প্রবীর মজুমদার
দু’দিনের লাগামছাড়া রক্তাক্ত বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা
অলি। সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে সোমবার নেপালে ‘জেন-জি’ আন্দোলনের সূত্রপাত। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নেপালি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে ২৩ জন আন্দোলনকারী প্রাণ হারিয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইনসভার মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারীরা আগুন দিয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত আপাতত সামাজিক মাধ্যম বলা হলেও অন্য কারণ থাকার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সকালে কাঠমান্ডুর বাণেশ্বর এলাকায় প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তা রাজধানীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে দেশটির সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাতে সময় পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৯ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থীরাও ছিলেন। এ ঘটনায় ৪০০ জনের বেশি তরুণ আহত হন। এই ঘটনার দায় নিয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীও পদত্যাগ করেন।
সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স, রেডিট, লিংকডইন প্রভৃতি সামাজিক মাধ্যম নেপাল সরকার-নির্দেশিত নিয়ম মানতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটিতে এসবের কার্যক্রম ব্লক করে দেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জেন-জি প্রজন্ম বিক্ষোভ করতে রাস্তায় নেমে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাধে। মূলত বিরোধী দলগুলোকে দমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত ও সংবাদমাধ্যম শৃঙ্খলিত করার উদ্দেশ্যেই সরকার এসব সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া সমাজে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা-উদ্ভূত ক্ষোভজনিত আন্দোলন দমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেও এ পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোমবার রাস্তায় নেমে আসা তরুণরা বলেন, তারা সরকারের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করছে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞাই তাদের বিক্ষোভের জন্য জড়ো হওয়ার প্রধান কারণ। তবে সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সকলের দুর্নীতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাও তাদের উদ্দেশ্য। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে নেপালের সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং তাদের দুর্নীতির অর্থায়নের অভিযোগে ‘নেপো কিড’ নামে একটি প্রচারণা শুরু হয়।
গত বছর বিশ্ববাসী বাংলাদেশে জেন-জির বিক্ষোভ দেখেছে। যার ফলে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও বহু ক্ষেত্রে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মতোই ভূরাজনৈতিক কারণে দেশটির অর্থনীতি প্রতিবেশী প্রভাবিত। বিশেষত নেপালের দুই পাশে রয়েছে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি ভারত ও চিন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিত দেশগুলো যখন স্বাধীন হতে শুরু করে; রাজতন্ত্র শাসিত নেপালেও এ সময় ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠে গণআন্দোলন। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে একুশ শতকে এসে দেশটি রাজতন্ত্র থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপ নেয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটলেও অর্থনৈতিক রূপান্তর সম্ভব হয়নি; বরং সংকট বিভিন্নভাবে বেড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট কর্মসংস্থান গড়ে ওঠেনি। তা ছাড়া দীর্ঘদিন গুটিকয়েক মানুষের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকা এবং অর্থনীতিতে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ দিন দিন বাড়তে থাকায় সমাজের ভেতরেই ক্ষোভ বিরাজ করছিল, যা প্রায় সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। মূলত রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটলেও কতিপয় ব্যবসায়িক বলয়ে দেশটি পৈতৃক শাসনাধীনের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
নেপালের অর্থনৈতিক মন্দার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো নিশ্চিত না হয়ে অনুমানের ভিত্তিতে মুনাফা লাভের আশায় রিয়েল এস্টেট তথা প্রধানত জমির মতো অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা। তা ছাড়া দেশটির অর্থনীতির বড় একটি অংশ রেমিট্যান্সনির্ভর। কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিদিন ছয় সহস্রাধিক তরুণ বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নেপাল এখনও গুরুতরভাবে কেন্দ্রীয় শাসনাধীন। এখানে বিকেন্দ্রীকরণের যথেষ্ট অভাব রয়ে গেছে। সংঘাত ও পদ্ধতিগত সহিংসতা রাজনীতি উত্তপ্ত করেই চলেছে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগেও উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি। বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তন নয়, তারা চায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার ও কার্যকর জবাবদিহি। তরুণদের অভিযোগ—দীর্ঘদিন ধরে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, অথচ শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সুশাসনের প্রশ্নে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেল ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১১ দফার ঘোষণা করেছেন। এতে নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক দূরত্ব। তা ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই এখানে জনসেবা খাতগুলো বেশ দুর্বল। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পদ্ধতিগত সমস্যায় জর্জরিত, যা স্বাভাবিকভাবেই সমাজে ক্ষোভের দানা বপন করে রেখেছে।
বিশ্বায়নের ফলে যে কোনো আন্দোলন দ্রুত অপরাপর দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বের বহু সরকারকে এখন বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে; তেমনি দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কুক্ষিগত কাঠামোতেও ব্যাপক চাপ ও তাপ তৈরি হচ্ছে।
নেপালের চলতি পরিস্থিতি যেমন অভ্যন্তরীণ বহু ঘটনা দ্বারা তাড়িত, তেমনি সেখানে বহু বৈশ্বিক আন্দোলন আগুনে ঘি ঢালার মতো ইন্ধন দিয়েছে। বিশেষত আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-বিরোধী আন্দোলন, মিয়ানমারে জান্তা-বিরোধী লড়াই, বাংলাদেশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান নেপালি তরুণদের উস্কে দেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
নেপালেও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার যে বলয় তৈরি হয়েছে, তা চলমান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভেঙে যেতে পারে বৈ কি! পেছনে ফিরে যেতে চাইলে জনগণ তা মেনে নেবে না। অলির পদত্যাগ নেপালের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও যুবসমাজের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমনের একটি বড় মোড় ঘুরনো ঘটনা হয়ে উঠতে পারে।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন অলি। নেপালি কংগ্রেসের সমর্থনে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তবে রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নের দায় তার প্রশাসনের ওপর চাপতে শুরু করলে ক্রমেই তার বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়তে থাকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের জন্য অলির সরকারকে দায়ী করে।
অলি এর আগে ২০১৫–১৬, ২০১৮–২১, স্বল্প সময়ের জন্য ২০২১ সালে এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দৃঢ় মনোভাব ও জাতীয়তাবাদী নীতির জন্য পরিচিত এই নেতা ক্ষমতায় আসেন স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। তবে তার রাজনৈতিক জীবন শেষ হলো অস্থিরতা, জনঅসন্তোষ ও কর্তৃত্ববাদিতার অভিযোগের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগের পরও শান্ত হয়নি নেপালের রাজপথ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তিনি নেপাল ছেড়ে দুবাইয়ে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করছেন।
Advertisement