প্রতি মুহূর্তে তীব্র ব্যথায় বিষের পানপাত্র দূরে ঠেলে দিচ্ছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, খ্রিস্টকে নিয়ে এক নবতর বিশ্লেষণ করে, বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে এক অভিনব মাত্রা এনেছেন। রবীন্দ্রনাথ এখানে বাইবেলের মিথকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ‘শিশুতীর্থ’ যেন এক আধুনিক বাইবেল। ‘যা একুশ শতকেও নতুন ভাবনার দিশা দেয়। খ্রিস্টের মৃত্যুদিন ‘স্যাড ফ্রাইডে’ হয়ে থাকে না; হয়ে যায় ‘গুড ফ্রাইডে’।